জগদীশ নারায়ণ সরকার
পরিখা কাটার কাজ চলতে থাকলে সমধায় মীর জুমলা, চৌকি-মীরদাদপুরে থাকা সুজার শিবিরের ওপর গোলান্দাজি চালান। পরিখা কাটা শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পরস্পরের ওপর গোলান্দাজি সপ্তাহ কাল ধরে চলতে থাকল। তা সত্ত্বেও দেখা গেল শত্রুর এলাকা ছাড়ার লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না, গঙ্গার পূর্বপ্রান্তের এক শাখা নদীতে মীর জুমলা হাঁটু জল খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। পরিখা নিরীক্ষণ করার সময় ডুবুরি দিয়ে গঙ্গার তল খোঁজারও কাজ ব্যক্তিগত উদ্যোগে চালালেন। কিন্তু নদীর তল পাওয়া গেল না।
হঠাতই মীর জুমলার চরেরা মহানন্দার উপরের উচ্চ অববাহিকায় গুণরাখা নামক একটি এলাকায় হাঁটু জলস্তর আবিষ্কারের খবর আনল। সাম্রাজ্যের একটি শিবিরের থেকে ৮ মাইল দূরে, অন্যটির থেকে ৪ মাইল। যাইহোক সামগ্রিক রণনীতিতে এই খবরটির গুরুত্ব অপরিসীম। এলাকাটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ, সেই জঙ্গলে বাস করে জংলি কুয়ার গোষ্ঠী এবং সেই এলাকা হেঁটে পার হওয়া সম্ভব। ১৬৬০ সালের ৩১ জানুয়ারির রাতে ফারাদ খানের সঙ্গে কারাওয়াল আর বেলদার দিয়ে নদী পার হয়ে সেখানে পরিখা খোঁড়ার কাজ দিলেন যাতে শত্রু পক্ষ তাদের রাস্তা আটকাতে না পারে। পরের দিন ১ ফেব্রুয়ারি জুলফিকার, ফিদায়ি এবং লোদি খান যুদ্ধ করার ভান করলে মীর জুমলা, মুখলিস খানকে নিয়ে দিনের দেড় প্রহরে নৌকোর সেতু বানিয়ে গঙ্গার পূর্বপ্রান্ত পার হয়ে গেলেন।
এবারে মীর জুমলা হাঁটু জলের এলাকা পার হওয়ার জন্য এগোলেন দিলির, দাউদ, মীর্জা, আর রশিদ খানকে সঙ্গে নিয়ে। মীর জুমলার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে বেলদার, কারাওয়ালা, উজবেগ এবং নানান রসদ নিয়ে ৫০ গজ চওড়া মহানন্দা পার হলেন ৩ দিনে ১–৩ ফেব্রুয়ারি। ঘোড়াগুলি সাঁতরে পার হল। মীর জুমলার নির্দেশে ৩০টা ডোবানো নৌকো তোলা হল – কোনটা কামান বাহক কোনটাকে সেতু তৈরির কাজে লাগানো হবে। ফারহাদের তৈরি পরিখা, এবং গোলান্দাজি, পীর মহম্মদের লাজবাব কারাওয়ালদের দৌলতে শত্রুদের দূরে থাকা একটা বাহিনী তাদের নদী পার হতে দেখলেও কিছু করে উঠতে পারল না, বরং তাদের নেতা আমীর কুলি মারা গেল।
সৈয়দ তাজ আর মিশকির উল্টোদিকে থাকা দিলির আর দাউদের কাটা পরিখার দায়িত্ব আবদুল্লা খানসারাই, সৈয়দ সালার খান, মিয়ানা খান, জামাল দিলিজাককে দিয়ে, মীর জুমলা স্বয়ং সমধায় এলেন, এখানেই সেনাবাহিনীর বড় অংশটাই শিবির গেড়ে ছিল, যাতে শত্রু নদী পেরোতে না পারে।
মীর জুমলার চালে মাত হয়ে যাওয়া সুজার দুই সেনাপতি সৈয়দ তাজ এবং মিশকি আতঙ্কিত হয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি সুজার শিবিরে ফিরে গেল। সুজা শত্রুপক্ষের সহজে মহানন্দা নদী পার হওয়া, চরেদের হাতে ৩ জন সুজাপন্থী সেনা ধরাপড়ার ঘটনায় মর্মাহত হলেন। অথচ তার পক্ষে কোন পদক্ষেপ করা বা মুখোমুখি সংঘর্ষে যাওয়া সমুচিত বোধ হল না। হতাশ হয়ে পড়া সুজার মনোবল চাঙ্গা হয়ে উঠল ঢাকা থেকে সৈয়দ আলম জাইনুদ্দিন আর ১৫০০ রিসালা আর ২০০ কামান পৌঁছনোয়। বর্ষা পর্যন্ত জলে চোবানো দুর্গটি রক্ষা করার পরিকল্পনা করে তিনি সমধার উল্টো দিকের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে নির্দেশ দিলেন।
৫ ফেব্রুয়ারি দিলির আর দাউদ ছেড়ে যাওয়া পরিখার কাছে এলেন। চিরাগের নেতৃত্বে দিলিরের রোজবিহানী বাহিনী গোলান্দাজির জন্য সেতুটি আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হলেও তারা উল্টো দিকে কিছু নৌকো দেখতে পেল। দিলির এবং দাউদের ২ মাইল দূরের মহানন্দার নালা হেঁটে পার হওয়ার কাজ দেখতে এবং তত্ত্বাবধান করতে মীর জুমলা গঙ্গা এবং মহানন্দার পূর্বপ্রান্ততম শাখাটি পার হলেন সেতু তৈরি করে ৭ ফেব্রুয়ারি। পরের দিন তিনি সৈয়দ সালার খান, মিয়ানা খান, জামাল দিলজাকের নেতৃত্বে ১০০০ ঘোড়সওয়ার, বহু পদাতিক এবং কামান মালদার দিকে পাঠালেন পূর্ব দিক থেকে সুজাকে ঘিরে ফেলতে এবং তার পূর্ব দিক হয়ে পালাবার পথ আটগকে দিতে। ইতিমধ্যে সুজার দক্ষিণ, পশ্চিম এবং উত্তরপ্রান্ত হয়ে পালানোর পথ যথাক্রমে রাজমহল থেকে সুতি এবং সমধা থেকে মহানন্দা পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পাহারা বসিয়ে। সুজা এখন সর্বনাশের মুখে দাঁড়িয়ে। সুজার বাহিনী মালদা ছেড়ে গেল। মীর জুমলার নির্দেশে দাউদ খান, আমীর খান, রসিদ খান এবং তাদের সবকটি বাহিনী গঙ্গা এবং মহানন্দার মধ্যে পরিখা কাটতে শুরু করল।
৩। শাহজাদা মহম্মদ সুলতান ফিরে এলেন
সুজার বিপদ চরমে দেখে শাহজাদা মহম্মদ সুলতান তার শ্বশুরকে ফেলে সম্রাটের শিবিরে ফেরত এলেন। আলমগীরনামা বলছে তার ধারণা হয়েছিল সুজা এখন হারা যুদ্ধ লড়ছে, হারার শিবিরের অংশিদার তিনি হতে চান না। তার ভুল বুঝতে পেরে শাহজাদা তাণ্ডায় তার অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে যাবার ছলে রাজমহলের সাম্রাজ্য শাসক ইসলাম খানকে খবর পাঠিয়ে বললেন দেওগাছি থেকে আসা তার বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করতে। কিন্তু আসল কারণ ছিল অন্য। এর আগে বলা গিয়েছে সুজা যখন পশ্চিম প্রান্ত ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন তখন তিনি শাহজাদাকে আগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এবং পূর্বপাড়েও যখন নিজের সুরক্ষায় সুজা লড়ছেন, তখনও কিন্তু আমরা শাহজাদার দেখা পাইনি। সুজার পক্ষে শাহজাদাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া তার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না, কেননা তিনি সুজাকে অনেক সেবা করেছেন, তার বহু আভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এটা বলা যায় যে সুজার মনে শাহজাদার বিষয়ে কিছু না কিছু সংশয় তৈরি হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তে আমরা আসতে পারি আলমগীরনামা এবং সেই সময়ের ইওরোপিয় ভ্রমণকারীদের রচনা সূত্রে।
এই ঘটনার নেপথ্যে কিছুটা মীর জুমলার কূটনৈতিক চাতুর্য রয়েছে। এই চাতুর্যের ঘটনা মনে পড়িয়ে দেয় শাহজাদা আকবরের বিদ্রোহকে যেভাবে আওরঙ্গজেব সামলেছিলেন। আওরঙ্গজেবের পরামর্শে শাহজাদার উদ্দেশ্যে মীর জুমলা একটি চিঠি লেখেন যার সারতসার হল, তিনি চান শাহজাদা সুজার কাছে থাকুন যাতে তিনি সম্রাটের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেন এবং তিনি তার পিতাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেই প্রতিশ্রুতি যতদিন না তিনি পূর্ণ করতে পারছেন, ততদিন যেন তিনি সুজার শিবিরেই অবস্থান করেন। উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে চিঠিটি সুজার হাতে পড়ল, স্বভাবতই সুজা সন্দেহ করতে শুরু করলেন শাহজাদার কাজকর্ম। শাহজাদা শ্বশুরকে জানালেন এই ঘটনায় তার কোন হাত নেই। এটা জাল, এবং এটা উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে সুজার সঙ্গে বিরোধ ঘটাতে লেখা হয়েছে। যদিও আলমগীরনামায় এই ঘটনার সঙ্গে মীর জুমলা বা আওরঙ্গজেবের জড়িত থাকার কোন সূত্র দেওয়া হয় নি; পরের লেখকেরা কিন্তু এই ঘটনায় মীর জুমলারই অদৃশ্য হাত দেখতে পেয়েছেন। ঈশ্বরদাস লিখছেন, তিনি তাবির এবং তাজবীর অনুসরণ করে খেলাটা খেলে দিলেন এবং শাহজাদাকে তার শিবিরে ফিরে আসতেই হল। সুজার সন্দেহ জাগার সঙ্গে সঙ্গে তার জামাইও ভাবলেন এই সুযোগে শিবির বদল করা যাবে। তিনি আর হেরো দলের সঙ্গে থাকতে চান না। তিনি যতদিন সুজার সঙ্গে চৌকি-মীরদাদপুরে ছিলেন ততদিন তার পক্ষে কোন পদক্ষেপ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু যখন তিনি তাণ্ডায় গেলেন – আলমগীরনামার কবিতা সূত্র বলছে সুজার নির্দেশে তাঁর অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে, সেই সময় তিনি দেওগাছি থেকে গোপনে ইসলাম খানের সঙ্গে চিঠি আদানপ্রদান করতে শুরু করলেন। ঢাকা থেকে সুজার পুত্র দীন মহম্মদের নির্দেশে খানইআলমের নেতৃত্বে নতুন বাহিনী এসে পৌঁছনয় শাহজাদার ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগল। তার মনে হল তাকে বাদ দিয়েই সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যাচ্ছে, এবং এটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুঘল ঐতিহ্যের পরিপন্থী বলে তার মনে হল। ঠিক যে রকম করে তিনি তার পিতা আর তার পিতার সেনানয়কএর ওপর রাগ করে একদিন শ্বশুরের শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন ঠিক সেই রকম সিদ্ধান্ত হঠাতই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি আমার তার পূর্বের ছেড়ে আসা শিবিরে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শাহজাদা তাণ্ডা ছাড়লেন দেওগাছি যাবার উদ্দেশ্যে। সেখানে তাকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিলেন সেনানী ইসলাম খান, সঙ্গে ১৮টি ইরাণী সোনার কিংখাব (জরবাফত), মৃগনাভি, ৩৬টা সিন্দুকে সোনা, হিরে এবং একটা নীলকান্ত মণি। সুজা শাহজাদার এই কাজে গভীরভাবে দুঃখ পেলেন। তার মনে হল, তার হাত থেকে গ্রেফতারি এড়াতে শাহজাদা পালিয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে ভাগ্যের চাকা তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সুজা বললেন, আমার চোখের জল আমার ভাগ্য... যাকে আমি তৈরি করলাম, সেই আমার শত্রু হল।
সেই মাঝইরাতেই প্রথম সংবাদবাহক মীর জুমলাকে এই সংবাদটা দিল। মীর জুমলা মহানন্দার পূর্বপাড় থেকে সমধায় ফিরে এলেন ১২ ফেব্রুয়ারি শাহজাদাকে স্বাগত জানাতে। তাঁকে সম্মান জানিয়ে নিজে তার ঘোড়া থেকে নামলেন এবং ভেরি বেজে উঠল। তার জন্য সরকারি খাজাঞ্চিখানা থেকে প্রয়োজনীয় রসদ জোগাড় করাছিল, এ ছাড়াও তাকে দেওয়া হল ৪০ পেটি সোনা, নীলকান্ত মণি, জহরত, ৮টি ইরাণের সোনার কিংখাব, মৃগনাভি, রাম(?) এবং য়ুনান(?), ইজিপ্ট এবং সিরিয়া থেকে জোগাড় করা সোনার জিন সহ ৪০টা আরবি ঘোড়া, আর হাতি। এই আড়ম্বরীয় সম্মান দেখানোর পিছনে উদ্দেশ্য একটাই, শাহজাদাকে তার মার্জনাহীন পিতার হাতে তুলে দেওয়া। ইসলাম খানের পরামর্শে শাহজাদা মীর জুমলার আশ্রয়ে এসেছেন, যতক্ষণনা সম্রাটের থেকে কোন প্রতিক্রিয়া আসছে, তার পক্ষে সরাসরি সম্রাটের কাছ এই জটিল মামলা শাহজাদার পক্ষ নিয়ে পাঠানো খুব কঠিন হবে। মীর জুমলার চেষ্টায় পুত্রের ফেরত আসায় সম্রাট স্বস্তি প্রকাশ করলেন কিন্তু তার প্রধান সেনানীকে নির্দেশ দিলেন তাকে চোখে চোখে রাখতে। তবুও মীর জুমলা শাহজাদাকে চিন্তা না করতে বলে বললেন তার পিতা বরাবরের মত ক্ষমাশীল। ২৯ ফেব্রুয়ারি তিনি ফিদায়ি খানকে দিয়ে শাহজাদাকে দরবারের উদ্দেশ্যে পাঠালেন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment