...গত বছরের প্রকাশনা। ধরমপালজীর এই সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন ক্লদ আলভারেজ।
আমরা যে কাজ করছি, পুরোনো বাঙলাকে ফিরে দেখা, সেই কাজের মূল গুরুরা হলের গ্রামীন উদ্যোগীরা। এছাড়াও হাতে গোণা শিক্ষিত, যারা আমদের পা মাটিতে রাখতে শিখিয়েছেন, গ্রামের মানুষকে গুরু ভাবতে শিখিয়েছেন তাদের মধ্য ধরমপালজী অন্যতম।
জীবনী বর্ণনা মোটামুটি ঔপনিবেশিক সভ্যতার অবদান, যেখানে প্রখ্যাতরা সমাজের জ্ঞানে সম্পদ শুষে বেড়ে উঠে সেগুলিকে নিজেদের সম্পত্তি বলে চালান। এই ব্যক্তি কেন্দ্রিক আলোচনা এই পূর্বের সমাজে ছিল না বললেই চলে, বিশেষ করে গ্রাম সমাজে।
এই আলোচনা বাংলায় খুব একটা চল নেই। গত কয়েক দশকে বাংলা তথা ভারতের সমস্ত জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য ধ্বংস করে গয়ে উঠেছে 'কেন্দ্র' উপসর্গওয়ালা কয়েকটি পশ্চিমী ধাঁচের শিক্ষা কেন্দ্র।
এই দেশজ গ্রামীন, অপ্রাতিষ্ঠানিক, বিকেন্দ্রীভূত জ্ঞানচর্চা বাংলায় হয় নি বললেই চলে, বাংলায় তাই ধরমপলাজী প্রায় অশ্রুত ব্যক্তি।
তাঁর জীবনী আলোচনা এখানে অবান্তর - শুধু না বললেই নয় যে সব কথা - তিনি ভারতে গত এক শতক ধরে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত চর্চিত পশ্চিমি সাম্যবাদের ধারার বাইরে দাঁড়িয়ে ভারতীয় সাম্যবাদের চর্চা করেছিলেন, যে সাম্যবাদের ভিত লুকিয়ে রয়েছে গ্রাম সমাজের জ্ঞানচর্চায়।
সেই দেশচর্চার কুড় আমরা পেয়েছিলাম ধরমপালজীর কাজে।
তিন দশক আগে একটি সাক্ষাতকারের বাংলায় অনুদিত কিছু অংশ তুলে দেওয়া গেল। কয়েকটি ধারাবাহিকে প্রকাশ পাবে -
কৃষ্ণণঃ প্রথমেই খুব বস্তাপচা প্রশ্ন করছি। আপনি কেন এবং কিভাবে ব্রিটিশপূর্ব বিশেষ করে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের ভারতের সমাজ জানতে উৎসাহী হলেন। আপনাকে এই প্রশ্নটি করছি, কেননা আপনি তথাকথিত শিক্ষাগতভাবে (বিশ্ববিদ্যালয়ে) গবেষক/জ্ঞানচর্চক নন।
ধরমপালঃ আমি দীর্ঘদনধরে এসোসিয়েশন আব ভলান্টারি এজেন্সিজ ফর রুরাল ডেভেলাপমেন্ট(এভার্ড)এর জড়িয়েছিলাম। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত আমি এর সম্পাদক থেকেছি। এভার্ড আমাদের গ্রামের পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থা জানতে উৎসুক ছিল। এই সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি, ভারতীয় সমাজে পরম্পরাগত ভাবনা বা বিশ্বাসের সঙ্গে বিদেশের দিকে দৃষ্টি রেখে বেড়ে ওঠা মানুষদের দুস্তর ব্যবধান। শহুরে মানুষেরা দেশের সমাজ ব্যবস্থা জানেনইনা বলা যেতে পারে।
এ সম্বন্ধে আপনাকে আমি একটা বাস্তব উদাহরণ দিতে পারি। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বুঝতে, এবং তা নিয়ে কাজ করা একটি দলের সঙ্গে আমি রাজস্থান গিয়েছিলাম।আমরা দেখলাম পঞ্চায়েত একটি নতুন বাড়ি তৈরি করেছে। তার কাজগপত্র পরীক্ষা করে দেখলাম যে পঞ্চায়েতে এই বাড়িটা তৈরি করা নিয়ে কোনো তথ্য রাখা নেই। খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে বিশ) পঞ্চায়েত(২০টি পঞ্চায়েতের সংগঠন – উত্তর বাংলায় যেমন বাইশা পঞ্চায়েত নামে একটা ব্যবস্থা ছিল)। এটি একটি পঞ্চায়েত, যা পরম্পরাগতভাবে গ্রামে কাজ করে, এবং এর সঙ্গে বাস্তবে যে নিয়মতান্ত্রিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তার কোনো মিল নেই।
এটি একটি শেখার ব্যাপার ছিল আমাদের কাছে – বুঝতে চাইলাম যে গ্রামের মানুষ কি ভাবে কোনো বিষয়কে দেখে, এবং তাঁরা বাইরের নানান ধাক্কায় কিভাবে প্রভাবিত হয়। বুঝলাম, আমরা কত কম গ্রাম সম্বন্ধে জানি। অন্ধ্র, তামিলনাড়ু এবং অন্যান্য এলাকায় আমরা কাজ করতে গিয়ে এই একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। ১৯৬৩-৬৫ পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি তামিলনাড়ুতে যাই। বিভিন্ন জেলায় গিয়ে পঞ্চায়েতের কাজের সঙ্গে জুড়ে থাকা নানান মানুষের সঙ্গে কথা বললাম, এবং পঞ্চায়েত কিভাবে চলে তারও একটা আঁচ নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তাঞ্জোরে আমি স্থানীয় ভারত সেবক সমাজের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে জানান তাঞ্জোরের আশেপাশে ১৯৩৭ সাল থেকে ১০০টিরও বেশি সমুদায়ম গ্রামের আস্তিত্ব রয়েছে। সমুদায়ম গ্রাম হল এমন একটা গ্রাম যেখানে সময়ে সময়ে গ্রামের জমির চাষের অধিকার বিভিন্ন পরিবারের ওপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বর্তায়, অথচ জমির অধিকার কিন্তু সামগ্রিক সমাজের থাকে। এই ব্যবস্থাটি প্রয়োজন হয় কেননা, বহু সময়ে জমির উর্বরতা, নদীর ঢাল, ইত্যদির মত নানান বিষয় পরিবর্তিত হলে জমি চাষের ব্যবস্থাও পরিবর্তিত হয়। তখন জমি চাষের অধিকার নতুন করে ভাগ হয়।
আমি পরে রাজস্ব সমীক্ষায় দেখি, ১৮০৭ সাল পর্যন্ত তাঞ্জোরের অন্তত ৩০ শতাংশ সমুদায় গ্রাম ছিল। আষ্টাদশ শতের শেষ দিকের আর উনবিংশ শতের প্রথমের দিকের যত ব্রিটিশ তথ্য দেখেছি, তত আমি বুঝতে পারলাম আমরা ভারতীয় সমাজ নিয়ে যে সব ধারণা করেছি, সব ভুল ছিল। আমি এই কাজটি সারাজীবন ধরে করেছি, আমার ধারণা সকলের এই রাস্তায় গবেষণা করলে, নতুন তথ্যে উপনীত হতে পারবেন।
(এর পর পরের প্রকাশনায়)
আমরা যে কাজ করছি, পুরোনো বাঙলাকে ফিরে দেখা, সেই কাজের মূল গুরুরা হলের গ্রামীন উদ্যোগীরা। এছাড়াও হাতে গোণা শিক্ষিত, যারা আমদের পা মাটিতে রাখতে শিখিয়েছেন, গ্রামের মানুষকে গুরু ভাবতে শিখিয়েছেন তাদের মধ্য ধরমপালজী অন্যতম।
জীবনী বর্ণনা মোটামুটি ঔপনিবেশিক সভ্যতার অবদান, যেখানে প্রখ্যাতরা সমাজের জ্ঞানে সম্পদ শুষে বেড়ে উঠে সেগুলিকে নিজেদের সম্পত্তি বলে চালান। এই ব্যক্তি কেন্দ্রিক আলোচনা এই পূর্বের সমাজে ছিল না বললেই চলে, বিশেষ করে গ্রাম সমাজে।
এই আলোচনা বাংলায় খুব একটা চল নেই। গত কয়েক দশকে বাংলা তথা ভারতের সমস্ত জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য ধ্বংস করে গয়ে উঠেছে 'কেন্দ্র' উপসর্গওয়ালা কয়েকটি পশ্চিমী ধাঁচের শিক্ষা কেন্দ্র।
এই দেশজ গ্রামীন, অপ্রাতিষ্ঠানিক, বিকেন্দ্রীভূত জ্ঞানচর্চা বাংলায় হয় নি বললেই চলে, বাংলায় তাই ধরমপলাজী প্রায় অশ্রুত ব্যক্তি।
তাঁর জীবনী আলোচনা এখানে অবান্তর - শুধু না বললেই নয় যে সব কথা - তিনি ভারতে গত এক শতক ধরে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত চর্চিত পশ্চিমি সাম্যবাদের ধারার বাইরে দাঁড়িয়ে ভারতীয় সাম্যবাদের চর্চা করেছিলেন, যে সাম্যবাদের ভিত লুকিয়ে রয়েছে গ্রাম সমাজের জ্ঞানচর্চায়।
সেই দেশচর্চার কুড় আমরা পেয়েছিলাম ধরমপালজীর কাজে।
তিন দশক আগে একটি সাক্ষাতকারের বাংলায় অনুদিত কিছু অংশ তুলে দেওয়া গেল। কয়েকটি ধারাবাহিকে প্রকাশ পাবে -
কৃষ্ণণঃ প্রথমেই খুব বস্তাপচা প্রশ্ন করছি। আপনি কেন এবং কিভাবে ব্রিটিশপূর্ব বিশেষ করে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের ভারতের সমাজ জানতে উৎসাহী হলেন। আপনাকে এই প্রশ্নটি করছি, কেননা আপনি তথাকথিত শিক্ষাগতভাবে (বিশ্ববিদ্যালয়ে) গবেষক/জ্ঞানচর্চক নন।
ধরমপালঃ আমি দীর্ঘদনধরে এসোসিয়েশন আব ভলান্টারি এজেন্সিজ ফর রুরাল ডেভেলাপমেন্ট(এভার্ড)এর জড়িয়েছিলাম। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত আমি এর সম্পাদক থেকেছি। এভার্ড আমাদের গ্রামের পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থা জানতে উৎসুক ছিল। এই সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি, ভারতীয় সমাজে পরম্পরাগত ভাবনা বা বিশ্বাসের সঙ্গে বিদেশের দিকে দৃষ্টি রেখে বেড়ে ওঠা মানুষদের দুস্তর ব্যবধান। শহুরে মানুষেরা দেশের সমাজ ব্যবস্থা জানেনইনা বলা যেতে পারে।
এ সম্বন্ধে আপনাকে আমি একটা বাস্তব উদাহরণ দিতে পারি। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বুঝতে, এবং তা নিয়ে কাজ করা একটি দলের সঙ্গে আমি রাজস্থান গিয়েছিলাম।আমরা দেখলাম পঞ্চায়েত একটি নতুন বাড়ি তৈরি করেছে। তার কাজগপত্র পরীক্ষা করে দেখলাম যে পঞ্চায়েতে এই বাড়িটা তৈরি করা নিয়ে কোনো তথ্য রাখা নেই। খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে বিশ) পঞ্চায়েত(২০টি পঞ্চায়েতের সংগঠন – উত্তর বাংলায় যেমন বাইশা পঞ্চায়েত নামে একটা ব্যবস্থা ছিল)। এটি একটি পঞ্চায়েত, যা পরম্পরাগতভাবে গ্রামে কাজ করে, এবং এর সঙ্গে বাস্তবে যে নিয়মতান্ত্রিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তার কোনো মিল নেই।
এটি একটি শেখার ব্যাপার ছিল আমাদের কাছে – বুঝতে চাইলাম যে গ্রামের মানুষ কি ভাবে কোনো বিষয়কে দেখে, এবং তাঁরা বাইরের নানান ধাক্কায় কিভাবে প্রভাবিত হয়। বুঝলাম, আমরা কত কম গ্রাম সম্বন্ধে জানি। অন্ধ্র, তামিলনাড়ু এবং অন্যান্য এলাকায় আমরা কাজ করতে গিয়ে এই একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। ১৯৬৩-৬৫ পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি তামিলনাড়ুতে যাই। বিভিন্ন জেলায় গিয়ে পঞ্চায়েতের কাজের সঙ্গে জুড়ে থাকা নানান মানুষের সঙ্গে কথা বললাম, এবং পঞ্চায়েত কিভাবে চলে তারও একটা আঁচ নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তাঞ্জোরে আমি স্থানীয় ভারত সেবক সমাজের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে জানান তাঞ্জোরের আশেপাশে ১৯৩৭ সাল থেকে ১০০টিরও বেশি সমুদায়ম গ্রামের আস্তিত্ব রয়েছে। সমুদায়ম গ্রাম হল এমন একটা গ্রাম যেখানে সময়ে সময়ে গ্রামের জমির চাষের অধিকার বিভিন্ন পরিবারের ওপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বর্তায়, অথচ জমির অধিকার কিন্তু সামগ্রিক সমাজের থাকে। এই ব্যবস্থাটি প্রয়োজন হয় কেননা, বহু সময়ে জমির উর্বরতা, নদীর ঢাল, ইত্যদির মত নানান বিষয় পরিবর্তিত হলে জমি চাষের ব্যবস্থাও পরিবর্তিত হয়। তখন জমি চাষের অধিকার নতুন করে ভাগ হয়।
আমি পরে রাজস্ব সমীক্ষায় দেখি, ১৮০৭ সাল পর্যন্ত তাঞ্জোরের অন্তত ৩০ শতাংশ সমুদায় গ্রাম ছিল। আষ্টাদশ শতের শেষ দিকের আর উনবিংশ শতের প্রথমের দিকের যত ব্রিটিশ তথ্য দেখেছি, তত আমি বুঝতে পারলাম আমরা ভারতীয় সমাজ নিয়ে যে সব ধারণা করেছি, সব ভুল ছিল। আমি এই কাজটি সারাজীবন ধরে করেছি, আমার ধারণা সকলের এই রাস্তায় গবেষণা করলে, নতুন তথ্যে উপনীত হতে পারবেন।
(এর পর পরের প্রকাশনায়)
No comments:
Post a Comment