জগদীশ নারায়ণ সরকার
২। মীর জুমলার বাঙলা প্রশাসন
প্রায় তিন বছর(৯ মে ১৬৬০-৩১ মার্চ ১৬৬৩) বাঙলার প্রশাসনিকভার সামলান মীর জুমলা। কিন্তু যেহেতু তিনি নভেম্বর ১৬৬১ সাল থেকেই অসম আর কোচবিহারের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, তাঁর বাঙলার প্রশাসনিক দায়িত্বের কার্যকর মেয়াদকাল ছিল মোটামুটি দেড় বছর। দীর্ঘকাল পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যে প্রশাসনিক সংস্কার করে সুফলগুলি পাওয়া যাওয়ার সুযোগটি তিনি পান নি। সরকার, পরগণা এবং তাঁর আমলাতান্ত্রিকতার যে ব্যবস্থা বাংলায় তাঁর আগে বর্তমান ছিল সেটি আকবরের সময়ে তৈরি। কার্যনির্বাহী শাসক(হুজুর), রাজস্ব(মল) এবং প্রশাসক এবং দেওয়ানের মধ্যে প্রশাসনিক বিভাগটিও আকবরের সময় থেকে বাংলায় পূর্ণদ্যমে চলে আসছে। প্রশাসক, সদর এবং বিচারক, কাজির মধ্যেও যে প্রশাসনিক পার্থক্য সেটি তখনও চালু ছিল। তবুও মীর জুমলার মত শক্তিশালী প্রশাসক খুব কম সময়েও তাঁর নিজের কর্মদক্ষতা প্রমান করেছেন বাংলায়।
তিনি পর্তুগিজ এবং আরাকানি দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রাথমিকভাবে বাঙলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় তুলে নিয়ে যান। টিপেরা, ঘোড়াঘাট আর হাজোর রাজা মীর জুমলাকে রাজস্ব দিতে অস্বীকার করেন। তিনি রশীদ খানের নেতৃত্বে হাজো, ফরহদ খানের নেতৃত্বে টিপেরা এবং সুজন সিংএর নেতৃত্বে ঘোড়াঘাটে সেনা পাঠানোর প্রস্তাব করেন।
রাজস্ব প্রশাসনে জমির যে তিন ধরণের ভাগ ছিল – খালসা, জায়গির বা জমিদারি এবং সায়ুরঘালই বজায় থাকল। ১৬৫৮এ শাহ সুজার প্রশাসনে তোডরমল্লের রাজস্ব প্রস্তাব আআসে এবং সেটি কিছুটা সংস্কার হয় পরের বছর। তোডরমল্লের আগে খালসায় আসল জমা হিসেব(৬৩,৪৪,২৬০ টাকা)রূপে আদায় ছিল। সেই পরিমানটি ২৪ লক্ষ টাকা বাড়ে (৮৭,৬৭,০১৬ টাকা)। কিন্তু জায়গির রাজস্বের বৃদ্ধি ঘটে নি (৪৩,৪৮,৮৯২ টাকা)। এই দুয়ে মিলিয়ে সুজার সময়ে বাঙলার মোট রাজস্ব ছিল ১,৩১,১৫,৯০৭ টাকা। এই হিসেব চলে আওরঙ্গজেবের প্রথম দস্তুর উল আমল(১০৬৯ অলহজ্ব এবং ১০৬৫ ফাসিলে) অর্থাৎ যখন মীর জুমলা বাঙলার সুবাদার বা নবাব হয়ে এলেন, সেই সময় পর্যন্ত। কিন্তু বাস্তবে সংগ্রহ হল মাত্র ৮৬,১৯,২৪৭ টাকা, যা আদতে শাহ সুজার সময়ের আদায়ি মোট খালসা রাজস্বের কিছু কম। এই কম অর্থ আদায়ের বড় কারণ হিবে ধরা হয় সে সময়ে বাঙলার রাজনৈতিক আস্থিরতাকে। রাজস্ব বিষয়ে স্থায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই তাকে কোচবিহার এবং অসম অভিযানে চলে যেতে হয়।
ঢাকায় প্রশাসন চালানোর সময় খালসা জমিতে কৃষকদের থেকে তিনি তাঁর প্রজ্ঞা এবং বাস্তবতা প্রয়োগ করে রাজস্ব আদায় করেছেন।
অন্যদিকে মনসবদারদের থেকে জায়গিরগুলির আদায়ও খুব কিছু সন্তোষজনক ছিল না। যেহেতু সেগুলি দূরে দূরে ভিন্ন ভচি পরগণায় অবস্থিত ছিল, এবং তাদের সঙ্গে জুড়ে ছিল প্রচুর অংশিদার, ফলে কৃষকদের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ত। কৃষকদের ওপর অত্যাচার হত এবং পরগণাগুলি শেষ পর্যন্ত জনশূন্য থেকেই যেত।
সায়ুরঘাল জমিগুলি বিষয়ে বলা যায়, মীর জুমলা নিজের জায়গিরে প্রচুর আয়মাদার এবং জলপানি পাওয়া গুণীকে বসিয়েছিলেন। এছাড়াও বহু মানুষ যারা সম্রাটের থেকে শুল্কশূন্য জমি ভোগের ফরমান পেতেন তারাও এই সব জমিতে বসতেন। কিন্তু বহু সময় দেখা গিয়েছে জায়গিরদারের বদলি বা মৃত্যুর পর বহু সময়ে এই ভোগদখলকারীর উত্তরাধিকারীদের হাতে এই জমিগুলি ভোগের পাট্টা থাকত না। মীর জুমলার মৃত্যুর পর তার জায়গিরে এই ধরণের শুল্কমুক্ত জমির(মদদইমাশ, আয়মা, সয়ুরঘাল) দখলদারি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ১৬৬০ সালে সদর, কাজি রিজভি এই ধরণের অধিকারগুলির দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। যাদের হাতে সম্রাট বা জায়গিরদারের ফরমান ছিল না, তাদের তিনি জমির ভোগদখল থেকে উচ্ছেদ করেন। জমিগুলি জায়গিরদারদের এস্টেটে দখলিকৃত হয়। আয়মাদারদের জমি কর্ষণের অধিকার দেওয়া হল, এবং তাদের রাজস্বও দিতে হত। এই নির্দেশ আয়মাদারদের ওপরে খুব গভীর হল, কেননা আয়মাদারেরা জমি চাষ করতেন না, ফলে তাদের রাজস্ব দেওয়ার কোন সুযোগই ছিল না। তারা সদর, কাজি রিজভির বিরুদ্ধে শায়েস্তা খাঁয়ের কাছে অভিযোগ করেন এবং তার প্রতিবিধান তারা উসুল করেন শায়েস্তা খানের থেকে।
জাকাত, আয়ের একের চল্লিশভাগের একভাগ কর আদায় হতে থাকল হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সওদাগর(মার্চেন্টস), ভ্রমণকারীদের থেকে এবং শুল্ক(কাস্টম - হাসিল) আদায় করা হতে থাকল কারিগর, ব্যবসায়ী(ট্রেডসমেন), খুশনসিন(নবাগত বা ধনী)দের থেকে। পরগনাগুলিতে জায়গিরদার বা জমিদার নিঃসন্তান রায়ত, নবাগত, বা মরন্মুখ ব্যক্তিদের সম্পত্তি, এমন কি স্ত্রী, কন্যা দখল নিতে শুরু করত।
তাঁর সময়কালে মীর জুমলা দ্রুত এবং যথাযোগ্য বিচারের ব্যবস্থা করেন। তিনি নিজে প্রশাসনিক কাজে আকবরের দেখানো পদ্ধতির অত্যন্ত অনুগামী ছিলেন, ফলে তাঁর কাছে বিচার চাইতে আসা সাধারণের তিনি কোন বাধা ছাড়াই সরাসরি বিচার দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তিনি নদীর মুখোমুখি নিজের আসনে বসে অস্ত্রহীন উচ্চনীচ ধনীনির্ধন ভেদাভেদ না করেই যথাযোগ্য বিচার করতেন। ঢাকার নারায়ণগঞ্জের কাছে খিজিরপুরে থাকাকালীন দই বেচানী এক মহিলাকে ডেকে তাঁর এক চাকর অর্থ ছাড়াই দই নিয়েছিল। সেই মহিলা সঙ্গে সঙ্গে নবাবের কাছে বিচার চেয়ে বসল। স্বভাবত চাকরটি সেই অভিযোগ অস্বীকার করে। তাকে বমির ওষুধ দিয়ে বমি করানো হলে দেখা গেল সে খাবারের সঙ্গে দইও বমি করে। সুবাদার তখন তাঁর পেট কেটে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রেখেদিয়েছিলেন, যাতে এ ধরণের কাজ করতে গিয়ে অন্যেরা সতর্ক হয়। সে সময় জনশ্রুতি ছিল, মীর জুমলার এই বিচারের পদ্ধতি এমন কার্যকর হয় যে কেউ একটাও খড় চুরি করত না।
তাঁর কাছে খবর ছিল ঢাকার কাজি মোল্লা মুস্তাফা ঘুষ নেন এবং মীর আদিল তাকে এই কাজে সাহায্য করেন। তিনি উভয়কেই ঢাকা থেকে বহিষ্কার করেন এবং স্বয়ং ধর্মীয় এবং অন্যান্য বিষয়ে বিচারের দায় নিজের কাঁধে তুলে নেন। তিনি যেটিকে ঠিক বলে বিশ্বাস করেন সেটি নিজে পালন করতেন। অসমের পথে অভিযান করার সময় নির্দেশ দিয়ে গেলেন কোরানীয় বিধিতে যে বিচার হবে সেটি করবেন শেখ আজম, কিন্তু কাগজকলমে তিনি কাজির পাঞ্জা ব্যবহার করতে পারবেন না। ধার দেওয়া বা ধার শোধ চাইবার বা চুরি যাওয়া সম্পদ ফেরত পাওয়ার সময় রাষ্ট্র থানা মার্ফত একের চল্লিশাংশ কেটে রেখে দিত। বিচারকের সামনে অভিযোগ করা বাদী বিবাদী মমলার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তাদের ধরে রাখা হত, এবং যিনি সমন বা নির্দেশ নিয়ে যেতেন তাকে প্রত্যেক দিন শুল্ক দিতে হত যা রাজস্ব হিসেবে জমা পড়ত।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment