জগদীশ নারায়ণ সরকার
৫। পূর্ব পাড় থেকে সুজাকে তাড়িয়ে দিলেন মীর জুমলা
পালাতে থাকা সুজাপন্থী সেনানায়ক খ্বোয়াজা মিশকি শত্রুপক্ষের হাত থেকে সমধের বড় চর রক্ষার জন্য ঘাঁটি গেড়ে বসলেন। চারদিকে জলে ঘিরে থাকা এই চরটি মোটেই সুরক্ষিত নয়। অথচ এই চরটি সুজার বিরুদ্ধে আসা আক্রমণকারীদের আক্রমণ রোখার শেষতম স্থল। এটি হারানোর অর্থই হল তাণ্ডার উদ্দেশ্যে দাউদের অভিযানের রাস্তা খুলে দেওয়া এবং সেখানে রাখা সম্পদ এবং সুজার পরিবারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা। উদ্বিগ্ন হয়ে সুজা যুদ্ধ সমিতির বৈঠক ডাকলেন। মিশকির হাত শক্ত করতে চরে বাহিনী পাঠানোর অর্থ বর্তমান যুদ্ধ এলাকায় যুদ্ধদক্ষ সেনা হারানো এবং মীর জুমলার হাতে নিশ্চিত পরাজয় বরণ। তাই সেই মুহূর্তে মীর জুমলার প্রতি সরাসরি আক্রমন না করে ঠিক হল সৈন্য নিয়ে সুজা মালদার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন, সমধের সুরক্ষা নিশ্চিত করে দাউদের অভিযান রুখবেন। দীর্ঘকালীন দৃষ্টিতে আন্দাজ করা হল, বর্ষা কালে পূর্ব পাড়ের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না এবং বর্ষার শেষের আগেই তিনি ফিরে এসে আবার সম্রাটের বাহিনীর মহড়া নিতে পারবেন। শাহজাদার পরামর্শে তার অবর্তমানে সুজা তার বাহিনীর পিছনের অংশটা হাতির বাহিনীর দ্বারা সুরক্ষিত করার পরিকল্পনা করলেন এই হুঁশিয়ারি দিয়েই, যারা পালাবার কথা ভাববে তাদের পরিবারকে মেরে ফেলা হবে এবং পারিবারিক সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হবে। শত্রু যদি এগিয়ে আসে তাহলে কামান দিয়ে তাদের আগ্রগমণ রোধ করা হবে। ২৬ ডিসেম্বরের নসিপুরে গিয়ে সুজা ভাগীরথী পার হলেন তাণ্ডার পথে যেতে সুতি পার হলেন।
কারাওয়াল(চর)দের থেকেই সুজার পশ্চাদপসরণের খবর পেয়ে মীর জুমলা প্রতিআক্রমনে গেলেন। গিরিয়ার অভিজ্ঞতায় তিনি প্রত্যেককে হুঁশিয়ারি দিলেন, যারা ভয়ে পিছনে থেকে যাবে তাদের জন্য কফিনের দরজা খোলা রইল। ২৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় তিন মাইল এগিয়ে তিনি বাঙলার সুবাদারকে দেখলেন একটি কাদাওয়ালা জমিতে নালার পিছনে দাঁড়িয়ে তার দুপাশে কামান সাজিয়ে রেখেছেন। এই ধরণের হাওর এলাকায় মীর জুমলার অগ্রগমণ সম্ভব ছিল না। সন্ধ্যে পর্যন্ত আক্রমনের পরিকল্পনা মুলতুবি রেখে আর এগোলেন না, শিবিরে ফিরে এলেন। সম্রাটের রসদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ২৮ ডিসেম্বর সুজা পালালেন। সকালে সেনাপতিরা দক্ষভাবে নালাটা আর হাওর পেরিয়ে গিয়ে সুজার পিছু নিলেন। চরেরা খবর আনল সুজা তরতিপুরে ফেরি পার হবেন। দুমাইল এগোনোর খবর পেলেন, (এটি ভুল তথ্য) সুজা সুতির দিকে যাচ্ছেন। ইখলাস খান এটি জাচাই করে দেখার পর মীর জুমলা নিজে পলাতক শাহজাদার পিছন ধরলেন। পাঁচ মাইল গিয়ে তিনি ফতেপুরে বিশ্রাম নিলেন। মহম্মদ মুরাদ বেগের কামান বাহিনী রাতে এল। পরের দিন সকালে সুতি পেরিয়ে আধ মাইল গিয়ে চিলমারিতে সুজার মুখোমুখি হলেন মীর জুমলা।
সন্ধ্যে পর্যন্ত গোলান্দাজি করলেন সুজা। সম্রাটের বাহিনীর উদ্দেশ্যে আবদুল মজিদ ডেকানি, পীর মহম্মদ উইঘুর এবং অন্যান্যদের নেতৃত্বে ১০০ জনের একটি ডাকাবুকো বাহিনী তরোয়াল হাতে সুজার বাহিনীর ডানদিকের দেওয়াল ভেদ করে ঢুকে গেল। রাত একটা নাগাদ যুদ্ধ শেষ হল। সুজার পক্ষে আর জেতা নয় বুঝে নুরুল হাসান মীর জুমলার বাহিনীতে যোগ দেন। সুজা বুঝলেন যে তার পক্ষে আক্রমন আর গোলান্দাজি সমানতালে শানানো সম্ভব নয়। মীর জুমলার চেষ্টা হল সেখান থেকে সুজা যাতে নদী পার না হতে পারেন সেটা লক্ষ্য রাখা।
রোজ হাতাহাতির অসংখ্য ঘটনা ঘটতে লাগল। সেখানে নদী পার হওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে সুজা ১ জানুয়ারি ১৬৬০ সালের রাতে উত্তরে দুনাপুরের(দানাপুর?) দিকে পালানোর পরিকল্পনা করলেন। প্রচুর নালা পেরিয়ে নালার ওপর তৈরি সেতু ভেঙ্গে দুনাপুর থেকে দোগাছিতে পালালেন বিপক্ষের দেরি করিয়ে দেওয়ার রণনীতি নিয়ে। মীর জুমলা তার পিছনে পড়ে রইলেন কিন্তু হাওর, নালা আর ভাঙা সেতু তার অগ্রগতি রোধ করছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় দুনাপুরে মীর জুমলা বাহিনী আর গোলান্দাজি বাহিনীকে নালা পেরোতে হয় সেটি কাদা দিয়ে বুজিয়ে এবং খুব ধীরে ধীরে সেই পথে কামানগুলি পার করা হয় সেতু তৈরি করে। এখানে সুজার ছেড়ে যাওয়া কিছু নৌকো, গোলাবারুদ, ১০টি কামান ২০০টি হাউই উদ্ধার করলেন।
দেওগাছিতে মীর জুমলা আত্মরক্ষায় পরিখা কাটলেন। সুজা এর আগে যে সফল যুদ্ধ নীতি নিয়েছিলেন সেটি এবারেও অনুসরণ করার চেষ্টা করতে চাইলেন – দেওগাছি আর গিরিয়ার উল্টোদিকের চর দখল করা। তার বাহিনীকে অযথা গোলা বারুদ নষ্ট না করতে লুকিয়ে থাকতে নির্দেশ দিলেন তিনি, যদি শত্রুরা আক্রমণ করে তাহলেই জবাব দিতে। বিপক্ষের বিচক্ষণ সেনাপতি এই ধরণের চালাকিতে পা দিলেন না, কেননা এই খবরটি তিনি আগেই কারাওয়ালাদের থেকেই পেয়েগিয়েছিলেন। যেহেতু গোলান্দাজিতে তিনি সুজার তুলনায় পিছিয়ে রয়েছেন, সেহেতু সঠিক নজর না করে তিনিও জবাব দিতে উতসুক হলেন না। ফতে জং এবং ইসলাম খান খোঁজ খবর না নিয়ে পথপ্রদর্শকদের নিয়ে দেওগাছির নালার কাছে চলে যায়। সুজার বাহিনী হঠাতই গোলা বর্ষণ শুরু করাতে তারা আর এগোতে পারেন না।
ফিদায়ি খান এবং জুলফিকারকে সঙ্গে নিয়ে মীর জুমলা চাপ দিতে শুরু করলেন এবং চেষ্টা করলেন যদি সুযোগ আসে তো তিনি নালাটা পার হয়ে শুধুই সংখ্যাধিক্যে বিপক্ষের ওপর আক্রমন করার চেষ্টা করবেন এবং পালাবার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু বিপক্ষের গোলান্দাজিতে এই আগ্রগমণ সম্ভব হয় না। তার হাল্কা কামান নিয়ে মীর জুমলা ভারি গোলান্দাজির বিরুদ্ধে দিনের শেষ থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত লড়ার যথাযাধ্য চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু প্রচুর ক্ষতি হয়। এতদ সত্ত্বেও মীর জুমলা আক্রমণের ঝাঁঝ বজায় রাখেন শত্রুকে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেন না, এবং কোন সুযোগ এলে সেটাও তিনি ছেড়ে দেন নি।
প্রতিদ্বন্দ্বীর গুরুতর আক্রমণের বিরুদ্ধে মীর জুমলার জোরদার প্রতিরোধ সুজাকে এতই হতোদ্যম করে দেয় যে, সে দাঁতে নখ কাটতে শুরু করে।
মীর জুমলার পক্ষে ভারি কামান এসে গেলে সেগুলিকে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে যথাযোগ্যভাবে কাজে লাগাবার উদ্যম নেন তিনি এবং সেগুলি সুজার বাহিনীর পক্ষে ঘাতক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে হাতাহাতি লড়ায়ের দিন শেষ। মাঝরাতে সুজার গোলান্দাজি বন্ধ হল। মীর জুমলাও বন্ধ করলেও কামানের মুখ শত্রু শিবিরের দিকে তাক করে রাখেন।
২ জানুয়ারি সুজা পূর্ব পাড়ে এবং মীর জুমলা তাকে অনুসরণ করে নালার পশ্চিম পাড় ধরে রাজমহলের দিকে অগ্রসর হলেন। সুজা চিন্তিত হলেন। তীরে শত্রু, ফলে নদী পার হওয়া খুব কঠিন কাজ হল। তিনি যদি নিজে সেনার আগে পার হওয়ার চেষ্টা করেন তাহলে তাকে তার বাহিনী চেড়ে চলে যাবে, আর যদি তার আগে সেনা নদী পার হয়, তাহলে তারা শত্রুর হাতে গ্রেফতার হওয়ার ভয় থাকবে। সুজা এখন তার শিবির ঘিরে গভীর পরিখা কেটে সেখানে কামানের সারি বসিয়ে দিলেন। মহম্মদ সুলতানের মতিগতি তার সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাকে তিনি তাণ্ডায় পাঠিয়ে দিলেন। সুজা নৌকো সেতু গড়ার চেষ্টা করলে মীর জুমলা তার দিকে বৃথা গোলা ছুঁড়তে লাগলেন। ৯ জানুয়ারি ১৬৬০, সেই সেতু করে সুজা নদী পার হয়ে গেলেন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment