Tuesday, January 31, 2017

বাংলার উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা১ বাংলায় মহিলাদের স্থান


উপনিবেশ পূর্ব বাংলায় মেয়েদের স্থান নিয়ে মোটামুটি একটা ঐক্যমত্য রয়েছে, বাংলার মেয়েরা অন্তঃপুরে বসবাস করতেন, পুরুষদের অনুগামী হতেন, তাঁদের সমাজ, সরকার চালানোয় খুব একটা বেশি ভূমিকা ছিল না। বিশেষ করে নবাবী পরিবারগুলোয় সরকার পরিচালনায়, হারেমে থাকা মেয়েদের পর্দার আড়ালে থাকতে হত। এ বিষয়ে ঔপনিবেশিক পণ্ডিতদের মধ্যে মোটামুটি মতৈক্য রয়েছে। অথচ, গুলবদনের হুমায়ুননামাকে, বা মুঘল আত্মচরিতগুলিকে নতুন করে দেখছেন রুবি লাল, কিভাবে ভাষা না জেনে এই অনুবাদগুলি করার বিষ ফল ফলেছে ইতিহাস রচনায় গত একশ বছরে - বিশেষ করে মেয়েদের স্থান নির্বাচন নিয়ে।
কিন্তু ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নানান কাজ এই ঔপনিবেশিক মিথ-মিথ্যেগুলি ছারখার করে দিচ্ছে। তিনি বলছেন এমন কিছু বিষয়, যা অন্তত বাংলায় ঔপনিবেশিক পাঠ্যক্রমে পড়ানো হয় না। তাঁর মুঘল বিদুষী এমনই এক পথভাঙা পুস্তক। তাঁর একটি ছোট বই রয়েছে যার নাম বেগমস অব বেঙ্গল। এই বইটি অবলম্বন করে উপনিবেশ পূর্ব রাজ্ঞীদের বিষয়ে কিছু লেখা প্রকাশ করা যাবে আজ ও আগামীতে।
আজ আলিবর্দী খাঁর স্ত্রী, সেরাজের মাতামহ সর্ফুন্নিসা
আলিবর্দি কাঁটার মুকুট মাথায় নিয়ে বাংলার তখতে বসলেন। ঔরঙ্গজেবের ‘পাহাড়ি ছুঁচো’ মারাঠারা দিল্লির নবাবের ফরমান বলে বাংলায় চৌথ চাইতে আক্রমণ করে। নেতৃত্বে প্রথমে ভাষ্কর পণ্ডিত, পরে দেওয়ান রঘুজি ভোঁসলে। আলিবর্দি বর্ধমানে এই আক্রমণকারীদের সঙ্গে মুখোমুখি হন। যুদ্ধ শুরু হয়। ক্লান্ত নবাবী সৈন্যরা মারাঠাদের আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়তে থাকে। নবাবের বেগম সর্ফুন্নিসা ছিলেন যুদ্ধের সম্মুখে। বেগমের হাতি লন্ডাকে আক্রমণ করে মারাঠারা। প্রায় ধরা পড়তে পড়তে সেনাপতি উমর খানের পুত্র মুসাহিব খান মহম্মদের বীরত্বে বেঁচে বেরিয়ে আসেন তিনি (রিয়াজুসালাতিন, ৩৩৮-৩৯)।(দুরদানা বেগম নবাব সরফরাজ খাঁয়ের বোনও সে সময়ের বাংলার এ রকম প্রভাবশালী মহিলা ছিলেন। তিনি ওডিসার শাসক মুর্শিদকুলি খাঁএর স্ত্রী। তাঁর স্বামীর থেকে অনেক বেশি সম্মান পেতেন তিনি। ভাইযের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য স্বামীকে প্ররোচিত করলেও আলিবর্দীর বড় সৈন্যবাহিনী আর তাঁর যুদ্ধ করার ক্ষমতার জন্য তাঁর সঙ্গে লড়াই করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। শেষে তিনি স্বামীকে বলেন, তিনি তাঁর কথা না শুনলে, স্বামীকে পদচ্যুত করে ওডিসার শাসক বানাবেন তাঁর জামাই আলি বাকির খাঁকে। স্ত্রীর ইচ্ছেয় তাঁকে মাথা নোয়াতে হয়।)বলা দরকার মারাঠা খুনি বর্গীদের আক্রমণে সামনাসামনি হওয়ার আগেই সর্ফুন্নিসা, আলিবর্দীর সঙ্গে মুর্শিদকুলি খাঁয়ের বিরুদ্ধে ওডিসা উদ্ধারে বালেশ্বরের যুদ্ধে লড়তে যান।
আলিবর্দী ভাষ্কর পণ্ডিতকে চতুরতার সঙ্গে হত্যা করলে সেই হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য নতুন করে বিশাল বাহিনি নিয়ে নাগপুরের রাজা রঘুনাথ ভোঁসলে বাংলা আক্রমণ করেন। নবাব এই আক্রমণের সামনাসামনি হন। কিন্তু তাঁকে এই লড়াইতে বেশ বেগ পেতে হয়, তাঁর আফগান সেনাপতি শামসের খানের বিশ্বাসঘাতকতায়। মুতাক্ষরিণের লেখক, নবাবের আত্মীয় গুলাম হুসেইন লিখছেন, ‘...আমার মনে আছে, নবাবের বেগমের মহলে উপস্থিত হয়েছি, তখন চিন্তিত নবাব ঢুকলেন। তাঁর চিন্তিত মুখ দেখে রাজ্ঞী প্রশ্ন করলেন। তিনি বললেন, আমি জানি না কি কি ঘটে চলেছে; তবে আমাদের সেনাবাহিনীতে কিছু কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে দেখছি। রাজ্ঞী তখন রঘুনাথ ভোঁসলের কাছে দুজন বিশ্বস্ত মানুষকে তাঁর পক্ষ থেকে পাঠান। তাঁর প্রস্তাব ছিল, তাঁরা তাঁর নাম করে মারাঠাদের সঙ্গে কোন একটা মিটমাটের চেষ্টা করবেন। দুজন রাজ্ঞীর হয়ে মীর হাবিবের কাছে পৌঁছান। মীর হাবিব তাঁদের রঘুনাথজীর কাছে উপস্থিত করেন। রঘুনাথজী রাজ্ঞীর প্রস্তাবে সম্মত হলেন।
ততদিনে নবাবের চরম বিরোধী, মীর হাবিব রঘুজীর শিবিরে যোগ দিয়েছেন। হাবিব, সর্ফুন্নিসার পাঠানো প্রস্তাবে রাজি হলেন না, বরং রঘুজীকে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্ররোচিত করেন। তাঁর যুক্তি মুর্শিদাবাদের সৈন্য বিহীন সেনাপতি, নওয়াজিশ মহম্মদ খাঁ মারাঠাদের সাহায্য করবেন – মোটামুটি রঘুজী হাবিবের এই প্রস্তাবে রাজি হন। সিদ্ধান্ত হল, রঘুজীর বাহিনী নবাবের আগে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করে সেই শহর দখল করে নেবে। উল্লসিত রঘুজী মুর্শিদাবাদের পথ ধরলেন। তাঁর পিছনে ধাওয়া করল বাংলার সেনা।’
কাটোয়ার কাছে যুদ্ধে রঘুজী প্রায় সমস্ত সেনা হারালেন এবং মারাঠারা চিরতরে বাংলা ছাড়তে বাধ্য হল।
এর পর আলিবর্দি মারাঠাদের সঙ্গে হাত মেলানো আফগান সর্দারদের পদচ্যুত করলেন। তাঁরা প্রত্যাঘাত করে। নবাবের জামাই পাটনার প্রশাসক, নবাবের জামাই, জৈনুদ্দিনকে হত্যা করে তাঁর স্ত্রী আমিনা বেগমকে গ্রেফতার করে। পরে যুদ্ধে তাঁদের পরাজিত করে আমিনা বেগম উদ্ধার হয়।
(ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেগমস অব বেঙ্গল থেকে)

No comments: