Saturday, January 28, 2017

গুরু তর্পণ - উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা ধরমপালজীর সাক্ষাতকার২

কৃঃ অন্য একটা প্রশ্ন করি। ব্রিটিশের পক্ষে কেন এই দেশে উপনিবেশ করা সহজ হয়ে পড়ল? ব্রিটিশ-পূর্ব সমাজের কোন দিকটি এর জন্য দায়ী?
ধঃ একটা কথা বলে রাখি ব্রিটিশ পূর্ব ভারতীয় সমাজে জোরের বা ভঙ্গুরতার যায়গাগুলি আমি সত্যিই জানি না। আমার জ্ঞান অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ পূর্ব সমাজ নিয়ে এবং তাও অধিকাংশ ব্রিটিশ এবং অন্যান্য তথ্য থেকে আহরিত। এই বিষয়ে মন্তব্য করার আগে ব্রিটিশপূর্ব সমাজ সম্বন্ধে আর বহু তথ্য জানা প্রয়োজন। আমি শুধু বলতে পারি ১৭০০ সাল নাগাদ মুঘলদের কেন্দ্রিয় পকড় শিথিল হয়ে পড়ল। এর ফলে বহু স্থানীয় রাজা মহারাজা নবাবেরা তাঁদের নিজেদের অঞ্চলে আধিকার বজায় রাখতে শুরু করলেন। এদের মধ্যে রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল না। ফলে ফরাসিদের মত ইওরোপিয় শক্তি তাঁদের মধ্যে আপাত বিচ্ছিন্নতার সুযোগে তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার করার কাজ শুরু করে। শেষে যখন ব্রিটিশেরা শক্তি সঞ্চয় করে আঘাত হানতে থাকে তখন তাঁদের আর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ হয় নি।
কৃঃ আদতে কি ভারতীয় সামন্ততন্ত্র নব্য পুঁজিবাদের এই আঘাতকে ঠেকাতে পারে নি...
ধঃ জানি না আমাদের সামন্ততন্ত্র ছিল কি না। এই ধরণের সিদ্ধান্ত করে ফেলার সময় আমাদের সমাজিক সঙ্গঠন(সোসাল অর্গানাইজেশন) নিয়ে বেশ কিছু ইওরোপকেন্দ্রিক উপপাদ্য ভেবে ফেলা হয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, যখন কেউ মুঘলদের কেন্দ্রিয় শক্তির কথা বলেন, তখনই একটা কেন্দ্রিভূত রাষ্ট্র ধারণা এবং তৎসংক্রান্ত বেশ কিছু উপধারণা তৈরি করে নেন। নাতিদের লেখা ঔরঙ্গজেবের একটী চিঠি আমি দেখেছি। তাতে দুটো বিষয় বলা হয়েছে, ১। জাহাঙ্গীরের সময় রাজস্ব দপ্তর সারা ভারত থেকে ৬০ লাখ টাকা তুলত, আর ব্যয় হত দেড় কোটি টাকার কাছাকাছি। ফলে যে বিপুল ঘাটতি থাকত তা আকবরের সঞ্চয় থেকে পূরণ হত। ২। শাহজাহান জাহাঙ্গীরের উদাহরণ অনুসরণ করেন। তিনি দেড় কোটি টাকা তুলতেন। এবং খরচ কমিয়ে আনেন এক কোটি টাকায়। কিন্তু মুঘলদের রাজত্বে প্রথম দিকে মোট রাজস্ব ছিল ১০ কোটি টাকা, পরের দিকে কুড়ি কোটি টাকা। হিসেব বলছে সম্রাট তার রাজত্বের ন্যুনতম রাজস্ব নিতেন, তাহলে বাকি রাজস্বের কি হত? আমার ধারণা ঐতিহাসিকেরা স্বীকার করেছেন যেঔরঙ্গজেব রাজস্বের ২০ শতাংশ নিতেন। ফলে ধরে নেওয়া হয় বাকি আশি শতাংশ রাজস্ব সামন্তরা নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিতেন।
আমার সিদ্ধান্ত অন্যরকম। এই বিপুল পরিমান রাজস্ব স্থানীয় অঞ্চলে থাকত। এই সম্পদ স্থানীয় রীতিনীতি পুষ্ট করার কাজ করত – যেমন পাঠশালা, চাত্রম, বিদ্যালয়, পুকুর, সেচ ব্যবস্থা, মন্দিরের জন্য এবং অন্যান্য ধর্মীয় কাজে ব্যয়, জ্ঞনাক, বৈদ্য, কবি, জ্যোতিষ, জাদুকর ইত্যাদিদের মধ্যে বেঁটে দেওয়া হত। এটি আসলে বেশ পুরোনো ব্যবস্থা যা মুঘল শক্তিকেও বজায় রাখতে হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ সময়ে পুরো ব্যবস্থা পালটে গেল। তারা ধাপে ধাপে মোট উৎপাদনের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ রাজস্ব হিসেবে কেড়ে নিতে শুরু করল। তার ফল এখন ফলছে। গ্রামে যে উদবৃত্ত থাকত, তা শুষে নিয়ে চলে গেল বিদেশে। ফলে যে পরিকাঠামো তৈরি হয়েছিল কয়েক হাজার বছর ধরে তা ভেঙ্গে পড়ল তাসের ঘরের মত।
কৃঃ ব্রিটিশ এক কাজ জেনেশুনে করেছিল?
ধঃ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষে যা স্বাভাবিক তাই তারা করেছে। তাঁদের দেশে তারা কৃষকদের থেকে ৫০ শতাংশের বেশি রাজস্ব নিত। ফলে তাঁদের সিদ্ধান্ত ছিল যে শাসক যে জমি তার(নিজেদের দেশেই তারা সবার আগে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল)। সেই তত্ত্ব ব্রিটিশ এদেশে এসে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিল। তারা এটা শুধু ভারতের জন্য করেছে বললে অপলাপ হবে। তারা বিশ্বে যেখানে যেখানে গিয়েছে সেখানেই একই কাজ করেছে। ব্রিটিশ শাসকেরা মনে করত এটাই স্বাভাবিক কাজ। কেননা তাঁদের সমাজ আর রাষ্ট্র সম্বন্ধে যে ধারণা তা কেন্দ্রিভূত এক সমাজের। এই ধারণা ১০০০ বছর ধরে ব্রিটেনে রয়েছে। এ তত্ত্ব পুঁজিবাদের গর্ভগৃহ থেকে জন্ম হয় নি। উদাহরণস্বরূপ, ১১০০ সালে নর্মানেরা যখন ব্রিটেন দখল করল, তখন থেকেই রাজস্বে ৯৫ শতাংশের বেশি সম্পদ রাজা, চার্চ এবং নতুন সামন্তরা ভাগ করে নিত।

No comments: