জগদীশ নারায়ণ সরকার
১৬৫৬র ডিসেম্বরের শুরুর দিকে শিবাজীকে পক্ষে আনার প্রস্তাব পেশ করলেন মীর জুমলার কাছে। শিবাজীর দূত আওরঙ্গজেবের জন্য অপেক্ষা করে প্রস্তাব দিলেন বর্তমানে শিবাজী বীজাপুরী কোঙ্কণ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁকে যদি ভাল মনসব এবং উপযুক্ত তনখা(বেতন) দেওয়া হয়, তিনি তাহলে সেটি আওরঙ্গজেবকে উপহার দিতে পারেন। আওরঙ্গজেব তাঁকে কিছু শর্তে রাজি হওয়ার আশ্বাস দিলেন এবং শাহজীকে একই শর্ত দিলেন। মীর জুমলাকে জানালেন শিবাজীদের পক্ষ থেকে উত্তর পেলেই তাঁকে জানানো হবে। মীর জুমলাকে তিনি লিখলেন, তারা যদি আমার নির্দেশ মানে তো ভাল, না হলে সাম্রাজ্যের বাহিনীর হাতে অবধারিত শাস্তি লেখা রয়েছে।
মহম্মদ আদিল শাহের মৃত্যুর পর আমলাদের মধ্যে মত বিরোধ দেখা দেয়, তাতে মুঘলেরা সহজেই সেনাবাহিনীকে কব্জা করে নিতে পারার অবস্থায় চলে এল। ২৩ ডিসেম্বরের পরে একটা চিঠিতে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে লিখলেন, আমার সমস্ত উদ্যম, যে কোন উপায়ে বীজাপুর মুঘলদের পক্ষে চলে আসা দেখা, এমন কি প্রখ্যাত সেনায়কেরাও ছোট্ট ধাক্কাতেই নিজেরাই এপক্ষে চলে আসার জন্য উন্মুখ। রণদৌলা খানের পুত্র গাজি খান, আবদুল কাদির ডাকতু, শেখ মুস্তাফা জুনায়েদি, হাজি খান মিয়ানা, যশোবন্ত, মুস্তাফা খান সহ অন্যান্য প্রখ্যাত সেনা নায়ক, মীর জুমলা আসার পরেই তাঁর সাহায্যে তাঁদের সঙ্গে আরও বেশি করে অভিজাত-চাকুরেকে জুটিয়ে আওরঙ্গজেবের পক্ষ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
বিজাপুরিদের স্বপক্ষে এনে সেনাবাহিনীকে এলোমেলো করে দেওয়ার যে পরিকল্পনা রচিত হল, সেটি সফল করতে যে প্রচুর অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন, তার কথাও উঠল। আওরঙ্গজেব বললেন, এটা জরুরি, অর্থ ছাড়া এত বড় ঘটনা ঘটানো যাবেই না, লোভ জাগিয়ে না তুলতে পারলে এই উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের মন জেতা সম্ভব নয়। এই উপলক্ষে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে দাক্ষিণাত্যের রাজকোষের অবস্থা নিয়ে একটা সমীক্ষা পাঠালেন। দৌলতাবাদ এবং আসিফ দুর্গের জন্য রাজকোষ থেকে ২০ কক্ষ টাকার বেশি এবং অন্যান্য দুর্গের জন্য ৩০ লক্ষ টাকার বেশি খরচ করার ক্ষেত্রে সম্রাট যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, তাতে মুঘল দাক্ষিণাত্যের এক বছরের খরচও চালানো সম্ভব ছিল না। ফলে সুবাদার, এই সব বিষয় তার থেকে বেশি জানা উজিরকে লিখলেন, গোলকুণ্ডার জন্য সম্রাটের থেকে অবিলম্বে ১০ লক্ষ টাকার খেসারত জোগাড় করতে হবে, এবং তার পরে আমরা দৌলতাবাদে বসে ঠিক করব আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ খরচ(আমলাদের ঘুষ দেওয়ার) কিভাবে সামলানো যায়।
৪। মীর জুমলার দাক্ষিণাত্য যাত্রা
দারার সমস্ত বিরোধিতা নিশ্চিহ্ন করে, বিচক্ষণ উজির রাজসভায় আওরঙ্গজেবের নীতিগুলি মনযোগ সহকারে এবং সফলভাবে তোলার কাজ করে চললেন। মাঝেমধ্যে শাহজাহানকে মনমুগ্ধকর উপহার দিয়ে মীর জুমলা সম্রাটকে বুঝিয়ে ছেড়েছিলেন যে দাক্ষিণাত্য অভিযান বাচ্চার হাতের মোয়া এবং এই কাজটি মীর জুমলা স্বয়ং নিজের হাতে করে দেখাবেন। দাক্ষিণাত্যের হিরের খনিগুলি দখলের লোভে দারা আর জাহানারার সক্রিয় বিরোধিতা নস্যাত করে দিলেন সম্রাট। স্বয়ং তিনি অভিযানের নেতৃত্ব দিন, দারার প্রস্তাব বাতিল করে ২৬ নভেম্বর আওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে এবং কষা পরিকল্পনায় সামগ্রিক রণসাজে দাক্ষিণাত্যে অভিযানের অনুমতি দিয়ে দিলেন।
মীর জুমলা মালওয়া সেনা না পাঠনোর দারার প্রস্তাব নাকচ করিয়ে আওরঙ্গজেবের শর্তে সম্রাটকে রাজি করিয়ে নিলেন। সম্রাট খান জাহান শায়েস্তা খানকে অবিলম্বে অতিদ্রুত দৌলতাবাদে আওরঙ্গজেব পৌঁছলে, তার সঙ্গে যোগ দিতে নির্দেশ দিলেন।৬০ জন মনসবদারের নেতৃত্বে ২০ হাজার সেনা সুবাদারের হাত শক্ত করতে রওনা হল। যারা তাঁদের বাড়িতে বা তাঁবুতে/শিবিরে আছেন তাঁদের অবিলম্বে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যোগ দিতে সম্রাটের নির্দেশ(ফরমান) পাঠানো হল। উজির, আমীর এবং মনসবদারেরা সরাসরি সম্রাটের থেকে নির্দেশ পেলেন। মীর জুমলা সম্রাটের এই নির্দেশবলে একটি বিশেষ খেলাত, হিরে জহরতে মোড়া একটি ছোরা(খঞ্জর মুরাসসা), সোনা আর রূপোর শৃঙ্খলে মোড়া দুটি ঘোড়া(একটি আরবি, একটি ইরাকি), রূপোর শৃংখলে মোড়া একটি হাতি, রূপোর হাওদাওয়ালা একটি মাদি হাতি এবং অন্যান্য নানান দ্রব্য উপহার পেলেন। প্রথম সাক্ষাৎ থেকে শুরু করে তিনি সম্রাটের থেকে উপহার পেয়েছেন ৭ লক্ষ টাকা যার মধ্যে ৫ লক্ষ নগদে, ঘোড়া, হাতি এবং অন্যান্য রূপো এবং দ্রব্য ২ লক্ষ টাকা।
উজিরের পুত্র মহম্মদ আমিনকে তার পিতা ফিরে না আসা পর্যন্ত দেওয়ানি দপ্তরটি দেখাশোনার ভার দেওয়া হল এবং তার পদ(৩০০০ জাট, ১০০০ সওয়ার) বাড়ানো হল ১০০০ জাট হিসেবে।
দারার বিরুদ্ধে মীর জুমলার জিত হল কূটনীতির চরম প্রয়োগে। কিন্তু শাহজাদার শেষ মুহূর্তের প্রতিবাদ জানানো এবং অন্য একটা পদক্ষেপ নেওয়ার সব চেষ্টা বিফল হয়ে গিয়েছিল মীর জুমলার সফলতায়। এবং মানুচির লেখাকে যদি সত্য ধরে নেওয়া হয়, তাহলে দারা শেষ মুহূর্তে মীর জুমলার ৮০ জন ফিরিঙ্গি সাঁজোয়া সেনা কিনে নিয়েছিলেন। উজির তার পুত্র এবং তার সমগ্র পরিবারকে বন্ধক রেখে দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
সম্ভবত দারা শেষ মুহূর্তের এই পদক্ষেপেই মীর জুমলার যাত্রা কিছুটা দেরি হয়ে যায়। তিনি সম্রাটের কাছে ২৬ নভেম্বর তারিখ থেকে ছুটি নিয়েছিলেন, কিন্তু দিল্লি থেকে রওনা হলেন ১ ডিসেম্বর ১৬৫৬। গোয়ালিয়র এবং কুলারাস হয়ে দাক্ষিণাত্য যাওয়ার পথে তিনি নিয়মিত আওরঙ্গজেবকে চিঠি লিখতে লিখতে এগিয়ে চললেন সুবাদারের সঙ্গে মিলিত হতে। আওরঙ্গাবাদে পৌছলেন ১৮ জানুয়ারি ১৬৫৭। তার শ্লথ গতির কারণ হল সব মনসবদার রাস্তায় ঠিক সময়ে তার সঙ্গে যোগ দেন নি। কেউ কেউ দারাপন্থী, কেউ কেউ তাঁদের জায়গির ছাড়তে অলসতা করেছে, অনেকের নানান বাস্তব কারণেই দেরি হয়েছে। ১৬৫৬ সালের শেষের দিকে আওরঙ্গজেব মহবত খান, নাজাবত খান এবং মির্জা সুলতানকে বারংবার চিঠি লিখে মীর জুমলার সংগে যোগ দিতে দেরি না করার উপদেশ দিয়েছেন। উজিরকে আশ্বস্ত করে তিনি লিখলেন যারা দেরি করছে, তাঁদের শাস্তি পেতেই হবে। প্রয়োজনে তিনি যেন হরকরাদের মার্ফত সম্রাটকে অভিযোগপত্র পাঠিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করে রাখেন। এছাড়াও বললেন, মীর জুমলা যেন উত্তর ভারত থেকে যে সব অস্ত্রশস্ত্র আসার কথা তার জন্য অপেক্ষা না করেন, সেগুলি আওরঙ্গজেবের কাছে আসতে অন্তত ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৬৫৭ পেরিয়ে যাবে।
আওরঙ্গজেব মীরজুমলার দেরিতে অসম্ভব অস্থির হয়ে উঠছিলেন। হয়ত শেষ পর্যন্ত তিনি মীর জুমলার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারবেন না, কেননা তা হলে যে সুযোগ এসেছে সেটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে – এটি জানিয়ে দিলেন। তবুও আবার তিনি তাঁকে শীঘ্র আসতে অনুরোধ করলেন। ২৪ ডিসেম্বরের মীর জুমলার কুলারাস থেকে পাঠানো চিঠির উত্তরে আওরঙ্গজেব লিখছেন, খুব তাড়াতাড়ি অভিযান শুরু করা দরকার, যাতে বীজাপুর যে দ’য়ে পড়েছে, তার সম্পূর্ণ সুযোগ নিতে পারে মুঘল বাহিনী, ক) খান মহম্মদ, আফজল, ফতে সারনাউবাত, বাহালোলের পুত্রদের মত সাধারণ সেনার মধ্যে অবিশ্বাসের পরিবেশ বেড়ে চলেছে, খ) নিজের ক্ষমতা দেখাতে শাহজী ভোঁসলা বিদ্রোহ করছে এবং তার সঙ্গে জোট গড়তে চলেছে শ্রীরঙ্গ রয়াল এবং তিনি কর্ণাটকের কিছু মহাল দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তিনি লিখলেন আমার আর দেরি করা চলে না, এরকম অবস্থা হয়ত আর আমি পাব না। খুব তাড়াতাড়ি এস, আমরা উভয়ে মিলে এই কাজটি সম্পন্ন করি। এখানে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। সত্যিকারের তাই হয়েছিল। তার দেরি দেখে, মীর জুমলা কবে তার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেন, সেই দিন গুণতে জ্যোতিষীদের আওরঙ্গজেব বসিয়ে দিয়েছিলেন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment