জগদীশ নারায়ণ সরকার
পঞ্চম অধ্যায়
সিংহাসন দখলের লড়াই
প্রথম পর্ব
খ্বোয়াজার লড়াই
১। কোরায় মীর জুমলার আওরঙ্গজেব দর্শন
খণ্ডেশ এবং কর্ণাটকের বিষয়গুলি তখন মীর জুমলা সমাধান করার চেষ্টা করছেন। অন্যদকে আওরঙ্গজেব দারার বিরুদ্ধে পূর্ণদ্যমে লড়াই করার পরিকল্পনা রচনা করে দিয়েছেন। ১৬৫৮র সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে আওরঙ্গজেবের যে সব সেনাপতি দারার বিরুদ্ধাচরণ করছিল, তাদের পাঞ্জাব থেকে দিল্লিতে ডেকে নিয়ে আসা হয় সুজার আগ্রগমণ রোধ করার জন্য। মীর জুমলাকে সম্রাট শীঘ্র দিল্লিতে ডেকে পাঠান। তিনি খণ্ডেশের প্রশাসন কিছু বিশ্বস্ত প্রশাসকের হাতে দিয়ে আসেন। সম্রাটের ইচ্ছে বাঙলার নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাজে মীর জুমলা তাঁকে পরামর্শ দিন, পথ দেখান, এবং জেতার পথ তৈরি করুণ। নভেম্বরের শেষে সুজার পথ রোধ করার জন্য আগ্রা থেকে আওরঙ্গজেব এলাহাবাদের দিকে মহম্মদ সুলতানের নেতৃত্বে একটি বিশাল বাহিনী পাঠান। শাহজাদাকে নির্দেশ দিলেন খুব তাড়াতাড়ি যুদ্ধে না গিয়ে উজির এবং তাঁর আগমণের জন্য অপেক্ষা করতে। পাদশাহ ২১ ডিসেম্বর কামান ইত্যাদি সাঁজোয়া অস্ত্র না নিয়ে ঝাড়া হাতপায়ে বড় বাহিনী নিয়ে শাহজাহার এবং কোরা-গৌতমপুরের সাম্রাজ্যের সৈন্যের খ্বোয়াজার থেকে আট মাইল দূরে ২ জানুয়ারি ১৬৫৯তে যোগ দেন। সুজা সেখানে ৩০ ডিসেম্বর পৌঁছে একটি বড় সমতল এলাকায় হাতে কাটা হ্রদের ধারে তাঁবু ফেলেন তার ইওরোপিয়দের নেতৃত্বের বিপুল দক্ষ গোলান্দাজ বাহিনী নিয়ে। সেখানে খবর পেলেন শাহজাদা তার পথ রোধ করেছেন। মীর জুমলাও খণ্ডেশ থেকে রওনা হন ছোট বাহিনী নিয়ে, পৌঁছন যুদ্ধের দু দিন আগে ৩ জানুয়ারি।
২। খ্বোয়াজায় মীর জুমলা
মীর জুমলার আগমণে সাম্রাজ্যের সেনার প্রস্তুতিতে চনমনে ভাব এল। ৩ জানুয়ারি আওরঙ্গজেব সম্ভবত মীর জুমলার পরামর্শে তার তৈরি করে দেওয়া প্রত্যেক বাহিনীর অবস্থান এবং যুদ্ধ সাজের রণনীতি সজ্জা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরের দিন। পরের দিন সকালবেলা থেকেই ছোটখাট গুলিবারুদ আদানপ্রদান হতে হতেই সুজার গোলান্দাজ বাহিনী তার প্রাথমিক শিবিরের অবস্থান ত্যাগ করে একটু উঁচু যায়গায় উঠে যায়। সেনায়কের মত যুদ্ধের পরিবর্তিত পরিস্থিতি বোঝার মত সহজাত দক্ষতায় সুজার বাহিনীর ছেড়ে যাওয়া স্থানটি দখল করে নেন মীর জুমলা। সেখানে খুব পরিশ্রম করে ৪০টি কামান তুলে নিয়ে শত্রুর সেনার দিকে তাক করে পরের দিনের সকালের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। আওরঙ্গজেব প্রত্যেক সেনানায়ককে তাদের বাহিনী যুদ্ধের জন্য চূড়ান্তভাবে তৈরি রাখার নির্দেশ দিলেন। সন্ধ্যে থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত মীর জুমলা স্বয়ং তাদের সেনা বাহিনীর প্রস্তুতি ঘুরে ঘুরে খুঁটিয়ে দেখেন এবং রক্ষীদের সজাগ থাকার নির্দেশ দিলেন।
৪ তারিখ রাতের যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর পক্ষে থাকা যশোবন্ত সিং বিশ্বাসঘাতকতা করে সুজার হয়ে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর ওপর গোলা ছুঁড়তে শুরু করেন। মানুচি বলছেন, এই বিপদগ্রস্ত সময়ে মীর জুমলা নিজে রণনীতি তৈরি করে নতুন করে সেনা সাজান এবং আওরঙ্গজেবকে পরামর্শ দেন সুজার পরামর্শেদাতা আলবর্দী খানকে ব্যক্তিগত ইঙ্গিতভরা চিঠি লিখে তাকে যুদ্ধের মাঝেই নিজের হাতির হাওদা থেকে নেমে আসার পরামর্শ দিতে, এবং তার জন্য তাঁকে যথেষ্টভাবে পুরষ্কৃত করা হবে। তবে সেই সময়কার কোন পার্সি সূত্র এই তথ্যকে সমর্থন করে না। তবে ভীমসেন বলছেন, যশবন্তএর শিবিরে মীর জুমলা তার পরিকল্পনা নিয়ে স্বয়ং পৌঁছে যেতে সক্ষম হন, এবং একটি ছোট্ট বৈঠকে তাকে রাজি করান এবং ফিরে এসে তাদের কথা আওরঙ্গজেবকে জানান। যাই হক যশোবন্তের বিশ্বাসঘাতকতার ব্যপকতাকে কিছুটা হলেও সামাল দিতে সমর্থ হন মীর জুমলা।
আগের দিনের সেনা সাজানোর পরিকল্পনা একই রেখেশুধু ডান দিকের যশোবন্তের বাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে ডাকা হয় ইসলাম খানকে এবং বাহিনীর সামনে নিয়ন্ত্রণহীন খোলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে মোতায়েন করা হয় সঈফ খানকে। তবে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে ক্ষমতা দিলেন যুদ্ধের অভিমুখ লক্ষ করে সেনাবাহিনীতে যা খুশি পরিবর্তন আনার।
খ্বোয়াজার যুদ্ধ দুপক্ষের মোটামুটি কামান, হাউই, গাদাবন্দুক এবং হাতে ধরা গ্রেনেড সজ্জিত সাঁজোয়া বাহিনীর লড়াই ছিল। দুপক্ষই দুপক্ষকে সমান তালে আক্রমণ করতে থাকে। যুদ্ধের দিনগুলিতে মীর জুমলা নিজেকে সম্রাটের হাতির পিছনের হাতিতে বসে তাঁকে যুদ্ধ চলাকালীন নানা রকম পরামর্শ দিচ্ছিলেন। সুজার বাঁ দিক থেকে তিনটি উন্মত্ত হাতি নিয়ে সাম্রাজ্যের ডানদিকের সৈন্য স্তম্ভে সৈয়দ আলম আক্রমণ করলে দাক্ষিণাত্যের বহু পোড়খাওয়া সেনা নায়কের সেনা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। শত্রু, কেন্দ্রে বসে থাকা সম্রাটকে আক্রমন করে। তাকে পাহারা দিচ্ছিলেন মাত্র ২০০০ সেনা। এটিই ছিল যুদ্ধের নির্ণায়ক সময়। সম্রাটের পালিয়ে যাওয়ার অর্থই হতবুদ্ধি হয়ে পড়া গোটা বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন। বরাবরের মত যুদ্ধে শান্ত, অকুতোভয়, পাহাড়ের মত স্থির হয়ে সম্রাট দাঁড়িয়ে থাকলেন। হাতির পাগুলি দৃঢভাবে জমিতে শৃঙ্খল দিয়ে আটকানোর নির্দেশ দিলেন যাতে সেটি ভড়কে গিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে। এইভাবেই তিনি যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। তার পরে সম্রাট ছত্রভঙ্গ হওয়া ডান দিকের সেনাবাহিনীকে দেখলেন এবং নতুন করে সাজানোর নির্দেশ দিলেন অবিকৃত মুখে, যাতে তারা তার আশ্বাসে নতুন করে বল পায়। এরপরেই সম্রাটের ডান, বাম এবং মধ্য – এই তিন দিকের বাহিনী সুজা বাহিনীর কেন্দ্রে গিয়ে আঘাত করে। সুজা তার হাতি থেকে নেমে পড়ে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করে পালিয়ে যায়।
সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিকেরা এই যুদ্ধ জয়ের জন্য সর্বশক্তিমানের হাত দেখেছেন কেননা বহু সময়েই সুজার আক্রমণে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর নানান ফাঁকফোকর খুলে হাট হয়ে পড়ছিল। আওরঙ্গজেবের শক্তি ছিল সেনাবাহিনীর প্রাচুর্য। অন্তত দ্বিগুণের বেশি সেনা ছিল আওরঙ্গজেবের বাহিনীতে। এছাড়াও সুজার সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতাও একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। কাম্বু বলছেন, মুরাদ কাম সাফাভি(মুকররম খান) এবং আব্দুল রহমান সুলতান(বলখের প্রাক্তন রাজা নজর মহম্মদ খানের পুত্র) পক্ষ পরিবর্তন করে সুজার সেনার দিকে আক্রমণ শানানোটাই সুজার ক্ষেত্রে অবাক হওয়ার মত ঘটনা এবং তার পরেই সুজার সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। তবে কোন সরকারি বা অন্যান্য ঐতিহাসিক কেউই মীর জুমলার অবদানের কথা উল্লেখ করেন নি, হয়ত তাদের মনে হয়েছিল তাতে সম্রাটের সম্মান হানি হবে। তবে কিছু পারসিক ইতিহাস এবং মানুচির লেখাতেই মীর জুমলার অবদানের কথা লিখত রয়েছে বিশদে। বিশেষ করে ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে সেই যুদ্ধে মীর জুমলা যুদ্ধের গতিবেগ সুজার থেকে আওরঙ্গজেবের দিকে নিয়ে আসতে তার ব্যক্তিগত দক্ষতার স্বাক্ষর পেশ করেছিলেন। মীর জিমলা যেহেতু আওরঙ্গজেবের দক্ষিণ হস্ত ছিলেন ফলে তার নিয়মিত মন্ত্রণাতেই আওরঙ্গজেব নিজের রণনীতি পাল্টেছিলেন, তার কুশলী বাক্য সম্রাটকে জোর দিয়েছিলেন বলা যায়। তবে মীর জুমলার বড় দক্ষতা ছিল সাঁজোয়া বাহিনীর গোলাগুলি ব্যবহারের কুশলতা তৈরি করানোয়। সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিকেরা লিখছেন বাঁশের মধ্যে বারুদ ভরে বিশেষ ধরণের হাউই তৈরি করেছিলেন তিনি। সেটি গ্রনেডের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর ছিল। বালেশ্বরের কুঠিয়াল সুজার হারের নিদান খুঁজেছেন, যে যুদ্ধে সুজা রণনীতির ভুলের জন্য ১২০০০ পদাতিক হারান। কুঠিয়ালের বলা নিদান কাম্বুর দেওয়া সূত্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, সেটি হল হাত হাউই (হুক্কাদারণ) যা বাতাসের মত করে উড়ে গিয়ে পড়ত বিপক্ষের বাহিনীতে আর ছত্রভঙ্গ করে দিত।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment