কৃঃ আমাদের বিজ্ঞন-প্রযুক্তির বিষয়ে কিছু বলুন।
ধঃ জ্যোতির্বিদ্যা আর অঙ্কই ধরুণ। বাংলার ব্রিটিশ সেনা প্রধান রবার্ট বার্কারের কথাই ধরুণ। পরে তিনি পার্লামেন্টেরিয়ানও হয়েছেন। তিনি বেনারসের মনমন্দির সম্পর্কে লিখেছেন। ১৮২৩ পর্যন্ত এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা মনে করত যে এটি বিশ্বের সেরা পাঁচটি মানমন্দিরের অন্যতম।১৭৯০ সালের এক প্রবন্ধে, অঙ্কবিদ এবং এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জন প্লেফেয়ার ফরাসী জ্যোতির্বিদ্যার ঐতিহাসিক বেইলির বইএর বিশদ আলোচনা করেন। এই সময় রুবেন বারো( Ruben Burrow) বাইনোমিয়াল থিওরেম প্রকাশনা করেন। লেফটানেন্ট জেন্টিল, প্রখ্যাত কাসিনির লেখা, কিভাবে তামিলেরা কাগজ কলম ছাড়া, কিছু ঝিনুক আর কিছু অঙ্কের নামতা ব্যবহার করে, গ্রহণের হিসেব করত তার বর্ণনা দিয়েছেন। কৃষি নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে।
১৮২০ সালের কর্নেল আলেকজান্ডার ওয়াকার মালাবার আর গুজরাটের কৃষি নিয়ে লেখেন। হলওয়েল, কিছু মাত্র সময়ে বাংলার সরকার ছিল। বাংলার বসন্তের টীকা দেওয়া নিয়ে বিশদে লিখেছেন। ১৮০২-৩ সালে ব্রিটিশেরা ভারতীয় পদ্ধতিতে টিকা দান নিষিদ্ধ করে। হ্যালকট দক্ষিণের ড্রিলপ্লাউ নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। তার মন্তব্য ছিল এটি খুব সাধারণ অথচ কার্যকর। তিনি লিখছেন তার ধারণা ছিল না এটি ভারতীয় প্রযুক্তি। এছাড়াও ঊজ নামক ভারতীয় ইস্পাত তৈরির বর্ণনা পেশ করেছেন ব্রিটিশরা। ড। হেলেনিয়াস স্কট তাঁদের(সাম্রাজ্য) যতগুলি ইস্পাতের সঙে পরিচিতি রয়েছে, এটি সবকটির থেকে উত্তম। এছাড়াও বরফ তৈরি, কাগজ তৈরি এবং মর্টার তৈরি নিয়েও বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
কৃঃ কিন্তু বহু ব্রিটিশ ভারতের জনগণকে গরীব, দরিদ্র্য, অজ্ঞ বলে বর্ণনা করেছেন।
ধঃ আদতে আষ্টাদশ শতকে ভারতে আসা প্রায় সব সিভিলিয়ানদের এই মানসিকতা ছিল। ব্রিটেনের সেই সময়ে নির্দিষ্ট হায়ার্কিক্যাল স্ট্রাকচার ছিল, আইনি ব্যবস্থা এবং বংশ, কুল, পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থের জোরে কিনতে পারা যায় এমন পদমর্যাদার সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। সেই তুলনায় সাধারণ কিন্তু জীবন্ত ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় দৃশ্যত মিলেমশে থাকার যে পরিবেশ গড়ে উঠেছিল, বা অর্থ অনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা, পরিকাঠামো বা জমির যৌথ মালিকানা ইত্যাদি ব্রিটিশদের চোখে ঢিলেঢালা এবং সম্পদহীন সমাজের প্রতিফলন।
১৮১৩ সালের ভারতবর্ষীয়দের বিষয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে আলোচনা হয়, তাতে এতদিনের লুঠ, অত্যাচারের পরেও ভারতীয় সমাজে যে ধরণের জ্ঞানের বহিপ্রকাশ হয়, যেভাবে মানুষে মানুষে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে, যেভাবে তাঁরা সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে তা নিয়ে বেশ কিছু পার্লামেন্টারিয়ান উল্লেখ করেছেন। আদতে উনবিংশ শতকে উইলবার্ফোর্সএর মত তাত্ত্বিকেদের মত এই মনোভাবের জন্য দায়ি। তিনি বলেন গ্রিস যতদিন খ্রিষ্ট ধর্মে মতি পেশ করেনি ততদিন তাঁরা গরীব ছিল। ভারতেরও একই অবস্থা। যতদিন না তাঁরা খ্রিস্টের অনুগামী না হচ্ছে তাঁদের অবস্থা পাল্টাবে না।
আমার মতে ভারতীয়দের অজ্ঞ, মুর্খ, গরীব ইত্যাদি বলার পিছনে যুক্তি ছিল, ভারতের ধর্ম ব্যবস্থা। ভারতীয়রা অনেক বেশি ধার্মিক। আদতে ভারতকে আর্থ-সামাজিকভাবে গরীব, পিছিয়েপড়া হিসেবে দেখানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে ১৮০০ সালের পর থেকে। কেন্দ্রিভূত ব্রিটিশ রাজনীতি, সম্পদ সংগ্রহ নীতি আর শাসনপদ্ধতি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল - ইংরেজি শিক্ষিতরা তা মেনেও নিলেন - কোন প্রশ্ন না করে, এই শাসন ব্যবস্থা দেশের সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করল; চিন থেকে সেন্ট হেলেনা পর্যন্ত বিপুল ভৌগোলিক এলাকা সেই সম্পদে শাসিত হল আর প্রভূত বাড়তি নানান সম্পদ নিজের দেশে নিয়েগেল। এছাড়া ভারতে তারা নতুন শহর এবং প্রভূত সেনা ছাউনি তৈরি এবং তার ব্যবস্থাপনা করল এবং (এবং স্বাধীনতার পর এই ব্যবস্থা আমরা সেধে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এলাম) সেটাই ভারতের বড় আভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এই অব্যবস্থা, দারিদ্র্য এবং উপনিবেশিকতা কিন্তু মোট রাজস্ব আদায়ের ওপর প্রভাব ফেলল না। সমগ্র ভারতকে যেন স্থাণুবৎ করে দেওয়া হল। এবং শিক্ষিতরা যে গবেষণা করলেন সেটি এই দারিদ্র্য বজায় রাখতে সাহায্য করল এবং সারা দেশে এই দারিদ্র্য মহামারীর মত ছড়িয়ে গেল।
কৃঃ আমাদের ভারতে এমন কিছু নীতি অনুসরণ করতাম, যা শাসককে একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করতে দিত না।
ধঃ মহাভারতে বলা হয়েছে, যে রাজা তার প্রজাদের রক্ষা করতে পারে না, যে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করে, এবং তাঁদের সম্পদ হরণ করে সেই রাজাকে হত্যা করতে জনগণ একতাবদ্ধ হবে। সেই রাজা কলিরূপে চিহ্নিত হবে। এই রাজাকে মত্ত কুকুরের মত হত্যা করতে হবে।
কৃঃ কিন্তু আমাদের বহু রাজা সাক্ষাৎ কলি ছিলেন...
ধঃ ঠিক। আমরা রাজনৈতিক তত্ত্বের আলোচনা করছি। কিন্তু প্রাতীচ্যে তত্ত্বগতভাবে রাজা কিন্তু চরম ক্ষমতার আধিকারী ছিলেন।
কৃঃ কিন্তু এদেশে রাজাই চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী, এই তত্ত্ব কিকরে শেকড় গজাতে পারল?
ধঃ হয়ত ব্রিটিশ শাসনের সময় যে সব রাজা রাজস্ব করেছেন, তাঁদের শাসন করার পদ্ধতিতে এই ধারণা চারিয়ে গিয়েছে।
কৃঃ জাতিভেদ সম্বন্ধে কিছু বলুন। আপনি নিশ্চই বলবেন না যে জাতিভেদ প্রথা ১৮০০ সালের পরে দেখা দিয়েছে। এটিকে যদি আমরা আমাদের পরম্পরা হিসেবে করি তাহলে আসুবিধা দেখা দেবে।
ধঃ ঠিক। জাতিভেদ ভারতের পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ বলে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে আমরা এলাম কি করে? গ্রামের মতই, প্রাচীন কাল থেকেই জাতি ব্যবস্থা ছিল। মুনুস্মৃতিতে সমাজকে চার বর্ণে ভাগ করা হয়েছে। এটি ভারতে আজ যেমন রয়েছে, তেমনি আতীত থেকেই ছিল। কিন্তু এটি ভারতের পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ, এই তত্ত্ব এর আগে দেওয়া হয় নি। প্রত্যেক বর্ণ এবং আদিবাসীরা বহুকাল ধরে পাশাপাশি বাস করে এসেছে, আলাপ আলোচনা করেছে, আবার লড়াইও করেছে। মনুস্মৃতিকে ভুল প্রমান করে বলা যায় ব্রিটিশ যখন ভারত শাসন করতে শুরু করল, তখন ভারতে বহ শুদ্র রাজা। এটাও হতে পারে জাত ব্যবস্থা ভারতের রাজনীতির দুর্বলতার কারণ। বা উলটো ভাবে বলা যায় হয়ত জাতির বিভিন্নতা ভারতীয় সমাজের জোরের কারণ। সেজন্য ভারত বহুকাল ধরে টিকেও রয়েছে। কেন জাতিভেদ ভারতের দুর্বলতার কারণ তার কোন সন্তোষজনক উত্তর আজও পাওয়া যায় নি।
ব্রিটিশ শাসনে জাতিভেদ বড় আসুবিধে হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারা এই ব্যবস্থাকেই বুঝতে পারে নি – এমন নয় যে তারা জাতিহীন সমাজ তৈরি করে সশক্ত ভারত গড়তে চেয়েছিল, বরং তারা জাতিভেদ নির্মূলন করে ভারত ভাঙতে চেয়েছিল। আমার মনে হয় ভারতীয় সমাজকে অণুকরণ(এটমাইজেশন) করা, শাসন করা এবং সারা ভারত জয় করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠল জাতির বিভিন্নতা। জাতিভেদ এবং জাতিভেদ নিয়ে যে ক্রোধ আজ ভারতীয় রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের দান।
ধঃ জ্যোতির্বিদ্যা আর অঙ্কই ধরুণ। বাংলার ব্রিটিশ সেনা প্রধান রবার্ট বার্কারের কথাই ধরুণ। পরে তিনি পার্লামেন্টেরিয়ানও হয়েছেন। তিনি বেনারসের মনমন্দির সম্পর্কে লিখেছেন। ১৮২৩ পর্যন্ত এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা মনে করত যে এটি বিশ্বের সেরা পাঁচটি মানমন্দিরের অন্যতম।১৭৯০ সালের এক প্রবন্ধে, অঙ্কবিদ এবং এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জন প্লেফেয়ার ফরাসী জ্যোতির্বিদ্যার ঐতিহাসিক বেইলির বইএর বিশদ আলোচনা করেন। এই সময় রুবেন বারো( Ruben Burrow) বাইনোমিয়াল থিওরেম প্রকাশনা করেন। লেফটানেন্ট জেন্টিল, প্রখ্যাত কাসিনির লেখা, কিভাবে তামিলেরা কাগজ কলম ছাড়া, কিছু ঝিনুক আর কিছু অঙ্কের নামতা ব্যবহার করে, গ্রহণের হিসেব করত তার বর্ণনা দিয়েছেন। কৃষি নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে।
১৮২০ সালের কর্নেল আলেকজান্ডার ওয়াকার মালাবার আর গুজরাটের কৃষি নিয়ে লেখেন। হলওয়েল, কিছু মাত্র সময়ে বাংলার সরকার ছিল। বাংলার বসন্তের টীকা দেওয়া নিয়ে বিশদে লিখেছেন। ১৮০২-৩ সালে ব্রিটিশেরা ভারতীয় পদ্ধতিতে টিকা দান নিষিদ্ধ করে। হ্যালকট দক্ষিণের ড্রিলপ্লাউ নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। তার মন্তব্য ছিল এটি খুব সাধারণ অথচ কার্যকর। তিনি লিখছেন তার ধারণা ছিল না এটি ভারতীয় প্রযুক্তি। এছাড়াও ঊজ নামক ভারতীয় ইস্পাত তৈরির বর্ণনা পেশ করেছেন ব্রিটিশরা। ড। হেলেনিয়াস স্কট তাঁদের(সাম্রাজ্য) যতগুলি ইস্পাতের সঙে পরিচিতি রয়েছে, এটি সবকটির থেকে উত্তম। এছাড়াও বরফ তৈরি, কাগজ তৈরি এবং মর্টার তৈরি নিয়েও বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
কৃঃ কিন্তু বহু ব্রিটিশ ভারতের জনগণকে গরীব, দরিদ্র্য, অজ্ঞ বলে বর্ণনা করেছেন।
ধঃ আদতে আষ্টাদশ শতকে ভারতে আসা প্রায় সব সিভিলিয়ানদের এই মানসিকতা ছিল। ব্রিটেনের সেই সময়ে নির্দিষ্ট হায়ার্কিক্যাল স্ট্রাকচার ছিল, আইনি ব্যবস্থা এবং বংশ, কুল, পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থের জোরে কিনতে পারা যায় এমন পদমর্যাদার সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। সেই তুলনায় সাধারণ কিন্তু জীবন্ত ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় দৃশ্যত মিলেমশে থাকার যে পরিবেশ গড়ে উঠেছিল, বা অর্থ অনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা, পরিকাঠামো বা জমির যৌথ মালিকানা ইত্যাদি ব্রিটিশদের চোখে ঢিলেঢালা এবং সম্পদহীন সমাজের প্রতিফলন।
১৮১৩ সালের ভারতবর্ষীয়দের বিষয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে আলোচনা হয়, তাতে এতদিনের লুঠ, অত্যাচারের পরেও ভারতীয় সমাজে যে ধরণের জ্ঞানের বহিপ্রকাশ হয়, যেভাবে মানুষে মানুষে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে, যেভাবে তাঁরা সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে তা নিয়ে বেশ কিছু পার্লামেন্টারিয়ান উল্লেখ করেছেন। আদতে উনবিংশ শতকে উইলবার্ফোর্সএর মত তাত্ত্বিকেদের মত এই মনোভাবের জন্য দায়ি। তিনি বলেন গ্রিস যতদিন খ্রিষ্ট ধর্মে মতি পেশ করেনি ততদিন তাঁরা গরীব ছিল। ভারতেরও একই অবস্থা। যতদিন না তাঁরা খ্রিস্টের অনুগামী না হচ্ছে তাঁদের অবস্থা পাল্টাবে না।
আমার মতে ভারতীয়দের অজ্ঞ, মুর্খ, গরীব ইত্যাদি বলার পিছনে যুক্তি ছিল, ভারতের ধর্ম ব্যবস্থা। ভারতীয়রা অনেক বেশি ধার্মিক। আদতে ভারতকে আর্থ-সামাজিকভাবে গরীব, পিছিয়েপড়া হিসেবে দেখানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে ১৮০০ সালের পর থেকে। কেন্দ্রিভূত ব্রিটিশ রাজনীতি, সম্পদ সংগ্রহ নীতি আর শাসনপদ্ধতি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল - ইংরেজি শিক্ষিতরা তা মেনেও নিলেন - কোন প্রশ্ন না করে, এই শাসন ব্যবস্থা দেশের সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করল; চিন থেকে সেন্ট হেলেনা পর্যন্ত বিপুল ভৌগোলিক এলাকা সেই সম্পদে শাসিত হল আর প্রভূত বাড়তি নানান সম্পদ নিজের দেশে নিয়েগেল। এছাড়া ভারতে তারা নতুন শহর এবং প্রভূত সেনা ছাউনি তৈরি এবং তার ব্যবস্থাপনা করল এবং (এবং স্বাধীনতার পর এই ব্যবস্থা আমরা সেধে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এলাম) সেটাই ভারতের বড় আভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এই অব্যবস্থা, দারিদ্র্য এবং উপনিবেশিকতা কিন্তু মোট রাজস্ব আদায়ের ওপর প্রভাব ফেলল না। সমগ্র ভারতকে যেন স্থাণুবৎ করে দেওয়া হল। এবং শিক্ষিতরা যে গবেষণা করলেন সেটি এই দারিদ্র্য বজায় রাখতে সাহায্য করল এবং সারা দেশে এই দারিদ্র্য মহামারীর মত ছড়িয়ে গেল।
কৃঃ আমাদের ভারতে এমন কিছু নীতি অনুসরণ করতাম, যা শাসককে একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করতে দিত না।
ধঃ মহাভারতে বলা হয়েছে, যে রাজা তার প্রজাদের রক্ষা করতে পারে না, যে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করে, এবং তাঁদের সম্পদ হরণ করে সেই রাজাকে হত্যা করতে জনগণ একতাবদ্ধ হবে। সেই রাজা কলিরূপে চিহ্নিত হবে। এই রাজাকে মত্ত কুকুরের মত হত্যা করতে হবে।
কৃঃ কিন্তু আমাদের বহু রাজা সাক্ষাৎ কলি ছিলেন...
ধঃ ঠিক। আমরা রাজনৈতিক তত্ত্বের আলোচনা করছি। কিন্তু প্রাতীচ্যে তত্ত্বগতভাবে রাজা কিন্তু চরম ক্ষমতার আধিকারী ছিলেন।
কৃঃ কিন্তু এদেশে রাজাই চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী, এই তত্ত্ব কিকরে শেকড় গজাতে পারল?
ধঃ হয়ত ব্রিটিশ শাসনের সময় যে সব রাজা রাজস্ব করেছেন, তাঁদের শাসন করার পদ্ধতিতে এই ধারণা চারিয়ে গিয়েছে।
কৃঃ জাতিভেদ সম্বন্ধে কিছু বলুন। আপনি নিশ্চই বলবেন না যে জাতিভেদ প্রথা ১৮০০ সালের পরে দেখা দিয়েছে। এটিকে যদি আমরা আমাদের পরম্পরা হিসেবে করি তাহলে আসুবিধা দেখা দেবে।
ধঃ ঠিক। জাতিভেদ ভারতের পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ বলে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে আমরা এলাম কি করে? গ্রামের মতই, প্রাচীন কাল থেকেই জাতি ব্যবস্থা ছিল। মুনুস্মৃতিতে সমাজকে চার বর্ণে ভাগ করা হয়েছে। এটি ভারতে আজ যেমন রয়েছে, তেমনি আতীত থেকেই ছিল। কিন্তু এটি ভারতের পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ, এই তত্ত্ব এর আগে দেওয়া হয় নি। প্রত্যেক বর্ণ এবং আদিবাসীরা বহুকাল ধরে পাশাপাশি বাস করে এসেছে, আলাপ আলোচনা করেছে, আবার লড়াইও করেছে। মনুস্মৃতিকে ভুল প্রমান করে বলা যায় ব্রিটিশ যখন ভারত শাসন করতে শুরু করল, তখন ভারতে বহ শুদ্র রাজা। এটাও হতে পারে জাত ব্যবস্থা ভারতের রাজনীতির দুর্বলতার কারণ। বা উলটো ভাবে বলা যায় হয়ত জাতির বিভিন্নতা ভারতীয় সমাজের জোরের কারণ। সেজন্য ভারত বহুকাল ধরে টিকেও রয়েছে। কেন জাতিভেদ ভারতের দুর্বলতার কারণ তার কোন সন্তোষজনক উত্তর আজও পাওয়া যায় নি।
ব্রিটিশ শাসনে জাতিভেদ বড় আসুবিধে হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারা এই ব্যবস্থাকেই বুঝতে পারে নি – এমন নয় যে তারা জাতিহীন সমাজ তৈরি করে সশক্ত ভারত গড়তে চেয়েছিল, বরং তারা জাতিভেদ নির্মূলন করে ভারত ভাঙতে চেয়েছিল। আমার মনে হয় ভারতীয় সমাজকে অণুকরণ(এটমাইজেশন) করা, শাসন করা এবং সারা ভারত জয় করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠল জাতির বিভিন্নতা। জাতিভেদ এবং জাতিভেদ নিয়ে যে ক্রোধ আজ ভারতীয় রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের দান।
No comments:
Post a Comment