জগদীশ নারায়ণ সরকার
৭। মীর জুমলার রাজমহল দখল
বীরভূমের জমিদারের বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে সাম্রাজ্যের বাহিনীর অগ্রগতির সংবাদ পেয়ে সুজা রাঙ্গামাটি ছেড়ে রাজমহলের দিকে চললেন। এখানে তিনি কিছুদিন আগেই শিবির ফেলেছিলেন। মীর জুমলার নেতৃত্বে বাহিনী সুজার ঢাকা পালিয়ে যাওয়ার পথ রোধ করতে উখরা থেকে উত্তর-পূর্বের দিকে মুর্শিদাবাদের গঙ্গা ধরে সুজার বর্তমানের অবস্থানের ৩০ মাইল কাছে বেলঘাটায় পৌঁছনোয় সুজার দোদুল্যচিত্ত সন্দিহান সঙ্গীরা একে একে তাঁকে ছেড়ে যেতে শুরু করে। সুজার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার দুটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সুজার বন্ধুরা দেখলেন, বিপুল পরিমান সাম্রাজ্যের বাহিনীর হাতে কচুকাটা হওয়া এবং অথবা অসভ্য আরাকানের দিকে পালিয়ে যাওয়া।
গঙ্গার পর পাড়ে মীর জুমলার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যের বাহিনী শিবির গড়ার খবরে সুজা তাঁর দিকের(পশ্চিম) তীরটিকেও নিরাপদ মনে করলেন না। আলিবর্দি খানের এবং তাঁর নিজের বাহিনী মিলিয়ে যেহেতু ৫-৬ হাজার থেকে খুব বেশি হলে ২০ হাজারের বেশি হবে না, ফলে বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্তে যে বাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। সেনাপতিদের দলের প্রধান মির্জা জান বেগ, যার পদবী খান জামানএর পরামর্শক্রমে সুজা তাঁর শিবির তুলে নিয়ে এলেন তাণ্ডায়, গৌড়ের চার মাইল পশ্চিমে(যেখানে তাঁর নিরাপত্তার জন্য একদিকে রয়েছে গঙ্গা আর অন্যদিকে প্রচুর নালার সমাহার) সাম্রাজ্যবাদী সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে এবং নতুন করের নৌবাহিনী তৈরি করে নিজের কমতে থাকা ক্ষমতাকে নতুন করে গড়ে তোলা। আদতে সুজা এই যুদ্ধটা নতুন করে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে চাইলেন নৈবাহিনী এবং গোলান্দাজদের সম্বল করে। ১৬৫৯ সালের ৪ এপ্রিল সুজা রাজমহল ছেড়ে ১৩ মাইল দক্ষিণে দেওগাছিতে গঙ্গা পার হলেন, এবং তাণ্ডায় আসতে তাঁর পরিবার নিয়ে ফিরোজপুরে এলেন। গঙ্গাজুড়ে নৌবাহিনী এবং পরিখা তৈরি করতে আলাপালোচনা শুরু করলেন।
সুজার রাজমহল ত্যাগের সঙ্গবাদ পৌঁছল বেলঘাটায় মীর জুমলার শিবিরে। তাঁর ছেড়ে যাওয়া এলাকা দখল করতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তরের দিকে অভিযান করলেন। ১৩ এপ্রিল তিনি একটি রথে জুলফিকার খান, এবং শাহজাদাকে নিয়ে রাজমহল প্রবেশ করে সেখানকার প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করলেন ৫০০০ বাহিনী নিয়ে জুলফিকার খানকে। তাঁর সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে দিলেন সৈয়দ ফিরোজ খান, জবরদস্ত খান, রাজা ইন্দ্রদুম্ন এবং দেবী সিংহ। সুজার সেনাবাহিনীর ৪০০০ সেনা তাঁর সঙ্গে গঙ্গা পেরোতে পারে নি, তাঁরা রাজমহলে ফিরে এলে নতুন প্রশাসনে তাদের নিয়ে নেওয়া হয়। আলমগীরনামায় বলা হয়েছে, ছেড়ে যাওয়া এই শহরে তখনও সুজার আধিকারিক এবং তার বাহিনীর নানান ধরণের জিনিসে পরিপূর্ণ ছিল। এবং সুজার বাহিনীকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয় যে তারা এই শহর লুঠের চেষ্টা করবে না। সম্রাটের নির্দেশে এতবর খানের তত্ত্বাবধানে তিন বছর ধরে এই শহরের নিরাপত্তাবিধান করা হয়। রাজমহল থেকে হুগলী পর্যন্ত গঙ্গার ডানদিকের তীরের সমগ্র এলাকাটা মীর জুমলা দখল করে নিলেন। ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা তাকে বাঙলার নবাব বলেই মেনে নিল।
তৃতীয় পর্ব
গঙ্গায় যুদ্ধ
১। নতুন যুদ্ধ পরিবেশে মীর জুমলার সমস্যা
গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে সুজা চলে যাওয়ায় যুদ্ধ এক নতুন স্তরে উন্নীত হল। এত দিন ধরে যুদ্ধ স্থলে হচ্ছিল, ফলে তাঁর পদাতিক বাহিনীর পরিমান বাহুল্যে তিনি সুজাকে টেক্কা দিচ্ছিলেন, নিজের নেওয়া অভিনব পরিকল্পনায় সুজাকে বার বার মাত করে দিচ্ছিলেন। ফলে সুজা একদিনও সাম্রাজ্যের বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি হতে সাহস পান নি। কিন্তু মাঝখানে গঙ্গা দুটি বাহিনীকে দুভাগে ভাগ করে দেওয়ায় এখন তাঁর শত্রুদলের থেকে কিছুটা হলেও সুজা রণনীতিতে এগিয়ে রইলেন। প্রথমত বাঙলা নদীমাতৃক দেশ। এখানে বিপুল সংখ্যক নৌবাহিনী রয়েছে। সুজা প্রচুর সাধারণ এবং ডিঙ্গি যুদ্ধ ডিঙ্গি (ফ্লোটিলা) যেমন দখল করলেন তেমনি যাতে অন্যগুলি শত্রুপক্ষের কবলে না পড়ে, তাঁর জন্য তিনি তারও বেশি ডিঙ্গি জলযান ডুবিয়ে পুড়িয়ে দিলেন। উল্টোদিকে মীর জুমলার বাহিনীতে শুধু রয়েছে স্থলে যুদ্ধ করার মত পদাতিক বাহিনী, ব্রিটিশদের ভাষায় ‘উড়ন্ত বাহিনী’। তিনি সঙ্গে নৌসেনা যেমন আনেন নি, তেমনি সুজা যেহেতু তাঁর আগে থেকেই বহু নৌকো দখল এবং ডুবিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে পোড়ামাটির নীতি নিয়ে, সেহেতু তাঁর পক্ষে নতুন করে নৌবাহিনী তৈরি করা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। তাঁর সমস্ত উদ্যম মার খেল যেহেতু তাঁর সঙ্গে কোন নৌ বাহিনী নেই। এছাড়াও তার সঙ্গে বলা মত কোন গোলান্দাজ বাহিনীও ছিল না – তিনি খ্বোয়াজা থেকে মাত্র ৮টা কামান এনেছিলেন সঙ্গে(তাড়াতাড়ি সুজাকে ধরবেন এই রণনীতিতে)। উল্টোদিকে সুজার বাহিনীতে জোরদার ইওরোপিয় গোলান্দাজ বাহিনী ছিল; বিশেষ করে পর্তুগিজদের এবং হুগলী, তমলুক এবং নোয়াখালির দোআঁশলা(মেস্টিকো) গোলান্দাজদের নেতৃত্বে। বিপুল বেতন এবং সুখদ ভবিষ্যতে স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁর বাহিনীতে হাজারো এই ধরণের গোলান্দাজে ভর্তি করান। এই গোলান্দাজেদের অধিকাংশ ডাচেদের হাতে জাফনাপাটন এবং শ্রীলঙ্কা থেকে উতখাত হয়ে ফেরা বাহিনী। তাণ্ডাতে তাঁবু ফেলে বিপুল যুদ্ধ ডিঙ্গি এবং গোলান্দাজ বাহিনী সম্বল করে সুজা সাম্রাজ্যের বাহিনীর ওপর পারের তীরে রাজমহল থেকে বাকারপুর, ফিরোজপুর থেকে সুতি পর্যন্ত এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেললেন। সুজার হাতে থাকা কামান আর যুদ্ধ নৌকো দুয়ে মিলে বিপুক্ষের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠল, যেহেতু গোলান্দাজ বাহিনীকে আর এক জায়গায় বসিয়ে রাখার প্রয়োজন হল না, গোলান্দাজেরা জলে এখন ভেসে বেড়িয়ে যুদ্ধ করতে পারে। খুব কম স্থল বাহিনী নিয়ে তিনি মীর জুমলার মুখোমুখি হতে না পারলেও নৌযুদ্ধে তিনিই সেরা প্রমানিত হলেন। এবং বাঙলার ভৌগোলিক অবস্থা তাকে বিপক্ষের ওপর খবরদারির সুযোগ করে দিল। সুজার রণনীতিতে মীর জুমলার বিশাল বিপুলাকায় বাহিনীর অগ্রগতি থমকে গেল, তাঁর দুঃস্বপ্নের দিন বেড়েই চলল গুণোত্তর প্রগতিতে। বালেশ্বরের কুঠিয়ালেরা মীর জুমলার রণনীতি জানতে পারেন নি, তাদের নিদান ছিল (৩০ এপ্রিল ১৬৫৯) এই বছরে যদি মীর জুমলাকে যুদ্ধ জিততে হয়, তাহলে সেটি করতে হবে বর্ষার আগেই। কিন্তু এই লক্ষ্যটি পূরণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল মীর জুমলার নৌ এবং গোলান্দাজ বাহিনী অপ্রতুলতার জন্য। নৌসেনা অপ্রতুলতার জন্য তিনি পশ্চিম পাড় থেকে পূর্ব পাড়ে যেতে বিপুলাকায় গঙ্গাই পেরোতে পারলেন না। এমন কি মীর জুমলার হাত থেকে সুজার বাহিনী রাজমহল ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হল। ফলে শত্রু ধাওয়া করার সিদ্ধান্তে বাধ্য হয়ে ছেদ টানলেন।
মীর জুমলার রাজমহল দখল করার ১৩ এপ্রিল ১৬৫৯ থেকে ১২ এপ্রিল ১৬৬০ সুজা ঢাকায় প্রবেশ করার এই এক বছর আদতে মীর জুমলার বিফলতা এবং সুজার চমৎকার রণনীতির কাছে মীর জুমলার হারের সময়, যদিও শেষ পর্যন্ত মীর জুমলার রক্ষণ ভাঙতে সক্ষম হল সেনানী শ্রেষ্ঠ মীর জুমলা। এই নাটকটি তিন অঙ্কে সমাপ্ত হয়, মাঝে মধ্যে ভাগ্যলক্ষ্মী, ঢেঁকির মত কখনো এক পক্ষ কখনো অন্য পক্ষে ঢলে পড়তে থাকেন। প্রথম অঙ্কে সুজা গঙ্গায় আত্মরক্ষামূলক রণনীতি অনুসরণ করতে থাকেন এবং এটি শেষ হয় ১৬৫৯ সালের ৮ জুন শাহজাদা মহম্মদ সুলতান দল বদল করে সুজার দলে চলে যাওয়ার পর। দ্বিতীয় অঙ্ক অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিম পাড়ে সুজা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে রাজমহল দখল করে নেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি দখলে রাখতে পারেন নি। তৃতীয় অঙ্কে মীর জুমলা আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠেন এবং যুদ্ধের ঢেঁকির এবারে হেলে যায় পশ্চিম পাড়ের দিকে, তিন দিকে আক্রান্ত হয়ে উঠে সুজাকে পূর্ব পাড় চিরতরে ছেড়ে যেতে হয়।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment