জগদীশ নারায়ণ সরকার
চতুর্থ ভাগ
১। উজিরত পদ থেকে মীর জুমলার বহিষ্কার
দাক্ষিণাত্যে, দাক্ষিণাত্যের সুবাদার আর উজির যখন বীজাপুর দখলের মুখে দাঁড়িয়ে, ঠিক তখন দিল্লির কিছু অশান্ত ঘটনা তাঁদের অগ্রগতিতে সরাসরি আঘাত হানল। মুঘল রাজসভার রাজনীতির খুব তাড়াতাড়ি উত্থানপতন নতুন করে তার মত চলতে শুরু করেছে – বীজাপুরীরা দারাকে আবেদন করল – দারার আওরঙ্গজেবের ঈর্ষা জনিত বিরোধিতা বেড়েই চলছিল – তারা সেটাতে নতুন করে ধুনো দিল। কয়েক মাস আগেই যে সম্রাট বীজাপুর আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই সম্রাটই দারার প্ররোচনায় মীর জুমলাকে বীজাপুরের সঙ্গে শান্তি আলোচনার নির্দেশ দিলেন। আওরঙ্গজেবের কাছে এই নির্দেশ যেন পৃথিবী দ্বিধা হওয়ার সামিল। যিনি যুদ্ধ জেতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে অথচ তাঁকে শান্তি চাইতে বলা হচ্ছে। ১৬৫৭র চুক্তি অনুযায়ী বীজাপুরের সুলতান বিপুল অর্থের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পারেন্দা, নিজামশাহী কোঙ্কণ এবং ওয়াঙ্গির মহাল ছেড়ে দিতে সম্মত হলেন। ঠিক হল মীর জুমলা এগুলিতে থানা(সেনা ছাউনি) বসাবেন আর কাজি নিজামা ক্ষতিপূরণ উদ্ধার করলে মীর জুমলা ফিরে যাবেন রাজসভায়। মীর জুমলাকে কোঙ্কণের দুর্গগুলির দায়িত্ব দিয়ে আওরঙ্গজেবকে বিদরে ফিরে যেতে বলা হল।
এর থেকেও খারাপ অবস্থা অপেক্ষা করছিল মীর জুমলার জন্য। শাহজাহান ৬ সেপ্টেম্বরে অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং দারাকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গেলেন। দারা আর তার উজিরের সঙ্গে আর কোন সম্বন্ধ রাখবেননা ঠিক করলেন। নির্দিষ্ট একটি ফর্মান জারি করে মীর জুমলাকে তার উচ্চপদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। অবর্তমানে তার কাজে নিযুক্ত পুত্রের ওপর উজিরের দপ্তরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল। মহবত খান বা রাও ছত্রসালের মত আধিকারিকদের সভায় ফিরে আসার নির্দেশ গেলেও মীর জুমলাকে পারেন্দা দখলের কাজ শেষ করে আসার নির্দেশ জারি হল।
২। মীর জুমলাকে পারেন্দায় পাঠানো হল
দারা মীর জুমলাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারলেও তার ওপর আওরঙ্গজেবের বিশ্বাস যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেল। পরস্পর বিরোধী নানান উদ্যমে প্রায় মাথা ঘুরে বিহ্বল হয়ে যাওয়া আওরঙ্গজেব আরও বেশি করে মীর জুমলার পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন, যেভাবে একজন বৃদ্ধ জরাগ্রস্ত মানুষ তার সাথীর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করেন। সম্রাটের নির্দেশে পেশকাশ উদ্ধার করে এবং চুক্তিতে উল্লিখিত দুর্গ আর প্রাসাদ কব্জা করে কল্যানী থেকে বিদরে ফেরার আগে ৪ সেপ্টেম্বর ১৬৫৭তে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে ৩০ সেপ্টেম্বর পারেন্দায় পাঠালেন পেশকাশ নেওয়ার জন্য এবং তাঁকে বললেন, তিনি যেন কাজি নাজিমের বীজাপুরে যুদ্ধ-ক্ষতিপূরণ আদায়ের কাজ দেখা শোনা করেন, এবং প্রথম থেকেই সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে তাঁকে যে সব হাতি বা দামি রত্নরাজি উপহার দেওয়া হয়েছে তার মূল্য নিরূপণ করার কাজ করে রাখেন।
পান্দেরায় যাওয়ার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে প্রায় প্রত্যেকটি সম্ভাব্য অঘটনের পূর্বাভাষ করে নানান উপযুক্ত পরামর্শ দিয়ে গেলেন। এমন কি মীর জুমলার চলে যাওয়ার পরেও প্রায় রোজই শেখ মীর আবদুল ফাতা(কাবিল খান) বা মহম্মদ শরিফএর মত বিশ্বস্ত কর্মচারী মার্ফত আওরঙ্গজেব তার সঙ্গে চিঠিতে এবং মৌখিকভাবে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যান। আওরঙ্গজেবের ধারণা ছিল পান্দেরা খুব তাড়াতাড়ি কব্জা করা যাবে এবং তিনি মীর জুমলাকে জানালেন যে সেটি দখল নিয়েই তার প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং নাসিরি খান দিল্লি চলে গেলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে, সেই সুযোগে শিবাজির হঠাত আক্রমণ থেকে বীরকে বাঁচাতে হবে। অক্টোবরের শেষ প্রান্তে শিবাজীর বিরুদ্ধে সেনা পাঠানোর বিষয়ে মীর জুমলার মন্তব্য চেয়ে বসলেন। জুনারের নতুন মুঘল ফৌজদার মহম্মদ য়ুসুফ কল্যাণীর ছাড়িয়ে গিয়ে শিবাজীর জোট সঙ্গী হাবাস খানের মাথা কেটে দিলেও ফাঁকা জুনারে শিবাজীর সেনা ঢুকে পড়তে পারে এই আশংকাও ছিল তাঁর।
পারেন্দা দুর্গ দখল করা যতটা সহজ হবে আওরঙ্গজেব ভেবেছিলেন, মীর জুমলার পক্ষে কাজটা ততটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। আওরঙ্গজেবের কল্যাণী ছেড়ে চলে আসায় সেই শূন্যস্থানটি বীজাপুর দখল করতে উদ্গ্রীব হয়ে পড়ে এবং ভীমা নদী পার হয়ে কল্যাণী এবং বিদর জেলা দখল করার লক্ষ্যে যাত্রা করা দল বিচ্ছিন্ন মুঘল সেনাপতি আফজল খানকে আক্রমণের পরিকল্পনা করার সুযোগ এনে দেয়। নালদুর্গ মৌজায়, বিশেষ করে মুজামগাঁওতে মুঘল রাজস্ব আদায়কারীদের ওপর স্থানীয় দুর্গের কর্তারা ৮ অক্টোবর হামলা করে। এর পরে আনকালকাটের থানেদার আবদুল হামিদ ডেকানি আলুন্দে এলেন। বীজাপুরীদের এই চলাচল মুঘলদের ভয় পাইয়ে দিল। আওরঙ্গজেব থানাগুলি রক্ষার পক্ষে সায় দিলেন, এবং বললেন মীর জুমলা যেন ইব্রাহিম খান এবং ইখলাস খানকে নির্দেশ দেন যাতে রজস্ব আদায় হওয়ার মধ্যের সময়ে কিছু দিনের জন্য বীজাপুরীদের হামলা আটকানো যায়। যদি মীর জুমলা থানাগুলি রক্ষায় ব্যবস্থা না নেন তাহলে আওরঙ্গজেব সেনাবাহিনী তুলে নেবেন ঠিক করলেন। সঙ্কেতে লেখা মীর জুমলাকে উদ্দেশ্য করে চিঠি এবং সুবাদারের দিল্লির দূতের প্রতি শাহজাহানের স্বাস্থ্য এবং ছোট ভাইদের প্রতি সুজার সম্ভাব্য মনোভাব জিজ্ঞাসা করে লেখা গোপন চিঠি বীজাপুরীরা নানদুর্গে আটকাল। তারা বুঝতে পারল যে আওরঙ্গজেব এখন দিল্লির মসনদ বিষয়ে লড়াইকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, ফলে তাদের এখন কিছু দিনের জন্য মুক্তি।
গোপন চিঠি ধরা পড়ে যাওয়ায় নিয়মিত খবর আদানপ্রদান করা কঠিন হয়ে গেল। এমন কি মীর জুমলার বার্তাবাহকেরা হয় বোকা, না হয় দূরদৃষ্টিহীন না হয় বিশ্বাসঘাতক বেরোতে থাকল। তাদের নিয়মিত শাস্তি দেওয়া হল। হরকরা মীর গাজি এবং আবদুল হাসানের ওপরে একজন পরিদর্শক বসিয়ে দেওয়া হল এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হল। গোপন হরকরার পুত্রকে সেনাবাহিনী থেকে ছাঁটাই করা হল। মীর জুমলার চিঠি আর এখন একজন সরকারি আধিকারিক ছাড়া অন্য কারোর মার্ফত পাঠানো হয় না। এর ফলে খবর আদানপ্রদানে দেরি হতে লাগল। এই সব ঘটনাবলীতে মীর জুমলার পক্ষে শান্তিচুক্তির ধারাগুলি প্রয়োগ করা বড্ড ঝামেলাদার হয়ে দাঁড়ায়। তিনি আওরঙ্গজেবকে অনুরোধ করলেন ডাকচৌকি বসাতে। প্রস্তাব আওরঙ্গজেব অনুমোদন দিলেন, কেননা বর্তমানে আশেপাশের অঞ্চল থেকে আরও বেশি খবর জোগাড় করা জরুরি হয়ে দেখা দিচ্ছিল।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment