Tuesday, January 31, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৭০ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৫। মীর জুমলার মৃত্যুর প্রভাব
বার্নিয়ে লিখছেন, ‘মীর জুমলার মৃত্যুর সংবাদে ভারত জুড়ে উত্তেজনার ঝড় তৈরি হল। বাওরি(Bowery)ও লিখছেন, তার রাজ্যের জ্ঞানী এবং সুচিন্তিত মানুষকে দুঃখ সাগরে ডুবিয়ে, মীর জুমলা মারা গেলেন। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হল, তা অপূরণীয়। সে সব থেকে দক্ষ নবাবকে হারাল। ২৩ এপ্রিল মীর জুমলার মৃত্যু সংবাদ লাহোরে আওরঙ্গজেবের কাছে পৌঁছল। মাঝের কিছু সময় ইতিশাম খান প্রশাসন এবং রায় ভগবতী দাস বাঙলা রাজস্ব প্রশাসনের দেখাশোনা করতেন। বাঙলা আর দাক্ষিণাত্যে মীর জুমলার সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রের নামে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সেটি তার পুত্রের দখলে ফিরিয়ে দিল মুঘল সাম্রাজ্য। নাতি মীর আবদুল্লাসহ, মীর জুমলার পরিবারবর্গ, তার সম্পত্তি, হাতি ইত্যাদি নিয়ে ইতিশাম খান সম্রাটের নির্দেশে দরবারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। সম্রাট নির্দেশ দিলেন যতক্ষণনা বিহার থেকে দাউদ খাঁ এসে পৌঁছচ্ছেন, ততক্ষণ দিলির খাঁ সুবাদার হিসেবে কাজ চালাবেন, এবং সুবাদার হিসেবে শায়েস্তা খাঁ যতক্ষণ না এসে পৌঁছচ্ছেন ততক্ষণ দাউদ খানই প্রশাসন চালাবেন।

বাঙলার প্রশাসন থেকে মীর জুমইলার মত দক্ষ, কড়া এবং প্রভাবশালী প্রশাসক চলে যাওয়ার পরে সুবা জুড়ে চরম অরাজকতা এবং প্রশাসনের কাঠামোয় শিথিলতা নেমে আসে। খানইখানানএর কড়া চাবুকে যে সব স্বার্থবাহী নিরস্ত ছিল, তারা নিজেদের চরিত্র জানান দিতে থাকে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী আমলা এবং ব্যক্তিরা প্রকাশ্যেই তাদের স্বার্থ পূরণ করতে উঠেপড়ে লাগল। ইতিসাম খান চরম দুর্বিনীত হয়ে উঠলেন। পদমর্যাদায় এবং ব্যক্তিত্বে তার থেকে অনেক ধাপ ওপরে থাকা দিলির খান অসন্তুষ্ট হলেও মনোভাব প্রকাশ্য করলেন না। প্রত্যেকেই স্বজনপোষণের চরম শিখরে উঠতে লাগল। ক্ষমতাচ্যুত জমিদারেরা তাদের জমিদারি দখল নিলেন। শিহাবুদ্দিন তালিশ এই সময়টিকে জঙ্গলের রাজত্ব নাম দিয়ে লিখছেন, মীর জুমলার মৃত্যুর পর বাংলায় অবিচার এবং বিদ্রোহ ছেয়ে যেতে শুরু করল।

সামরিক বাহিনীতেও এর প্রভাব কম পড়ে নি। মীর জুমলার মৃত্যুর পর কোচবিহার দখলের পরিকল্পনা স্থগিত করা হল। মীর জুমলা এই কাজে যাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আকসর খানের জেদএ দাউদখানের সমস্ত প্রস্তাব এবং পরামর্শ বিফলে গেল। আকসর খান নিজের জমিদারি চাকলা ফতেপুর ফিরে পেতে উদ্যোগী হয়ে উঠলেন।

মীর জুমলার পরওয়ানা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার শর্ত নিয়ন্ত্রিত হত। মীর জুমলার সমস্ত শুল্ক/কর দেওয়া থেকে ব্রিটিশদের বাঁচিয়ে রাখার পদক্ষেপএর আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠল, কেননা শাহজাহানের পরওয়ানা তখনও নতুন সম্রাট সম্মতি দেন নি। মীর জুমলার সময়ের বাধ্যবাধকতা থেকে বেরিয়ে এসে সর্বস্তরের আমলা, সওদাগরেদের থেকে বহিঃশুল্ক দাবি করল। মীর জুমলা তাদের ফোর্ট জর্জের যে অধিকার ব্রিটিশদের দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা তার শাসনে বসা উত্তরাধিকারীরা কিভাবে দেখবে তাই নিয়ে সংশয় দেখা দিল। ডাচেরা সম্রাটের থেকে ফরমান নিয়েছে এই যুক্তি দেখিয়ে বালেশ্বর, পাটনা এবং মাদ্রাজের কুঠিয়ালেরা সুরাটের কর্তাদের আওরঙ্গজেবের থেকে নতুন ফরমান আদায়ের জন্য উদ্যোগী হতে অনুরোধ করলেন। সুরাটের কর্তাদের গড়িমসিতে ক্ষুব্ধ বাঙলার কুঠিয়ালেরা দেওয়ান রায় ভগবতী দাসের থেকে একটা নির্দেশ নামায় পরিষ্কার করে নিলেন মীর জুমলার পরওয়ানা তখনও কার্যকর রয়েছে।

সপ্তম অধ্যায়
প্রথম পর্ব
অসম অভিযানের মুখবন্ধ – কোচবিহার জয়
১। সুজার কবল থেকে বাংলার নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেওয়ার পরে পরেই ভীমবেগে মুঘল ভারতের উত্তরপূর্ব ভারতের অসম রাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা ছকে ফেলা হল। ইওরোপিয় লেখকেদের বক্তব্য মুঘল পাদশাহ ভেবেচিন্তেই তার রণকুশল সেনানায়ককে সব থেকে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন যাতে মীর জুমলা দিল্লি থেকে বহুকাল বহুদূরে থাকতে বাধ্য হন। এই আক্রমণের পরিকল্পনার পিছনে আরও একটা বিষয় কাজ করছিল, মীর জুমলা তার বাহিনীকে নিয়ে বার্মা হয়ে চিন অভিযানের স্বপ্ন দেখে বিশ্বজয়ী হবার বাসনা মনে মনে পোষণ করতেন। অসম বুরুঞ্জীর লেখকদের অভিযোগ যে মীর জুমলা তার স্বপ্ন সাকার করতে সম্রাটের অনুমতি পর্যন্ত নেন নি। তবে বাদশাহের যে ফারমানে(জুন ১৬৬০) মীর জুমলাকে বাঙলার সুবাদার নিয়োগ করা হয়েছিল, সেই নথিতেই তাকে বাঙলার ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণ করে,। তাকে অসম এবং আরাকানের রাজাদের আক্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক কাজটি ছিল পালিয়ে থাকা সুজাকে আরাকান থেকে প্রত্যার্পন। তবে মীর জুমলা আরাকান আক্রমণ সাময়িক স্থগিত রেখে প্রথমে কোচবিহার-অসম অভিযানের অনুমতি আওরঙ্গজেবের থেকে নিয়েছিলেন।
তবে আমাদের মনে হয় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল কোচবিহার-অসম জিতে শুধু সাম্রাজ্যের সম্মান বজায় রাখাই নয়, সাম্রাজ্যকে নিরাপদ রাখাও অন্যতম দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। ১৬৩৯ সালের অসম-মুঘল চুক্তি অনুযায়ী পশ্চিম অসমের গুয়াহাটি থেকে মানস(মানাহা) নদী পর্যন্ত ভূভাগটি ছিল মুঘল নিয়ন্ত্রণে। তাদের ফৌজদার গুয়াহাটি থেকে কামরূপ সরকার শাসন করতেন। ১৬৫৭য় শাহজাহানের অসুস্থতা এবং সুজার বাঙলা সুবার নিয়ন্ত্রণ ঢিলে হয়ে যাওয়া আর তার নৌবহর শক্তিহীন হয়ে যাওয়ার পরেই হাজো শুদ্ধ মানস থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের উত্তরতটের এলাকায় দুটি আগুন(মার্চ এপ্রিল ১৬৫৮) জ্বলে ওঠে।

পশ্চিম থেকে মুঘল অধিকৃত কোচবিহার রাজ্যের রাজা প্রাণনারায়ন স্বাধীনতা ঘোষণা করে প্রজা এবং মুসলমানদের ওপর অত্যাচার শুরু করে হাজোয় শিবির স্থাপন করে। পূর্ব থেকে আক্রমন করে রাজা জয়ধ্বজ সিংহের সেনানায়ক বরগোঁহাই তাংচু সান্দিকুই করতোয়া পর্যন্ত জমি দখল করার মানসিকতা নিয়ে। কোন প্রতিরোধ না করতে পেরে মুঘল ফৌজদার মীর লুফতুল্লা পালিয়ে আসে জাহাঙ্গীর নগর(ঢাকা)। সান্দিকুই কোচেদের হাজোয় পরাজিত করে তাড়িয়ে দেয় এবং হারার পর মুঘলদের সঙ্গে যৌথ লড়ায়ে কোচেদের প্রস্তাব সান্দিকুই প্রত্যাখ্যান করে, বারিতলা পর্যন্ত কোনরকম বাধা ছাড়াই এগিয়ে এসে হাটশিলা বা হাতডোবা(ঢাকা থেকে মাত্র কিছু দূরে কারিবাড়ি বা কারাইবাড়িতে)য় সেনা ছাউনি স্থাপন করে, মুঘলদের স্থানীয় বাজারে আসার নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং অত্যাচারের ঝাঁটাপেটা করে বহু মুঘলকে গ্রেফতার করে, তারা সেখানেই বসবাস করতে বাধ্য হয়।

মীর জুমলার বাঙলা প্রবেশের ঠিক আগে মুঘলদের মাথা ব্যথা ঘটানোর এই সব কাণ্ডগুলির কিছু আগে জাহাঙ্গীর আর শাহজাহানের সময় যথাক্রমে সৈয়দ আবু বকর এবং আব্দুস সালামকে অহোমেরা গ্রেফতার করে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে মুঘলেরা কিছু করতে পারে নি। আওরঙ্গজেবের কালে মীর জুমলা বাঙলার ক্ষমতা দখল করলে তাকে এইগুলির প্রতিশোধ নিতে বলা হয়। এটা যে শুধু সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা ছিল তাই নয়, তার কাছের ওয়াকিয়ানবিশ বলছেন, বিধর্মী অহমিয়াদের ওপর ধর্মযুদ্ধ চালাতে চাইছিলেন, যাতে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেওয়া যায়, মূর্তিপুজকদের শিক্ষা দেওয়া যায়, ইসলামি ধর্মাচারণের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলিয়ে নিতে বাধ্য করা যায় এবং অবিশ্বাসীদের আচার আচরণ নিষিদ্ধ করা যায়।
(চলবে)

বিশ্বায়ন ট্রাম্প আমেরিকার ভবিষ্যৎ বনাম গ্রামীন স্বয়ম্ভর অর্থনীতি

আনন্দবাজারের মাথায় আগুণ। ট্রাম্প অভিবাসীদের দেশে ঢোকা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্তেরও এই শীতে কাঁথায় আগুণ লেগেছে। ইংরেজি পরীক্ষা দিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে কর্পোরেট শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ে বিদেশে গিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হতে বড় যে দাসত্বের সুখ ছিল সেই দিন হয়ত ফুরিয়ে এল।
এই নিয়ে অরূপদা Arupsankarদা তার মত করে হুলফোটানোর মন্তব্য করেছেন ডেমন লুম্পেন ট্রাম্প-মে না ইহুদিদের মত সংস্কৃতিবান কর্পোরেট লিবার‍্যাল। এখন নিজের মাড়িতে আগুন লাগতে দেখে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সুখী গৃহকোণে অন্ধকার।
আমাদের ভাবনা---
প্রত্যেকটা কোম্পানিই ইহুদি নিয়ন্ত্রিত।ঐতিহাসিকভাবেই ইহুদি আর সাম্রাজ্যবাদী খ্রিষ্ট ধর্মের মধ্যে লড়াই আছে।
রথসচাইল্ডরাই দেশে দেশে টাটা, আম্বানিদের মত মুতসুদ্দি তৈরি করে - কোরাসের মূল ডিলটা তারাই করে, বিপুল টাকা তারাই জোগাড় করে দেয় - তাই ইওরোপে স্টিল সাম্রাজ্য রথসচাইল্ডদের বকলমে না রাখতে পেরে রতন টাটা পাগল হয়ে উঠেছে - কোরাসকে টাটা কোম্পানির মিস্ত্রি প্রশাসন বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া পর রথসচাইল্ডরা টাটার ওপর খেপে রয়েছে - মাথার ঘায়ে টাটা পাগল।
২০০৮এর পরে ইহুদি পুঁজির পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে, না হলে ট্রাম্পের জেতা সম্ভব ছিল না - মমতারও না, বা অভয় সাহুদেরও টাটাদের আটকানোর চেষ্টাও নয়।
ইরাকের যুদ্ধে আমেরিকা বেকায়দায় পড়ার পরে তেললবির অবস্থা বেশ শোচনীয়। তারাও ট্রাম্পের ক্র্যাচে ভর করে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে - মিলিটারি শিবির বিশ্ব থেকে তুলে নেওয়ার কথা বলা বা টিপিপি থেকে বেরিয়ে যাওয়া ইহুদি লবিকে সমঝে দেওয়ার চক্কর।
জর্জ সোরেসের মাধ্যমে ঘোমটার পিছন থেকে রথসসচাইল্ডেরা খেলছে। এক্সন, মোবিলেও বিপুল বিনিয়োগ আছে তাদের। কিন্তু সুবিধের আমেরিকায় তেল কোম্পানিগুলি কার্টেল চালাতে পারে না। সেখানে একচেটিয়া ব্যবসা করার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে কোম্পানিগুলোকে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
সবার আগে ইহুদি ফিনান্স ক্যাপট্যালকে দুর্বল করতে হবে। এরাই বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানি তৈরি করে বিশ্বকে চুষেছে, সেই সুদেই আমেরিকা ইওরোপ আজও চলছে। এখনও আসলে হাত পড়ে নি।
ট্রাম্প যদি আমেরিকার অর্থনীতির এতদিনকার ইহুদি নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হলেও শিখিল করতে পারে, তাহলে বিশ্বসাম্রাজ্যপুঁজিবাদীদের মধ্যে বিপুল পরিবর্তন আসবে। তার মুখবন্ধ হয়ে গিয়েছে টিপিপি থেকে আমেরিকার বেরিয়ে যাওয়ায়। এর পর যদি সারা বিশ্বের সামরিক ঘাঁটি তুলে নিতে পারে - তাহলে ঠাণ্ডা ঘরে বসে ভারতীয় মধ্যবিত্তের সুখের চাকরির দিন শেষ। সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্গালোর সাইবারাবাদ থেকে দলে দলে ভারতে আর নোংরা শহরগুলোয় ফিরতে হবে।
ট্রাম্প আর থেরেসা মে কতটা তথাকথিত লিবারেলদের চাপের মুখে, প্রতিবাদের মুখে দক্ষিণপন্থী তাত্ত্বকিতায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সেটাই দেখার। কোণঠাসা ফিনান্স পুঁজির শোকগাথা হয়ত লিখতে হতে পারে এই দশকেই।
আমারা গ্রামীন অর্থনীতির চালক। আমাদের ক্ষতি নেই - গতর খাটিয়ে খাই, নিজের যন্ত্র দিয়ে নিজে উতপাদন করি নিজের এলাকার কাঁচামাল ব্যবহার করি - কে কোথাকার বিদেশি হনু দেশীয় অর্থনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল তো গ্রামীন অর্থনীতির বয়েই গেল - আমার হাট আমার বাজার - আমরা মোদির টাকা বাতিলকে গিলে খেয়ে নিলাম।
আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে পরের ওপরে গতর নয় বুদ্ধি খাটিয়ে খাওয়া মধ্যবিত্তের মাখন মাখন সন্তানের ওপর।
আমেরিকা বিদেশিদের আটকে দেওয়ার যে পরিকল্পনা করেছে তার ১০০ শতাংশ সমর্থন রয়েছে আমাদের। কতটা পারবে বলা মুশকিল - সাদা চামড়ার মধ্যবিত্তের খেটে খাওয়া সন্তানদের আমাদের দেশের পরজীবি মধ্যবিত্তের মত অবস্থা। ছোট চাকরি তারা করতে চায় না - যেমন এককালে কলকাতায় বাঙালি হকার খুব কম ছিল, ট্যাক্সিওয়ালা খুব কম ছিল - আর ফুচকাওয়ালা তো গোটাটাই ঝাড়খণ্ডী - প্লাম্বারেরা ওডিয়া। আমেরিকার সেই চাকরিগুলো বাইরে থেকে আসা মানুষেরা করে।
ট্রাম্প যদি আমেরিকার সাধারণ মানুষকে ছোট চাকরি করাতে পারে, ছোট ব্যবসা করাতে পারে তাহলে আমরা ট্রাম্পকে দুহাততুলে সমর্থন করব। আমারিকার সাদা/কালো কারোর চাকরি বিদেশি কারোর খাওয়া চলবে না - এটাই হওয়া দরকার।
দেখা যাক ট্রাম্প আর সমুদ্রের ওপারে আরেক মহিলা কতটা এই চাপ নিতে পারে। আমাদের অনেক আশা। লিবারেলদের তো দেখলাম। ভেড়ুয়া দক্ষিণপন্থী তাত্বিকদেরও দেখলাম।
ট্রাম্প আর মে'র লুম্পেন দক্ষিণপন্থা বিশ্বকে কোনদিকে নিয়ে যায় দেখা যাক না।
Saikat তোমার ঋণ কিছুটা শোধ করলাম।

বাংলার উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা১ বাংলায় মহিলাদের স্থান


উপনিবেশ পূর্ব বাংলায় মেয়েদের স্থান নিয়ে মোটামুটি একটা ঐক্যমত্য রয়েছে, বাংলার মেয়েরা অন্তঃপুরে বসবাস করতেন, পুরুষদের অনুগামী হতেন, তাঁদের সমাজ, সরকার চালানোয় খুব একটা বেশি ভূমিকা ছিল না। বিশেষ করে নবাবী পরিবারগুলোয় সরকার পরিচালনায়, হারেমে থাকা মেয়েদের পর্দার আড়ালে থাকতে হত। এ বিষয়ে ঔপনিবেশিক পণ্ডিতদের মধ্যে মোটামুটি মতৈক্য রয়েছে। অথচ, গুলবদনের হুমায়ুননামাকে, বা মুঘল আত্মচরিতগুলিকে নতুন করে দেখছেন রুবি লাল, কিভাবে ভাষা না জেনে এই অনুবাদগুলি করার বিষ ফল ফলেছে ইতিহাস রচনায় গত একশ বছরে - বিশেষ করে মেয়েদের স্থান নির্বাচন নিয়ে।
কিন্তু ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নানান কাজ এই ঔপনিবেশিক মিথ-মিথ্যেগুলি ছারখার করে দিচ্ছে। তিনি বলছেন এমন কিছু বিষয়, যা অন্তত বাংলায় ঔপনিবেশিক পাঠ্যক্রমে পড়ানো হয় না। তাঁর মুঘল বিদুষী এমনই এক পথভাঙা পুস্তক। তাঁর একটি ছোট বই রয়েছে যার নাম বেগমস অব বেঙ্গল। এই বইটি অবলম্বন করে উপনিবেশ পূর্ব রাজ্ঞীদের বিষয়ে কিছু লেখা প্রকাশ করা যাবে আজ ও আগামীতে।
আজ আলিবর্দী খাঁর স্ত্রী, সেরাজের মাতামহ সর্ফুন্নিসা
আলিবর্দি কাঁটার মুকুট মাথায় নিয়ে বাংলার তখতে বসলেন। ঔরঙ্গজেবের ‘পাহাড়ি ছুঁচো’ মারাঠারা দিল্লির নবাবের ফরমান বলে বাংলায় চৌথ চাইতে আক্রমণ করে। নেতৃত্বে প্রথমে ভাষ্কর পণ্ডিত, পরে দেওয়ান রঘুজি ভোঁসলে। আলিবর্দি বর্ধমানে এই আক্রমণকারীদের সঙ্গে মুখোমুখি হন। যুদ্ধ শুরু হয়। ক্লান্ত নবাবী সৈন্যরা মারাঠাদের আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়তে থাকে। নবাবের বেগম সর্ফুন্নিসা ছিলেন যুদ্ধের সম্মুখে। বেগমের হাতি লন্ডাকে আক্রমণ করে মারাঠারা। প্রায় ধরা পড়তে পড়তে সেনাপতি উমর খানের পুত্র মুসাহিব খান মহম্মদের বীরত্বে বেঁচে বেরিয়ে আসেন তিনি (রিয়াজুসালাতিন, ৩৩৮-৩৯)।(দুরদানা বেগম নবাব সরফরাজ খাঁয়ের বোনও সে সময়ের বাংলার এ রকম প্রভাবশালী মহিলা ছিলেন। তিনি ওডিসার শাসক মুর্শিদকুলি খাঁএর স্ত্রী। তাঁর স্বামীর থেকে অনেক বেশি সম্মান পেতেন তিনি। ভাইযের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য স্বামীকে প্ররোচিত করলেও আলিবর্দীর বড় সৈন্যবাহিনী আর তাঁর যুদ্ধ করার ক্ষমতার জন্য তাঁর সঙ্গে লড়াই করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। শেষে তিনি স্বামীকে বলেন, তিনি তাঁর কথা না শুনলে, স্বামীকে পদচ্যুত করে ওডিসার শাসক বানাবেন তাঁর জামাই আলি বাকির খাঁকে। স্ত্রীর ইচ্ছেয় তাঁকে মাথা নোয়াতে হয়।)বলা দরকার মারাঠা খুনি বর্গীদের আক্রমণে সামনাসামনি হওয়ার আগেই সর্ফুন্নিসা, আলিবর্দীর সঙ্গে মুর্শিদকুলি খাঁয়ের বিরুদ্ধে ওডিসা উদ্ধারে বালেশ্বরের যুদ্ধে লড়তে যান।
আলিবর্দী ভাষ্কর পণ্ডিতকে চতুরতার সঙ্গে হত্যা করলে সেই হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য নতুন করে বিশাল বাহিনি নিয়ে নাগপুরের রাজা রঘুনাথ ভোঁসলে বাংলা আক্রমণ করেন। নবাব এই আক্রমণের সামনাসামনি হন। কিন্তু তাঁকে এই লড়াইতে বেশ বেগ পেতে হয়, তাঁর আফগান সেনাপতি শামসের খানের বিশ্বাসঘাতকতায়। মুতাক্ষরিণের লেখক, নবাবের আত্মীয় গুলাম হুসেইন লিখছেন, ‘...আমার মনে আছে, নবাবের বেগমের মহলে উপস্থিত হয়েছি, তখন চিন্তিত নবাব ঢুকলেন। তাঁর চিন্তিত মুখ দেখে রাজ্ঞী প্রশ্ন করলেন। তিনি বললেন, আমি জানি না কি কি ঘটে চলেছে; তবে আমাদের সেনাবাহিনীতে কিছু কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে দেখছি। রাজ্ঞী তখন রঘুনাথ ভোঁসলের কাছে দুজন বিশ্বস্ত মানুষকে তাঁর পক্ষ থেকে পাঠান। তাঁর প্রস্তাব ছিল, তাঁরা তাঁর নাম করে মারাঠাদের সঙ্গে কোন একটা মিটমাটের চেষ্টা করবেন। দুজন রাজ্ঞীর হয়ে মীর হাবিবের কাছে পৌঁছান। মীর হাবিব তাঁদের রঘুনাথজীর কাছে উপস্থিত করেন। রঘুনাথজী রাজ্ঞীর প্রস্তাবে সম্মত হলেন।
ততদিনে নবাবের চরম বিরোধী, মীর হাবিব রঘুজীর শিবিরে যোগ দিয়েছেন। হাবিব, সর্ফুন্নিসার পাঠানো প্রস্তাবে রাজি হলেন না, বরং রঘুজীকে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্ররোচিত করেন। তাঁর যুক্তি মুর্শিদাবাদের সৈন্য বিহীন সেনাপতি, নওয়াজিশ মহম্মদ খাঁ মারাঠাদের সাহায্য করবেন – মোটামুটি রঘুজী হাবিবের এই প্রস্তাবে রাজি হন। সিদ্ধান্ত হল, রঘুজীর বাহিনী নবাবের আগে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করে সেই শহর দখল করে নেবে। উল্লসিত রঘুজী মুর্শিদাবাদের পথ ধরলেন। তাঁর পিছনে ধাওয়া করল বাংলার সেনা।’
কাটোয়ার কাছে যুদ্ধে রঘুজী প্রায় সমস্ত সেনা হারালেন এবং মারাঠারা চিরতরে বাংলা ছাড়তে বাধ্য হল।
এর পর আলিবর্দি মারাঠাদের সঙ্গে হাত মেলানো আফগান সর্দারদের পদচ্যুত করলেন। তাঁরা প্রত্যাঘাত করে। নবাবের জামাই পাটনার প্রশাসক, নবাবের জামাই, জৈনুদ্দিনকে হত্যা করে তাঁর স্ত্রী আমিনা বেগমকে গ্রেফতার করে। পরে যুদ্ধে তাঁদের পরাজিত করে আমিনা বেগম উদ্ধার হয়।
(ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেগমস অব বেঙ্গল থেকে)
বাংলার উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা২
বাংলায় মহিলাদের স্থান

আলিবর্দী খাঁর স্ত্রী, সেরাজের মাতামহ সর্ফুন্নিসা
জৈনুদ্দিনের হত্যার পর সৈয়দ আহমেদ খাঁ পাটনার প্রশাসক হন। সৈয়দ আহমদ, জৈনুদ্দিনএর সময়ের আমীরদের প্রাপ্য বরাদ্দ, পদমর্যাদা বাড়িয়ে দেন। মুতক্ষরীনের লেখক লিখছেন, রাজ্ঞী, তাঁর স্বামীকে সৈয়দ আহমদএর এই হাত খোলা ব্যয় আর পূর্বতন প্রশাসকের মৃত্যুর জন্য পরোক্ষে যারা দায়ি তাঁদেরকে রসেবসে রাখার প্রবণতার বিরুদ্ধে রায় দেন। তাঁর মতে আজিমাবাদ বাংলার প্রবেশ দ্বার। প্রশাসক যদি এরকম ঢিলেঢালা আবিশ্বাসী হয়, তাহলে যে কোন সেনা বাহিনী তাঁর অজ্ঞাতে বা তাঁকে হাত করে বাংলায় ঢুকে আসতে পারে। এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ পদ এ ধরণের মানুষের হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিরোধী তিনি। আশংকা ছিল তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর এই মানুষটা তাঁর কন্যা আর দুই নাতি সেরাজউদ্দৌল্লা আর ইক্রমুদ্দৌল্লার প্রাণ নাশ করতে পারেন। তিনি স্বামীর সঙ্গে এই পরামর্শ করে তাঁকে আরও উপযুক্ত প্রশাসক নিযুক্ত করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তাঁর স্বামী এই প্রস্তাব মেনে নেবেন কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত না হয়ে, তিনি সৈয়দ আহমদএর বিরুদ্ধে গলা তুলে বলতে সেরাজকে প্ররোচিত করলেন। বললেন সিরাজকে নবাবের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যেতে। সেরাজ তাঁর ঠাকুমার শেখানো কথা নবাবকে বললেন। নবাব সেরাজের স্নেহে আপ্লুত ছিলেন। নবাব বুঝেছিলেন, এই প্রস্তাবটি দিয়েছেন সর্ফুন্নিসাই। তাঁর রাজ্ঞীর প্রস্তাবকেই আলিবর্দী মেনে নিয়ে সবাইকে বঞ্চিত করে সেরাজকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।
সর্ফুন্নিসা আর দুই কন্যার উপর খুব বিরক্ত ছিলেন। বড়টি ঘসেটি ঢাকার প্রশাসক হুসেইন কুলি খাঁর গোপন প্রেমিকা ছিলেন। তাঁর প্রশ্রয়ে হুসেইন কুলির বহু আপরাধ ক্ষমার চোখে দেখা হত। হঠাত ঘসেটিকে ছেড়ে হুসেইন কুলি সেরাজের মা’র গোপন প্রেমিক হলেন। ঘসেটি তাঁর শত্রু হয়ে ওঠেন। এই গোপন সত্য ঢাকা থাকল না। মেয়েদের বেহায়াপনা দেখে সর্ফুন্নিসা নবাবের স্মরণাপন্ন হলেন। তিনি তাঁর মৃত্যুদণ্ড চাইলেন। নবাব সহজে রাজি হলেন না। সিরাজকে দিয়ে ঘসেটির সাহায্যে হুসেইন কুলিকে ১৭৫৪ সালে হত্যা করাণ সর্ফুন্নিসা।
তাঁর শেষ জীবন খুব কষ্টে কাটে। পলাশীর চক্রান্তে মীর জাফর মসনদে আহরণ করেন। মীরণ সর্ফুন্নিসা, আমীনা, ঘসেটি, সিরাজের বিধবা লুতফুন্নিসা আর তাঁর শিশুকন্যাকে বন্দী করে ঢাকায় অন্তরীণ করেন। মীরণ ঘসেটি আর আমীনাকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করেন। লুতফুন্নিসা, তাঁর শিশুকন্যা আর সর্ফুন্নিসা বেঁচে যান। তাঁরা মুর্শিদাবাদের ফিরে আসেন। ১৭৬৫তে সর্ফুন্নিসা, সরকারকে তাঁর খোরপোষ বাড়াবার জন্য আবেদন করেন।
(ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেগমস অব বেঙ্গল থেকে)

Monday, January 30, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - যোগেন মণ্ডলের রাজনীতি বনাম শূদ্র-কারিগর-দার্শনিক, গ্রামভিত্তিক ব্যবস্থা


শূদ্ররা ভারতের গ্রাম ব্যবস্থার তাত্ত্বিক, দেশের আর্থব্যবস্থার, শ্রুতিভিত্তিক জ্ঞানচর্চা ব্যবস্থার অক্ষদণ্ড
উপনিবেশের চাপিয়ে দেওয়া বড়পুঁজির ছাপাখানাজাত কেন্দ্রনিয়ন্ত্রিত লেখাপড়া ভিত্তিক ভদ্রলোকিয় ব্যবস্থার পাল্টা দর্শনে জারিত

যোগেন মণ্ডল আর তার রাজনীতি নিয়ে Souvik প্রশ্ন তুলেছেন। পালটা প্রশ্ন তুলেছেন Dipankarদা। এ তর্ক-বিতর্কে মাথা ঢোকাতে না চাইলেও মনে হল তত্ত্বগতভাবে শূদ্র উতপাদনব্যবস্থার উতপাদক অভিকর শিল্পীদের সংগঠনের অবস্থান পরিষ্কার করে দেওয়া প্রয়োজন।
.
...ভারত আজও শূদ্র সভ্যতা। আজও। ভারত। ইন্ডিয়া নয়। সংখ্যালঘু উচ্চবর্ণের শাসনভুক্ত ইন্ডিয়া মূলত বড় পুঁজির, কেন্দ্রিয় শিক্ষা, উতপাদন ব্যবস্থার রক্ষক। সে গ্রাম-সংহার নীতির প্রচারক, যাদের প্রধান উদ্দেশ্য কেন্দ্রবিহীন গ্রাম ব্যবস্থাকে শহুরে একতান্ত্রিক ব্যবস্থা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা।
যোগেন মণ্ডল বা আরও প্রখ্যাত শূদ্র নেতারা যে সংসদীয় রাজনীতি করেছেন সেটি বড় পুঁজি নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার ভদ্রলোকিয় রাজনীতি। অথচ ভারতের শূদ্ররা প্রাচীন কাল থেকেই ক্ষমতার রাজনীতির সরাসরি বিরোধী, তাদের জীবনের সঙ্গে সেই রাজনীতির একটা বিপ্রতীপ অবস্থান রয়েছে। সেই অবস্থা 'যোজন প্রমান দূরত্ব' শব্দবন্ধ দিয়ে বোঝানো যাবে না, এই ব্যবস্থা শূদ্রচর্যা বিরোধী। তাদের হাজার হাজার বছরের অকেন্দ্রিত গণতন্ত্রের চর্যার সঙ্গে বড়পুঁজির চাপিয়ে দেওয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের, যা আসলে রকমফেরে বড়পুঁজিরইএকনায়কতন্ত্র, মিল নেই।
বড় পুঁজির, কেন্দ্রিভূত ক্ষমতার সেবাদাস রাষ্ট্রর নীতি বা উদ্দেশ্যর সঙ্গে শূদ্র জীবনধারণ পদ্ধতি, উদ্দেশ্য বিন্দুমাত্র খাপ খায় না। এই সমাজ থেকে যারাই সংসদীয় ক্ষমতার রাজনীতি করেছেন, বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন মূল সমাজ থেকে। উচ্চাসনে বসেছেন। ১১৫৭/১৭৬৩ সাল থেকেই শূদ্রদের স্বাধীনতার তেজ দমন করা ঔপনিবেশিতায় লেপ্টেলুপ্টে থাকা সান্ত্রী পরিবেষ্টিত পরিবেশে মন্ত্রী, চাকুরে হয়েছেন। তারপরে তাদের মনে হয়েছে, দেশিয় শূদ্র জ্ঞানচর্চা উতপাদন ব্যবস্থা ত্যাগ করে ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চা, শিক্ষাব্যবস্থা বরণ করাই ভারতের শূদ্রদের ভবিতব্য - তারা চেষ্টা করেছেন শূদ্রদের নিদান দিয়ে সরকারি, কর্পোরেটে চাকরি করে 'নিজের পায়ে দাঁড়াতে' ভদ্রসভ্য হয়ে সংখ্যালঘু ভদ্রলোকীয় ব্যবস্থার জনসংখ্যা বাড়াতে - ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা শূদ্রকে বড় পুঁজির সেবাদাস করবে তা তারা ঠারেঠোরে মেনেই নিয়েছেন, মেনে নিতেও বলেছেন।
ঠিক একই কথা বলা যায় শৌভিক যাদের যোগেন মণ্ডলের উত্তরাধিকারী বলছেন সেই মতুয়া সম্প্রদায়ের সম্পর্কেও। শূদ্রদের জীবনধারণ বিষয়ে ঠাকুর হরিচাঁদের নিদান অসাধারণ, শূদ্র সমাজ দর্শনের অনুসারী, আজও কোটি কোটি গ্রামীন শূদ্র মতুয়া সেই পথের অনুসারী। অথচ বর্তমান 'শিক্ষিত' মতুয়া তাত্ত্বিকদের নিদানে শূদ্র ‘পিছিয়েপড়া’ দারিদ্র, মুর্খতার জীবন-দর্শনের অস্বস্তি লক্ষ্যনীয়। শূদ্ররা কারিগর, দার্শনিক, গ্রামভিত্তিক ব্যবস্থার তাত্ত্বিক, দেশের আর্থব্যবস্থার অক্ষদণ্ড, শ্রুতি ব্যবস্থার অক্ষদণ্ড - চাপিয়ে দেওয়া ছাপাখানভিত্তিক লেখাপড়া ভিত্তিক ভদ্রলোকিয় ব্যবস্থার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই ক্ষমতার রাজনীতি তাকে সেই জ্ঞানচর্চা, সেই জীবনধারন, সেই দার্শনিকচর্যা থেকে বার করে নিয়ে এসে ভদ্রলোকিয় ঔপনিবেশিক বড় পুঁজির সেবাদাস চাকুরে হিসেবে, খুব বড় হলে কর্পোরেট উদ্যমী হিসেবে দেখতে চায় - যার জীবনের উদ্দেশ্য হবে শেষমেশ বড়পুঁজির আজ্ঞাবহ হওয়া।
ব্রিটিশপূর্ব ভারতে প্রচুর শূদ্র রাজা ছিল, শূদ্ররা জীবনের অভিমুখ বদল করেন নি, তারা তাদের শেকড়েই রয়ে গিয়েছেন দেশের ২০ শতাংশের জীবনে এই ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার পরেও। গত ৬০-৭০ বছর ধরে যারা ঔপনিবেশিক ক্ষমতার রাজনীতি করছেন, তারাও চাইছেন বড় পুঁজি যে গ্রাম উতপাদন-সংস্কৃতি-দর্শন-বিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করেছে সেখানে শূদ্রদের টেনে নিয়ে আসার যাতে গ্রাম উতপাদন ব্যবস্থার ধ্বংসকর্মর উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়।
---
অপেক্ষা করছি, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা শূদ্রদের জীবনে সহনীয় করে তুলতে চাষার ছেলে চাষা হবে কি, এই বৌদ্ধ দর্শন অনুসরণ করেছিলেন যে সব তাত্ত্বিক, শূদ্র গ্রাম ভিত্তিক উতপাদন তত্ত্ব বাতিলের কলমপাতে এগিয়ে আসেন কি না।

Sunday, January 29, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৬৯ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৩। বাংলায় মীর জুমলার আর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক কাজকর্ম
কর্ণাটকের মতই বাংলাতেও মীর জুমলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল চরিত্রিটাই হল একচেটিয়া ব্যবসা। বাঙলার সুবাদারির সুবাদে তিনি নানান পণ্য নিজের শর্তে একচেটিয়া কারবারী রূপে কিনে তার শর্তেই সেগুলি বিক্রি করতেন। ১৬৬০ সালে মীর জুমলা ব্রিটিশ কোম্পানিকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সোরা সরবরাহ করার প্রস্তাব দেন। মাদ্রাজের কুঠিয়ালের মন্তিব্য তিনি এই পদক্ষেপটি করেছেন এক্কেবারে ব্যক্তিগত লাভের জন্য। সেই সময়ে পাটনার ব্রিটিশ কুঠিয়ালকে ৩০০০০ থলে(৬০০০ মণ) ধারে সোরা সরবরাহ করেন।

নভেম্বর ১৬৬১ সালের ডাচ নথি থেকে পাচ্ছি মীর জুমলা কী ধরণের দাম চড়াতেন। ঢাকার এক শস্য কারবারির থেকে মীর জুমলা ৫০,০০০ টাকা দাবি করেন, আজকের অর্থনীতিতে এটিকে অতিরিক্ত লাভ্যাংশ কর হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ডাচ সূত্রটি জানাচ্ছে মীর জুমলা দাবি করেন, কোচবিহার অসম অভিযানের আগে তার শিবিরে চাল সরবরাহ করে সেই ব্যবসায়ি দ্বিগুণ লাভ করেছেন। তারা ১০০০০ টাকা দিতে চাইলে তিনি নিজের লগুড় চালাতে শুরু করেন, এবং তার ফলে তারা ২৫০০০ দিতে বাধ্য হয়। এধরণের অত্যাচারে ঢাকার এক ব্যাঙ্কার ৩০০০০০ দিতে বাধ্য হয়।

১৬৫৮ সালে হুগলীর দেওয়ান মালিক বেগ ব্রিটিশদের থেকে কাস্টমস শুল্কের জায়গায় বার্ষিক ৩হাজার(জুন ১৬৫৮) টাকা দাবি করে এই যুক্তিতে যে বর্তমানে প্রাক্তন শাসক শাহজাহান আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দী ফলে শাহজাহানের জারি করা কোন ফরমানই প্রযুক্ত হবে না। পরের বছর বালেশ্বরের প্রশাসকও বন্দরে জাহাজ ভেড়ানোর বিপুল শুল্ক দাবি করেন। ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা দুটি দাবিই মানতে অস্বীকার করায় দুপক্ষের মধ্য তিক্ততা আরও বাড়তে থাকে। ১৬৬০-৬১ সালে হুগলীর ব্রিটিশ এজেন্ট মীর জুমলার অত্যাচারে ‘অতিষ্ঠ’ হয়ে তার বাণিজ্য নৌবহরের একটি দেশি নৌকো দখল ক’রে তাদের ধার শোধ করার দাবি রূপে। ব্রিটিশদের ব্যবহারে ক্ষিপ্ত মীর জুমলা কুঠিগুলি ধ্বংস এবং মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে দেশ ছাড়া করার হুমকি দেন। মাদ্রাজের কর্মকর্তাদের পরামর্শে ত্রেভিসা মীর জুমলার সামনে তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেয়। কিন্তু বার্ষিক ৩০০০ টাকার দাবি মীর জুমলা ছাড়েন নি।

প্রত্যেক বছর বিনা শুল্কে ব্রিটিশদের জাহাজে তার পণ্য(যেমন গালা) সম্ভার বিদেশে, বিশেষ করে পারস্যে পাঠানো অভ্যেস করে ফেলেছিলেন মীর জুমলা। গম্ব্রনে ব্রিটিশ কুঠিয়ালকে মাদ্রাজের কুঠিয়াল লিখলেন, যেহেতু মীর জুমলা বাংলায় ক্ষমতায় রয়েছেন, তার পণ্যের ওপরে দেয় কর/শুল্ক না নেওয়াই উচিত। তবে ১৬৬২ সালের মে মাসের ব্রিটিশদের আভ্যন্তরীণ হিসেবে দেখা যায়, মীর জুমলা যা পণ্য পাঠিয়েছেন, তার কর/শুল্ক হিসেব করলে সেটা জাহাজ কাণ্ডে তার প্রাপ্ত অর্থের পরিমান ছাড়িয়ে যাবে বরং এখানে ব্রিটিশেরা মীর জুমলার থেকেই অর্থ পাবেন।
বিনিয়োগের ওপর ভাল সুদ পেয়ে মীর জুমলা ব্রিটিশদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় অন্তত ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন ত্রেভিসা মার্ফত। সুরাতের কুঠিয়ালদের বিরক্তি সত্ত্বেও বাঙলার এজেন্ট ধার করে বাঙলার পণ্য কেনার নীতি চালিয়ে যান। মাদ্রাজের কুঠিয়ালেরা এই ধরণের ব্যবসায় অভ্যস্ত ছিলেন, কিন্তু ত্রেভিসার ব্যক্তিগতভাবে ঋণ নেওয়াকে মেনে নিতে পারে নি। তাদের আশঙ্কা ছিল এই ঝামেলা আবার তাদের ঘাড়ে এসে না পড়ে। মীর জুমলার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই ঋণের একটি অংশ ফেরত দেননি ত্রেভিসা। ৯৭০০ বাকি থাকা টাকার মধ্যে ৫৬৭২ টাকা কাশিমবাজার কুঠিয়ালেরা ১৬৬৪ সালের জুন মাসে শায়েস্তা খানকে শোধ করে। ১৬৬৫ সালে এই টাকা দেওয়া নেওয়ার ঝামেলাটির সমাধান হয়।

৪। ইওরোপিয়দের সঙ্গে মীর জুমলার সম্পর্ক(১৬৬০-৬৩)
ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় মীর জুমলা চতুরতার সঙ্গে সুবিধাবাদ আর চাপে রাখার নীতির মিলমিশ ঘটয়েছিলেন। তার জাহাজ কাণ্ডকে ব্যবহার করে তিনি চাপ দিয়ে আরাকানে পালিয়ে যাওয়া সুজাকে প্রত্যার্পন করিয়ে আনতে বাধ্য করেছিলেন। মীর জুমলার জাহাজ কাণ্ড সমাধান করতে মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালেরা নিজেদের মধ্যে সম্মেলন করে যে সিদ্ধান্ত নেয় তা তাদের প্রধান দপ্তর সুরাটের কুঠিয়ালদের যেমন বিরক্তির কারন হয়েছিল, তেমনি মীর জুমলাও এই সিদ্ধান্তে খুশি হন নি। তিনি যে ২৩০০০ প্যাগোডা দাবি করেছিলেন ব্রিটিশদের মনে হয়েছে তা বেশি, এবং তিনি বকেয়া ঋণের টাকা ৩২০০০ প্যাগোডা চেয়েছিলেন তাও কোম্পানি মেনে নেয় নি। ১৬৬০ সালের মাঝামাঝি অসন্তুষ্ট সুবাদার ব্রিটিশদের কাশিমবাজার কুঠি এবং বঙ্গোপসাগরে তাদের সমস্ত কাজ কর্ম বন্ধ করে দিয়ে ত্রেভিসাকে তার সঙ্গে ঢাকায় বৈঠক করতে নির্দেশ দেন। অগস্ট মাসে একটি ছোট বজরা করে হুগলী থেকে ত্রেভিসা ঢাকার পথে রওনা হন। আগস্টের শেষের দিকে মাদ্রাজের কুঠিয়ালেরা হুগলী কুঠিয়ালদের মীর জুমলার চাহইদা পূর্ণ করে শান্ত করার নির্দেশ দেয় এবং সুজাকে কিভাবে ফেরত আনা যায় তার ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দেন। ত্রেভিসার দৌত্য সফল হয়, পাটনার ১৫০০০ মণ সোরা যেগুলি পড়েছিল নবাবের গুদামে সেগুলি উদ্ধার হয় এবং মীর জুমলা সে সময় ব্রিটিশ আর ডাচেদের সুজাকে প্রত্যার্পণে তাকে সাহায্যের নির্দেশ দিলেন।

আওরঙ্গজেবের উদ্বিগ্নতা বুঝে ২৭ অক্টোবর ১৬৬০ সালে ডাচ প্রধান কুঠিয়াল ম্যাথায়াস ভ্যান ডেন ব্রোককে জানান তিনি আরাকান থেকে সুজাকে প্রত্যার্পণে ইচ্ছুক এবং তাকে প্রথমে মুঘল হুগলীতে আনবেন। আর তার এই উদ্যমে সুজা যদি ডাচ জাহাজ করে পারস্য বা মোকায় পালিয়ে যেতে চায়, তা যেন তারা রোখেন। এই কাজটি ডাচেরা করে দিলে ব্রিটিশদের থেকেও বেশি ব্যবসার সুযোগ সুবিধে দেওয়া হবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন।

সামরিক কারণে মীর জুমলা ব্রিটিশ, ডাচ এবং পর্তুগিজ জাহাজ ব্যবহার করেছেন। ত্রেভিসা যে বজরায় করে ঢাকায় এসেছিলেন, তার ইওরোপিয় নাবিকদের তিনি তার বাহিনীতে নিয়োগ করেন। যুদ্ধ জাহাজ তৈরিতে তিনি ব্রিটিশ আর ডাচেদের সাহায্য নেন। হুগলীতে তৈরি একটি ডাচ গ্যালিওট জাহাজকে ব্রিটিশদের থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপ্টেন জন ডুরসনের নেতৃত্ব এক নাবিক বাহিনী ঢাকায় নিয়ে যায় ১৬৬১ সালের মে মাসে। টমাস প্রাট নামক একজন ব্রিটিশকে যুদ্ধ জাহাজ এবং তার উপযোগী গোলাগুলি বানানর জন্য মির জুমলা নিয়োগ করেন। কিছু ইওরোপিয় বন্দুকবাজ মীর জুমলার অসম আভিযানে অংশ নিয়েছিল।

মীর জুমলার জীবদ্দশায় জাহাজ কাণ্ডটির সমাধান ঘটে নি যদিও তার মছলিপত্তনমের কর্মী টাপাটাপার কাছে সেই জাহাজটি ফেরত দেওয়ার কথা ব্রিটিশেরা বলেছিল। ১৬৬২ সালে কেড্ডা থেকে মালাক্কায় যাওয়ার সময় বিপুল ঝড়ের সামনে পড়ে সেটি তার কাজের ক্ষমতা হারায়। মীর জুমলাকে শান্ত করতে মাদ্রাজ কুঠিয়ালের সেটির বদলে অন্য একটি জাহাজ প্রতিস্থপনের প্রতিশ্রুতি দেয়, এবং একই সময়ে তারা মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালদের, টাপাটাপার উত্তরসূরী আলি বেগকে অবস্থার কথা এবং তাদের বাধ্যবাধকতা বুঝিয়ে বলতে নির্দেশ দেয়। মীর জুমলার মৃত্যুর(ডিসেম্বর ১৬৬৩) পরে ব্রিটিশদের ধারনা হয়, তার পুত্র মহম্মদ আমিন সব ভুলে যাবেন। ১৬৬৫ সালে মাদ্রাজের কুঠিয়ালেরা কোম্পানিকে জানায় যে তখনও পর্যন্ত কোন দাবিদাওয়া ওঠে নি, মৃত নবাবের সব নথিপত্র আওরঙ্গপজেবের কাছে পাঠানো হয়েছে। তারা আশা করছে চুক্তিপত্র উল্লেখ করে ত্রেভিসার মীর জুমলাকে শান্ত করার চিঠিটি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে। মোটামুটি তাদের মনে হয়েছে জাহাজ পর্ব সমাধা হয়ে গিয়েছে।
(চলবে)

Saturday, January 28, 2017

গুরু তর্পণ - উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা - ধরমপালজীর সাক্ষাতকার৪

কৃঃ আমাদের বিজ্ঞন-প্রযুক্তির বিষয়ে কিছু বলুন।
ধঃ জ্যোতির্বিদ্যা আর অঙ্কই ধরুণ। বাংলার ব্রিটিশ সেনা প্রধান রবার্ট বার্কারের কথাই ধরুণ। পরে তিনি পার্লামেন্টেরিয়ানও হয়েছেন। তিনি বেনারসের মনমন্দির সম্পর্কে লিখেছেন। ১৮২৩ পর্যন্ত এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা মনে করত যে এটি বিশ্বের সেরা পাঁচটি মানমন্দিরের অন্যতম।১৭৯০ সালের এক প্রবন্ধে, অঙ্কবিদ এবং এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জন প্লেফেয়ার ফরাসী জ্যোতির্বিদ্যার ঐতিহাসিক বেইলির বইএর বিশদ আলোচনা করেন। এই সময় রুবেন বারো( Ruben Burrow) বাইনোমিয়াল থিওরেম প্রকাশনা করেন। লেফটানেন্ট জেন্টিল, প্রখ্যাত কাসিনির লেখা, কিভাবে তামিলেরা কাগজ কলম ছাড়া, কিছু ঝিনুক আর কিছু অঙ্কের নামতা ব্যবহার করে, গ্রহণের হিসেব করত তার বর্ণনা দিয়েছেন। কৃষি নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে।
১৮২০ সালের কর্নেল আলেকজান্ডার ওয়াকার মালাবার আর গুজরাটের কৃষি নিয়ে লেখেন। হলওয়েল, কিছু মাত্র সময়ে বাংলার সরকার ছিল। বাংলার বসন্তের টীকা দেওয়া নিয়ে বিশদে লিখেছেন। ১৮০২-৩ সালে ব্রিটিশেরা ভারতীয় পদ্ধতিতে টিকা দান নিষিদ্ধ করে। হ্যালকট দক্ষিণের ড্রিলপ্লাউ নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। তার মন্তব্য ছিল এটি খুব সাধারণ অথচ কার্যকর। তিনি লিখছেন তার ধারণা ছিল না এটি ভারতীয় প্রযুক্তি। এছাড়াও ঊজ নামক ভারতীয় ইস্পাত তৈরির বর্ণনা পেশ করেছেন ব্রিটিশরা। ড। হেলেনিয়াস স্কট তাঁদের(সাম্রাজ্য) যতগুলি ইস্পাতের সঙে পরিচিতি রয়েছে, এটি সবকটির থেকে উত্তম। এছাড়াও বরফ তৈরি, কাগজ তৈরি এবং মর্টার তৈরি নিয়েও বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
কৃঃ কিন্তু বহু ব্রিটিশ ভারতের জনগণকে গরীব, দরিদ্র্য, অজ্ঞ বলে বর্ণনা করেছেন।
ধঃ আদতে আষ্টাদশ শতকে ভারতে আসা প্রায় সব সিভিলিয়ানদের এই মানসিকতা ছিল। ব্রিটেনের সেই সময়ে নির্দিষ্ট হায়ার্কিক্যাল স্ট্রাকচার ছিল, আইনি ব্যবস্থা এবং বংশ, কুল, পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থের জোরে কিনতে পারা যায় এমন পদমর্যাদার সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। সেই তুলনায় সাধারণ কিন্তু জীবন্ত ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় দৃশ্যত মিলেমশে থাকার যে পরিবেশ গড়ে উঠেছিল, বা অর্থ অনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা, পরিকাঠামো বা জমির যৌথ মালিকানা ইত্যাদি ব্রিটিশদের চোখে ঢিলেঢালা এবং সম্পদহীন সমাজের প্রতিফলন।
১৮১৩ সালের ভারতবর্ষীয়দের বিষয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে আলোচনা হয়, তাতে এতদিনের লুঠ, অত্যাচারের পরেও ভারতীয় সমাজে যে ধরণের জ্ঞানের বহিপ্রকাশ হয়, যেভাবে মানুষে মানুষে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে, যেভাবে তাঁরা সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে তা নিয়ে বেশ কিছু পার্লামেন্টারিয়ান উল্লেখ করেছেন। আদতে উনবিংশ শতকে উইলবার্ফোর্সএর মত তাত্ত্বিকেদের মত এই মনোভাবের জন্য দায়ি। তিনি বলেন গ্রিস যতদিন খ্রিষ্ট ধর্মে মতি পেশ করেনি ততদিন তাঁরা গরীব ছিল। ভারতেরও একই অবস্থা। যতদিন না তাঁরা খ্রিস্টের অনুগামী না হচ্ছে তাঁদের অবস্থা পাল্টাবে না।
আমার মতে ভারতীয়দের অজ্ঞ, মুর্খ, গরীব ইত্যাদি বলার পিছনে যুক্তি ছিল, ভারতের ধর্ম ব্যবস্থা। ভারতীয়রা অনেক বেশি ধার্মিক। আদতে ভারতকে আর্থ-সামাজিকভাবে গরীব, পিছিয়েপড়া হিসেবে দেখানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে ১৮০০ সালের পর থেকে। কেন্দ্রিভূত ব্রিটিশ রাজনীতি, সম্পদ সংগ্রহ নীতি আর শাসনপদ্ধতি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল - ইংরেজি শিক্ষিতরা তা মেনেও নিলেন - কোন প্রশ্ন না করে, এই শাসন ব্যবস্থা দেশের সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করল; চিন থেকে সেন্ট হেলেনা পর্যন্ত বিপুল ভৌগোলিক এলাকা সেই সম্পদে শাসিত হল আর প্রভূত বাড়তি নানান সম্পদ নিজের দেশে নিয়েগেল। এছাড়া ভারতে তারা নতুন শহর এবং প্রভূত সেনা ছাউনি তৈরি এবং তার ব্যবস্থাপনা করল এবং (এবং স্বাধীনতার পর এই ব্যবস্থা আমরা সেধে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এলাম) সেটাই ভারতের বড় আভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এই অব্যবস্থা, দারিদ্র্য এবং উপনিবেশিকতা কিন্তু মোট রাজস্ব আদায়ের ওপর প্রভাব ফেলল না। সমগ্র ভারতকে যেন স্থাণুবৎ করে দেওয়া হল। এবং শিক্ষিতরা যে গবেষণা করলেন সেটি এই দারিদ্র্য বজায় রাখতে সাহায্য করল এবং সারা দেশে এই দারিদ্র্য মহামারীর মত ছড়িয়ে গেল।
কৃঃ আমাদের ভারতে এমন কিছু নীতি অনুসরণ করতাম, যা শাসককে একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করতে দিত না।
ধঃ মহাভারতে বলা হয়েছে, যে রাজা তার প্রজাদের রক্ষা করতে পারে না, যে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করে, এবং তাঁদের সম্পদ হরণ করে সেই রাজাকে হত্যা করতে জনগণ একতাবদ্ধ হবে। সেই রাজা কলিরূপে চিহ্নিত হবে। এই রাজাকে মত্ত কুকুরের মত হত্যা করতে হবে।
কৃঃ কিন্তু আমাদের বহু রাজা সাক্ষাৎ কলি ছিলেন...
ধঃ ঠিক। আমরা রাজনৈতিক তত্ত্বের আলোচনা করছি। কিন্তু প্রাতীচ্যে তত্ত্বগতভাবে রাজা কিন্তু চরম ক্ষমতার আধিকারী ছিলেন।
কৃঃ কিন্তু এদেশে রাজাই চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী, এই তত্ত্ব কিকরে শেকড় গজাতে পারল?
ধঃ হয়ত ব্রিটিশ শাসনের সময় যে সব রাজা রাজস্ব করেছেন, তাঁদের শাসন করার পদ্ধতিতে এই ধারণা চারিয়ে গিয়েছে।
কৃঃ জাতিভেদ সম্বন্ধে কিছু বলুন। আপনি নিশ্চই বলবেন না যে জাতিভেদ প্রথা ১৮০০ সালের পরে দেখা দিয়েছে। এটিকে যদি আমরা আমাদের পরম্পরা হিসেবে করি তাহলে আসুবিধা দেখা দেবে।
ধঃ ঠিক। জাতিভেদ ভারতের পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ বলে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে আমরা এলাম কি করে? গ্রামের মতই, প্রাচীন কাল থেকেই জাতি ব্যবস্থা ছিল। মুনুস্মৃতিতে সমাজকে চার বর্ণে ভাগ করা হয়েছে। এটি ভারতে আজ যেমন রয়েছে, তেমনি আতীত থেকেই ছিল। কিন্তু এটি ভারতের পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ, এই তত্ত্ব এর আগে দেওয়া হয় নি। প্রত্যেক বর্ণ এবং আদিবাসীরা বহুকাল ধরে পাশাপাশি বাস করে এসেছে, আলাপ আলোচনা করেছে, আবার লড়াইও করেছে। মনুস্মৃতিকে ভুল প্রমান করে বলা যায় ব্রিটিশ যখন ভারত শাসন করতে শুরু করল, তখন ভারতে বহ শুদ্র রাজা। এটাও হতে পারে জাত ব্যবস্থা ভারতের রাজনীতির দুর্বলতার কারণ। বা উলটো ভাবে বলা যায় হয়ত জাতির বিভিন্নতা ভারতীয় সমাজের জোরের কারণ। সেজন্য ভারত বহুকাল ধরে টিকেও রয়েছে। কেন জাতিভেদ ভারতের দুর্বলতার কারণ তার কোন সন্তোষজনক উত্তর আজও পাওয়া যায় নি।
ব্রিটিশ শাসনে জাতিভেদ বড় আসুবিধে হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারা এই ব্যবস্থাকেই বুঝতে পারে নি – এমন নয় যে তারা জাতিহীন সমাজ তৈরি করে সশক্ত ভারত গড়তে চেয়েছিল, বরং তারা জাতিভেদ নির্মূলন করে ভারত ভাঙতে চেয়েছিল। আমার মনে হয় ভারতীয় সমাজকে অণুকরণ(এটমাইজেশন) করা, শাসন করা এবং সারা ভারত জয় করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠল জাতির বিভিন্নতা। জাতিভেদ এবং জাতিভেদ নিয়ে যে ক্রোধ আজ ভারতীয় রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের দান।

গুরু তর্পণ - উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা - ধরমপালজীর সাক্ষাতকার৩

কৃঃ আপনি তাহলে বলছেন, ১৭৫৭র আগে ভারত ব্রিটেনের থেকে ভাল অবস্থায় ছিল? তখন ভারতের সাধারণ মানুষের কি অবস্থা ছিল?
ধঃ আমাদের হাতে এমন কোনো তথ্য নেই যা দিয়ে আমরা এই দুই সমাজের তুলনা করতে পারি। কিন্তু কয়েকটি তথ্য দিতে পারি যা ভারতের সমাজকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে চেষ্টা করবে। ১৮০৪ সালের জুলাইতে এডিনবরা রিভিউতে ভারতের কৃষি উৎপাদনের হার এবং কৃষি শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে লেখা হয়েছিল। তুলনায় দেখা গেল, কৃষি উৎপাদনের হার ব্রিটেনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। আর যেটা ব্রিটেনের কর্তাদের স্তম্ভিত করে দিয়ে ছিল সেটা হল, ভারতের কৃষি শ্রমকদের মজুরি তাঁদের দেশের কৃষি শ্রমিকদের থেকে কয়েকগুণ বেশি।
এর থেকে আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারি, তা হল, ভারতের অর্থনীতি যখন ঢালুর পথে যাচ্ছে, সেই ১৮০০ সালেই যদি এই মজুরি হয় তাহলে তার আগে কি ছিল? বা ১৮০৬ সালে বেলারি জেলার কনজামশান প্যাটার্ন নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই জেলার তিন ধরণের পরিবারে কনজামশান প্যাটার্ন নিয়ে বিশদে সমীক্ষা করেছিল। পরিবারের মাথাপিছু দৈনিক দানাশস্য ব্যবহার হত আধ সের। এছাড়াও ২৩টি অন্যান্য জিনিস ছিল যেমন দানাশস্য, ঘি, তেল, নারকেল, সবজি, পান, সুপুরি ইত্যাদি। প্রথম শ্রেণীর পরিবারের মাথাপিছু বছরে খরচ হত ১৭ টাকা। দ্বিতীয় শ্রেণীর ৯ টাকা, তৃতীয় শ্রেণীর ৭টাকা(তুলনা করা যাক মূল্যবৃদ্ধির ১৮২০ সালের কলকাতায় মাসে দুটাকা রোজগার করে ঠাকুরদাস, বিদ্যাসাগরের পিতা নিজেকে স্বচ্ছল ভাবছেন, এবং বাড়িতে টাকা পাঠাবার কথা চিন্তা করছেন)।
তাঞ্জোরে ১৮০৫ সালে মিরাসদার(জমির চিরস্থায়ী স্বত্ত্বধারী)দের সংখ্যা ছিল ৬২০০০, যার মধ্যে ৪২০০০ ছিল শুদ্র বা তারও নিম্নশ্রেণীর। ৬ লাখ জনসখ্যার বারামহল(আজকের সালেম) জেলায়, পারিয়া গোষ্ঠীর কৃষকদের সংখ্যা ছিল ৩২৪৭৪। ১৭৯৯ সালে চেঙ্গেলপেট্টু জেলায় মিরাসদারদের যে তালিকা হয় তার সংখ্যা ছিল ৮৩০০, কালেক্টরের ধারণা মোট সংখ্যা, যারা এর বাইরে রয়ে গেলেন তারা এর দশগুণ হবেন। মাদ্রাজের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা তৈরি করা আলেকজান্দার রিড লিখছেন হায়দ্রাবাদে বড়মানুষ আর তাঁদের চাকরদের মধ্যে পার্থক্য শুধু কাপড়ের। বড় মানুষদের কাপড় একটু বেশি পরিষ্কার।
কৃঃ আপনার আগামীতে প্রকাশ্য ভারতের ব্রিটিশপূর্ব শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিষয়ে আলোচনা করেছেন-
ধঃ উদাহরণস্বরূপ, ১৯২২-১৯২৫ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির দেশজ শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একটা সমীক্ষ হয়। তাতে দেখা যায় ১১৫৭৫টি বিদ্যালয় আর ১০৯৪টি উচ্চবিদ্যালয়(কলেজ) রয়েছে যেগুলির ছাত্র সংখ্যা ১৭৪১৯৫ এবং ৫৪৩১ যথাক্রমে। সেই ছাত্রদের জাতিভাগ নিয়েও অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল। তামিলভাষী এলাকায় শুদ্র এবং তার তলার জাতির ছাত্রের সংখ্যা ছিল ৭০-৮০ শতাংশ। ৬২ শতাংশ ছিল ওডিয়া ভাষী এলাকায় এবং ৫৪ শতাংশ ছিল মালায়লম ভাষী এলাকায়। মাদ্রাজের গভর্ণর এটা লেখেন, বিদ্যালয়ের যাওয়ার যাদের বয়স হয়েছে এমন ছাত্রদের ২৫ শতাংশ বিদ্যালয়ে যায় এবং বড় এক অংশ বাড়িতে পড়াশোনা করে। ২৬০০০ ছাত্র বাড়িতে পড়াশোনা করে, ৫৫০০ বিদ্যালয়ে যায়। মালাবারে বাড়িতে উচ্চস্তরের পড়াশোনা করা ছাত্রদের সংখ্যা ১৬০০। সেখানে মুসলমান বিদ্যালয়ে যাওয়া ছাত্রীদের সংখ্যা ১১২২, ছাত্রদের সংখ্যা ৩১৯৬। ব্রিটিশপূর্ব সময়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যে সব ধারণা রয়েছে, সেগুলি নতুন করে ফিরে দেখার সময় এসেছে।
(পরের প্রকাশনায় শেষ হবে)

গুরু তর্পণ - উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা ধরমপালজীর সাক্ষাতকার২

কৃঃ অন্য একটা প্রশ্ন করি। ব্রিটিশের পক্ষে কেন এই দেশে উপনিবেশ করা সহজ হয়ে পড়ল? ব্রিটিশ-পূর্ব সমাজের কোন দিকটি এর জন্য দায়ী?
ধঃ একটা কথা বলে রাখি ব্রিটিশ পূর্ব ভারতীয় সমাজে জোরের বা ভঙ্গুরতার যায়গাগুলি আমি সত্যিই জানি না। আমার জ্ঞান অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ পূর্ব সমাজ নিয়ে এবং তাও অধিকাংশ ব্রিটিশ এবং অন্যান্য তথ্য থেকে আহরিত। এই বিষয়ে মন্তব্য করার আগে ব্রিটিশপূর্ব সমাজ সম্বন্ধে আর বহু তথ্য জানা প্রয়োজন। আমি শুধু বলতে পারি ১৭০০ সাল নাগাদ মুঘলদের কেন্দ্রিয় পকড় শিথিল হয়ে পড়ল। এর ফলে বহু স্থানীয় রাজা মহারাজা নবাবেরা তাঁদের নিজেদের অঞ্চলে আধিকার বজায় রাখতে শুরু করলেন। এদের মধ্যে রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল না। ফলে ফরাসিদের মত ইওরোপিয় শক্তি তাঁদের মধ্যে আপাত বিচ্ছিন্নতার সুযোগে তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার করার কাজ শুরু করে। শেষে যখন ব্রিটিশেরা শক্তি সঞ্চয় করে আঘাত হানতে থাকে তখন তাঁদের আর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ হয় নি।
কৃঃ আদতে কি ভারতীয় সামন্ততন্ত্র নব্য পুঁজিবাদের এই আঘাতকে ঠেকাতে পারে নি...
ধঃ জানি না আমাদের সামন্ততন্ত্র ছিল কি না। এই ধরণের সিদ্ধান্ত করে ফেলার সময় আমাদের সমাজিক সঙ্গঠন(সোসাল অর্গানাইজেশন) নিয়ে বেশ কিছু ইওরোপকেন্দ্রিক উপপাদ্য ভেবে ফেলা হয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, যখন কেউ মুঘলদের কেন্দ্রিয় শক্তির কথা বলেন, তখনই একটা কেন্দ্রিভূত রাষ্ট্র ধারণা এবং তৎসংক্রান্ত বেশ কিছু উপধারণা তৈরি করে নেন। নাতিদের লেখা ঔরঙ্গজেবের একটী চিঠি আমি দেখেছি। তাতে দুটো বিষয় বলা হয়েছে, ১। জাহাঙ্গীরের সময় রাজস্ব দপ্তর সারা ভারত থেকে ৬০ লাখ টাকা তুলত, আর ব্যয় হত দেড় কোটি টাকার কাছাকাছি। ফলে যে বিপুল ঘাটতি থাকত তা আকবরের সঞ্চয় থেকে পূরণ হত। ২। শাহজাহান জাহাঙ্গীরের উদাহরণ অনুসরণ করেন। তিনি দেড় কোটি টাকা তুলতেন। এবং খরচ কমিয়ে আনেন এক কোটি টাকায়। কিন্তু মুঘলদের রাজত্বে প্রথম দিকে মোট রাজস্ব ছিল ১০ কোটি টাকা, পরের দিকে কুড়ি কোটি টাকা। হিসেব বলছে সম্রাট তার রাজত্বের ন্যুনতম রাজস্ব নিতেন, তাহলে বাকি রাজস্বের কি হত? আমার ধারণা ঐতিহাসিকেরা স্বীকার করেছেন যেঔরঙ্গজেব রাজস্বের ২০ শতাংশ নিতেন। ফলে ধরে নেওয়া হয় বাকি আশি শতাংশ রাজস্ব সামন্তরা নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিতেন।
আমার সিদ্ধান্ত অন্যরকম। এই বিপুল পরিমান রাজস্ব স্থানীয় অঞ্চলে থাকত। এই সম্পদ স্থানীয় রীতিনীতি পুষ্ট করার কাজ করত – যেমন পাঠশালা, চাত্রম, বিদ্যালয়, পুকুর, সেচ ব্যবস্থা, মন্দিরের জন্য এবং অন্যান্য ধর্মীয় কাজে ব্যয়, জ্ঞনাক, বৈদ্য, কবি, জ্যোতিষ, জাদুকর ইত্যাদিদের মধ্যে বেঁটে দেওয়া হত। এটি আসলে বেশ পুরোনো ব্যবস্থা যা মুঘল শক্তিকেও বজায় রাখতে হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ সময়ে পুরো ব্যবস্থা পালটে গেল। তারা ধাপে ধাপে মোট উৎপাদনের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ রাজস্ব হিসেবে কেড়ে নিতে শুরু করল। তার ফল এখন ফলছে। গ্রামে যে উদবৃত্ত থাকত, তা শুষে নিয়ে চলে গেল বিদেশে। ফলে যে পরিকাঠামো তৈরি হয়েছিল কয়েক হাজার বছর ধরে তা ভেঙ্গে পড়ল তাসের ঘরের মত।
কৃঃ ব্রিটিশ এক কাজ জেনেশুনে করেছিল?
ধঃ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষে যা স্বাভাবিক তাই তারা করেছে। তাঁদের দেশে তারা কৃষকদের থেকে ৫০ শতাংশের বেশি রাজস্ব নিত। ফলে তাঁদের সিদ্ধান্ত ছিল যে শাসক যে জমি তার(নিজেদের দেশেই তারা সবার আগে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল)। সেই তত্ত্ব ব্রিটিশ এদেশে এসে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিল। তারা এটা শুধু ভারতের জন্য করেছে বললে অপলাপ হবে। তারা বিশ্বে যেখানে যেখানে গিয়েছে সেখানেই একই কাজ করেছে। ব্রিটিশ শাসকেরা মনে করত এটাই স্বাভাবিক কাজ। কেননা তাঁদের সমাজ আর রাষ্ট্র সম্বন্ধে যে ধারণা তা কেন্দ্রিভূত এক সমাজের। এই ধারণা ১০০০ বছর ধরে ব্রিটেনে রয়েছে। এ তত্ত্ব পুঁজিবাদের গর্ভগৃহ থেকে জন্ম হয় নি। উদাহরণস্বরূপ, ১১০০ সালে নর্মানেরা যখন ব্রিটেন দখল করল, তখন থেকেই রাজস্বে ৯৫ শতাংশের বেশি সম্পদ রাজা, চার্চ এবং নতুন সামন্তরা ভাগ করে নিত।

গুরু তর্পণ - উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা - ধরমপালজীর সাক্ষাতকার১

...গত বছরের প্রকাশনা। ধরমপালজীর এই সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন ক্লদ আলভারেজ।
আমরা যে কাজ করছি, পুরোনো বাঙলাকে ফিরে দেখা, সেই কাজের মূল গুরুরা হলের গ্রামীন উদ্যোগীরা। এছাড়াও হাতে গোণা শিক্ষিত, যারা আমদের পা মাটিতে রাখতে শিখিয়েছেন, গ্রামের মানুষকে গুরু ভাবতে শিখিয়েছেন তাদের মধ্য ধরমপালজী অন্যতম।
জীবনী বর্ণনা মোটামুটি ঔপনিবেশিক সভ্যতার অবদান, যেখানে প্রখ্যাতরা সমাজের জ্ঞানে সম্পদ শুষে বেড়ে উঠে সেগুলিকে নিজেদের সম্পত্তি বলে চালান। এই ব্যক্তি কেন্দ্রিক আলোচনা এই পূর্বের সমাজে ছিল না বললেই চলে, বিশেষ করে গ্রাম সমাজে।
এই আলোচনা বাংলায় খুব একটা চল নেই। গত কয়েক দশকে বাংলা তথা ভারতের সমস্ত জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য ধ্বংস করে গয়ে উঠেছে 'কেন্দ্র' উপসর্গওয়ালা কয়েকটি পশ্চিমী ধাঁচের শিক্ষা কেন্দ্র।
এই দেশজ গ্রামীন, অপ্রাতিষ্ঠানিক, বিকেন্দ্রীভূত জ্ঞানচর্চা বাংলায় হয় নি বললেই চলে, বাংলায় তাই ধরমপলাজী প্রায় অশ্রুত ব্যক্তি।
তাঁর জীবনী আলোচনা এখানে অবান্তর - শুধু না বললেই নয় যে সব কথা - তিনি ভারতে গত এক শতক ধরে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত চর্চিত পশ্চিমি সাম্যবাদের ধারার বাইরে দাঁড়িয়ে ভারতীয় সাম্যবাদের চর্চা করেছিলেন, যে সাম্যবাদের ভিত লুকিয়ে রয়েছে গ্রাম সমাজের জ্ঞানচর্চায়।
সেই দেশচর্চার কুড় আমরা পেয়েছিলাম ধরমপালজীর কাজে।
তিন দশক আগে একটি সাক্ষাতকারের বাংলায় অনুদিত কিছু অংশ তুলে দেওয়া গেল। কয়েকটি ধারাবাহিকে প্রকাশ পাবে -
কৃষ্ণণঃ প্রথমেই খুব বস্তাপচা প্রশ্ন করছি। আপনি কেন এবং কিভাবে ব্রিটিশপূর্ব বিশেষ করে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের ভারতের সমাজ জানতে উৎসাহী হলেন। আপনাকে এই প্রশ্নটি করছি, কেননা আপনি তথাকথিত শিক্ষাগতভাবে (বিশ্ববিদ্যালয়ে) গবেষক/জ্ঞানচর্চক নন।
ধরমপালঃ আমি দীর্ঘদনধরে এসোসিয়েশন আব ভলান্টারি এজেন্সিজ ফর রুরাল ডেভেলাপমেন্ট(এভার্ড)এর জড়িয়েছিলাম। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত আমি এর সম্পাদক থেকেছি। এভার্ড আমাদের গ্রামের পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থা জানতে উৎসুক ছিল। এই সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি, ভারতীয় সমাজে পরম্পরাগত ভাবনা বা বিশ্বাসের সঙ্গে বিদেশের দিকে দৃষ্টি রেখে বেড়ে ওঠা মানুষদের দুস্তর ব্যবধান। শহুরে মানুষেরা দেশের সমাজ ব্যবস্থা জানেনইনা বলা যেতে পারে।
এ সম্বন্ধে আপনাকে আমি একটা বাস্তব উদাহরণ দিতে পারি। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বুঝতে, এবং তা নিয়ে কাজ করা একটি দলের সঙ্গে আমি রাজস্থান গিয়েছিলাম।আমরা দেখলাম পঞ্চায়েত একটি নতুন বাড়ি তৈরি করেছে। তার কাজগপত্র পরীক্ষা করে দেখলাম যে পঞ্চায়েতে এই বাড়িটা তৈরি করা নিয়ে কোনো তথ্য রাখা নেই। খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে বিশ) পঞ্চায়েত(২০টি পঞ্চায়েতের সংগঠন – উত্তর বাংলায় যেমন বাইশা পঞ্চায়েত নামে একটা ব্যবস্থা ছিল)। এটি একটি পঞ্চায়েত, যা পরম্পরাগতভাবে গ্রামে কাজ করে, এবং এর সঙ্গে বাস্তবে যে নিয়মতান্ত্রিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তার কোনো মিল নেই।
এটি একটি শেখার ব্যাপার ছিল আমাদের কাছে – বুঝতে চাইলাম যে গ্রামের মানুষ কি ভাবে কোনো বিষয়কে দেখে, এবং তাঁরা বাইরের নানান ধাক্কায় কিভাবে প্রভাবিত হয়। বুঝলাম, আমরা কত কম গ্রাম সম্বন্ধে জানি। অন্ধ্র, তামিলনাড়ু এবং অন্যান্য এলাকায় আমরা কাজ করতে গিয়ে এই একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। ১৯৬৩-৬৫ পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি তামিলনাড়ুতে যাই। বিভিন্ন জেলায় গিয়ে পঞ্চায়েতের কাজের সঙ্গে জুড়ে থাকা নানান মানুষের সঙ্গে কথা বললাম, এবং পঞ্চায়েত কিভাবে চলে তারও একটা আঁচ নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তাঞ্জোরে আমি স্থানীয় ভারত সেবক সমাজের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে জানান তাঞ্জোরের আশেপাশে ১৯৩৭ সাল থেকে ১০০টিরও বেশি সমুদায়ম গ্রামের আস্তিত্ব রয়েছে। সমুদায়ম গ্রাম হল এমন একটা গ্রাম যেখানে সময়ে সময়ে গ্রামের জমির চাষের অধিকার বিভিন্ন পরিবারের ওপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বর্তায়, অথচ জমির অধিকার কিন্তু সামগ্রিক সমাজের থাকে। এই ব্যবস্থাটি প্রয়োজন হয় কেননা, বহু সময়ে জমির উর্বরতা, নদীর ঢাল, ইত্যদির মত নানান বিষয় পরিবর্তিত হলে জমি চাষের ব্যবস্থাও পরিবর্তিত হয়। তখন জমি চাষের অধিকার নতুন করে ভাগ হয়।
আমি পরে রাজস্ব সমীক্ষায় দেখি, ১৮০৭ সাল পর্যন্ত তাঞ্জোরের অন্তত ৩০ শতাংশ সমুদায় গ্রাম ছিল। আষ্টাদশ শতের শেষ দিকের আর উনবিংশ শতের প্রথমের দিকের যত ব্রিটিশ তথ্য দেখেছি, তত আমি বুঝতে পারলাম আমরা ভারতীয় সমাজ নিয়ে যে সব ধারণা করেছি, সব ভুল ছিল। আমি এই কাজটি সারাজীবন ধরে করেছি, আমার ধারণা সকলের এই রাস্তায় গবেষণা করলে, নতুন তথ্যে উপনীত হতে পারবেন।
(এর পর পরের প্রকাশনায়)

Friday, January 27, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৬৮ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

নিজাম হিসেবে মীর জুমলা বাঙলা প্রশাসনে অব্যাহত একনায়কতন্ত্র চালাতেন। বিহার আর ওডিসার প্রশাসন তিনি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। ১৬৬০-৬১সালে পাটনার দেওয়টান লুতফুল্লা বেগ রাষ্ট্রের রাজস্ব বাড়াবার জন্য সোরা ব্যবসা দখলের চেষ্টায় ডাচেদের সঙ্গে যে সব মধ্যসত্ত্বভোগীরা কাজ করত তাদের নির্দেশ দিলেন সমস্ত সোরা রাষ্ট্রকে জমা দিতে। হুগলীর ডাচ কুঠিয়াল ভ্যান্ডেনব্রোক, মীর জুমলা এবং ব্রিটিশদের অভিযোগ করে বলেন যে এই কাজটি পাটনার ব্রিটিশ কুঠিয়াল চেম্বারলেইন আর দালাল গঙ্গারামের ষড়ে হয়েছে, গঙ্গারাম দেওয়ানকে সমস্ত সোরা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এবং ব্রিটিশেরা দেওয়ানের থেকে সোরা কিনে নেবে(বলা দরকার সেই সময় পাটনার বিপুল পরিমাণ সোরা কিনত ডাচেরা - অনুবাদক)। এর উত্তরে ব্রিটিশ কুঠিয়াল ত্রেভিসা সরাসরি বললেন তিনি দেওয়ানের এই চুক্তিতে সায় দিচ্ছেন না, বরং সোরা কেনা ব্যবস্থায় ডাচেদের সঙ্গে রয়েছেন এবং তারা সরাসরি দালালদের থেকে সোরা কিনবেন বরাবরের মত। মীর জুমলা পরওয়ানা দিয়ে লুতফুল্লাকে ডাচেদের বিরুদ্ধে যেতে বারণ করলেন।

নিজাম হিসেবে মির জুমলার কোন সহকারী ছিল না, তাহলে হয়ত কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব ভাগ করে দিতে পারতেন। ১৬৫৯এর বসন্তে মীর জুমলা বাঙলার দখল নিশ্চিন্ত করে ইস্তিয়াখ খানকে অস্থির ওডিসার দায়িত্ব দিলেন। মনে হয় এই সময়েই রাষ্ট্রীয় ফরমান বলে মীর জুমলা খালসা রাজস্ব না মেটানোর অভিযোগে ওডিসার রাজা নীলকান্ত দেবের তুয়ুল দখল নেন কিন্তু কাশিজোড়া মহালের সরকার গোয়ালপাড়ার কুতুবপুরের মদদইমাশ জমি ভোগ করা শেখ আবদুল খয়ের স্বত্ব বজায় রাখলেন। ওডিসার দেওয়ান হবিসেবে খানইদৌরানের পদের মাধ্যমে মীর জুমলা কিছুটা হলেও ওডিসার ওপর দখলদারি বজায় রেখে ছিলেন। অসম অভিযানের ঠিক আগে ওডিসা থেকে রাজমহল পর্যন্ত ডাকচৌকি বসানো হল, কিন্তু তার সময়টা জানা যায় নি। রাজমহল হয়ে বাঙলা ওডিসার রাজস্ব একযোগে দিল্লিতে পাঠানো হত।

হিজলির বিদ্রোহী জমিদার বাহাদুর খানকে দমন করতে খানইদৌরানকে ব্যবহার করেন মীর জুমলা। বাহাদুর খান সুজার কারাগার থেকে পালিয়ে গিয়ে নতুন করে তার ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। ইওরোপিয় কুঠির নথি বলছে মীর জুমলা এটি দখল করতে ডাচ, ব্রিটিশ, পর্তুগিজদের থেকে জাহাজ দাবি করেন। তবে ওডিসার প্রধান হিসেবে খানইদৌরানের পদপ্রাপ্তিতে এই অভিযানের পরিকল্পনা কিছু দিনের জন্য স্থগিত থাকে। শেষ পর্যন্ত মীর জুমলা সম্রাটকে প্রভাবিত করে ওডিসা বাঙলার প্রশাসনের অন্তর্ভূক্ত করেন, ব্রিটিশ স্লুপ আর ডাচ গ্যালিয়ট নিয়ে হিজলি দখল করেন। বাহাদুরের ভাই কমল খান নিহত হয়। ৬ মে বাহাদুর এবং তার ১১ জন সাথীকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

আরাকানের রাজা মীর জুলমার দখল করা তার কিছু রাজত্বের অংশ চেয়ে পাঠিয়ে একটি উদ্ধত চিঠি দেয়। মীর জুমলা তার অভিযোগ খারিজ করে একটি যুক্তিপূর্ণ চিঠি এবং কিছু সামান্য উপহার পাঠান। সুজাকে আরাকান থেকে নিয়ে আসার জন্য তিনি ডাচেদের ওপরে চাপ দিলেন। মগেদের অত্যাচার চরমে উঠলে মীর জুমলা সম্রাটকে জানান যে খিজিরপুরের আগের মুঘল আধিকারিক মগেদের আক্রমণের ভয়ে পালিয়ে থাকতেন। শীতের পরে যখন মগেদের অক্রমণের ঝাঁঝ কমত, তখন ঢাকার সুবাদার তার সেনা নিয়ে সেখানে যেতেন। মগদের অত্যাচার বন্ধ করার জন্য মীর জুমলা কিছু পরিকল্পনা করেন। তবে সেটি রূপায়িত করার কথা ভাবেন কোচবিহার অভিযানের পরই।
কোচবিহার-অসম আক্রমণের আগে তিনি বাংলায় কিছু প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রাজমহলের দেওয়ান হিসেবে কাজ করতে থাকেন মুখলিস খান, ওডিসার দায়িত্ব ছেড়ে আসার পর তিনি ইস্তিশান খানকে ঢাকা সুরক্ষায় খিজিরপুরের দায়িত্ব দিলেন। সাম্রাজ্যের দেওয়ান রায় ভগবতী দাস এবং খ্বাজা ভগবান দাস সুজায়িকে সাম্রাজ্যের আর্থ ব্যবস্থা দেখাশোনা করার পাশাপাশি বাংলায় মীর জুমলা সরকারের একই বিভাগ দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন। দক্ষ, চতুর এবং কর্মঠ হিসেবে বর্ণিত ঢাকার আধিকারিক মহম্মদ মুকুম নাওয়ারার(নৌবাহিনী) দায়িত্ব এবং মীর গাজিকে খাজাঞ্চি এবং খবর-লেখকের(গোয়েন্দা) দায়িত্ব দেন।

মীর জুমলা যখন অসম অভিযানে যান তখন দুবছর ধরে বাংলায় চরম দুর্ভিক্ষ চলেছিল। জাকাত দানের সমান চালের দাম উঠেছিল। চৌকিদার, রাহদারের(শুল্ক আধিকারিক) অত্যাচারে এবং আভ্যন্তরীণ গোলযোগের জন্য ব্যবসায়ীদের গতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। তালিশ সে সময়ের মানুষের অবর্ণনীয় সমস্যার ওপর আলোকপাত করেছেন, ‘মানুষের জীবন রুটির চেয়েও শস্তা, অথচ দেশের কোথাও রুটি পাওয়া যেত না’। এই দুর্ভিক্ষের প্রভাব পড়েছিল অসমে মুঘল শিবির মথুরাপরের ওপরেও। লাখুতে মুঘল নৌবাহিনীর জন্য কোন ত্রাণ পাঠানো সম্ভব হয় নি। অসমে বাহিনীর খাবার অভাব দূর করতে তিনি অসমের দিহিং নদীতে দখল করা ১২০০০ মণ চাল শিবিরে পাঠাতে নির্দেশ দেন। মীর জুমলার প্রশাসক উত্তরসূরী দাউদ খান জাকাতের সম্পূর্ণ দান জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন, তাতে কিছুটা দর্ভিক্ষের প্রকোপ প্রশমিত হয়।

সুজার সময় থেকে বাঙলার প্রশাসনিক কিছু সংস্কার করার প্রয়োজন হলেও মীর জুমলা সেগুলি করার সুযোগ পান নি। মীর জুমলার মৃত্যুর পর সাময়িকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্তর পক্ষে এটি রূপায়ন করা সম্ভব হয় নি এবং দুর্যোগ আরও গভীরতর হয়। শায়েস্তা খান বাঙলার নবাব(সুবাদার) হয়ে বেশ কিছু যোগ্য প্রতিবিধান করে এই বিশৃঙ্খলতা মেটান। মীর জুমলার যে কটি অর্ধসমাপ্ত কাজ তিনি সমাধা করেন, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণটি ছিল নৌবাহিনীকে নতুন করে গড়ে তোলা। যে সব পরগণাকে নৌবাহিনীর দেখাশোনা করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বার্ষিক ১৪ লক্ষ টাকার বিনিময়ে, সুজার সময়ে তার গাছাড়া মনোভাবের জন্য, সারা বাঙলা জুড়ে গোলযোগ চলার জন্য এবং রাজস্ব আদায়কারীদের অত্যাচারের জন্য এই অর্থ তোলা যায় নি, নৌবাহিনী। মীর জুমলার পদপ্রাপ্তির ফারমানে আওরঙ্গজেব, ইব্রাহিম খানের নীতি অনুসরণ করে নৌবাহিনীকে নতুন করে গড়ে তোলার সমস্ত চেষ্টা চালানোর নির্দেশ দেন। নৌবাহিনীকে নতুন করে গড়ে তুলতে নৌবাহিনীর পুরোনো ব্যবস্থাপনা বদলাবার কথা ভাবেন, কিন্তু নতুন ব্যবস্থাটি চালু করার আগেই তাকে কোচবিহার-অসম অভিযানে যেতে হয়। এই অভিযানে প্রচুর নৌসেনাপতি মারা যায় এবং গোটা নৌ বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। ইবন হুসেইন পদত্যাগ করলে মহম্মদ বেগকে এর দায়িত্ব দিয়ে তার গুণগত মান, সংখ্যা এবং অবস্থা সমীক্ষাপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। নৌ বাহিনীর পতনের ফলে বাংলায় মগ এবং পর্তুগিজ হার্মাদদের অত্যাচার বাড়তে থাকে। ১৬৬৪ সালে নৌবাহিনীর দায়ত্বে থাকা সদরইসৈরাব মুনাওয়ার খান ‘কয়েকটি ভাঙা ঝুরঝুরে নৌকো’ সম্বল করে তাদের মুখোমুখি হতে না পেরে পালিয়ে যান। পরে সায়েস্তা খান এসে সামগ্রিক নৌবহর গড়ে তোলেন।
(চলবে)

Wednesday, January 25, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৬৭ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

২। মীর জুমলার বাঙলা প্রশাসন
প্রায় তিন বছর(৯ মে ১৬৬০-৩১ মার্চ ১৬৬৩) বাঙলার প্রশাসনিকভার সামলান মীর জুমলা। কিন্তু যেহেতু তিনি নভেম্বর ১৬৬১ সাল থেকেই অসম আর কোচবিহারের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, তাঁর বাঙলার প্রশাসনিক দায়িত্বের কার্যকর মেয়াদকাল ছিল মোটামুটি দেড় বছর। দীর্ঘকাল পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যে প্রশাসনিক সংস্কার করে সুফলগুলি পাওয়া যাওয়ার সুযোগটি তিনি পান নি। সরকার, পরগণা এবং তাঁর আমলাতান্ত্রিকতার যে ব্যবস্থা বাংলায় তাঁর আগে বর্তমান ছিল সেটি আকবরের সময়ে তৈরি। কার্যনির্বাহী শাসক(হুজুর), রাজস্ব(মল) এবং প্রশাসক এবং দেওয়ানের মধ্যে প্রশাসনিক বিভাগটিও আকবরের সময় থেকে বাংলায় পূর্ণদ্যমে চলে আসছে। প্রশাসক, সদর এবং বিচারক, কাজির মধ্যেও যে প্রশাসনিক পার্থক্য সেটি তখনও চালু ছিল। তবুও মীর জুমলার মত শক্তিশালী প্রশাসক খুব কম সময়েও তাঁর নিজের কর্মদক্ষতা প্রমান করেছেন বাংলায়।

তিনি পর্তুগিজ এবং আরাকানি দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রাথমিকভাবে বাঙলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় তুলে নিয়ে যান। টিপেরা, ঘোড়াঘাট আর হাজোর রাজা মীর জুমলাকে রাজস্ব দিতে অস্বীকার করেন। তিনি রশীদ খানের নেতৃত্বে হাজো, ফরহদ খানের নেতৃত্বে টিপেরা এবং সুজন সিংএর নেতৃত্বে ঘোড়াঘাটে সেনা পাঠানোর প্রস্তাব করেন।

রাজস্ব প্রশাসনে জমির যে তিন ধরণের ভাগ ছিল – খালসা, জায়গির বা জমিদারি এবং সায়ুরঘালই বজায় থাকল। ১৬৫৮এ শাহ সুজার প্রশাসনে তোডরমল্লের রাজস্ব প্রস্তাব আআসে এবং সেটি কিছুটা সংস্কার হয় পরের বছর। তোডরমল্লের আগে খালসায় আসল জমা হিসেব(৬৩,৪৪,২৬০ টাকা)রূপে আদায় ছিল। সেই পরিমানটি ২৪ লক্ষ টাকা বাড়ে (৮৭,৬৭,০১৬ টাকা)। কিন্তু জায়গির রাজস্বের বৃদ্ধি ঘটে নি (৪৩,৪৮,৮৯২ টাকা)। এই দুয়ে মিলিয়ে সুজার সময়ে বাঙলার মোট রাজস্ব ছিল ১,৩১,১৫,৯০৭ টাকা। এই হিসেব চলে আওরঙ্গজেবের প্রথম দস্তুর উল আমল(১০৬৯ অলহজ্ব এবং ১০৬৫ ফাসিলে) অর্থাৎ যখন মীর জুমলা বাঙলার সুবাদার বা নবাব হয়ে এলেন, সেই সময় পর্যন্ত। কিন্তু বাস্তবে সংগ্রহ হল মাত্র ৮৬,১৯,২৪৭ টাকা, যা আদতে শাহ সুজার সময়ের আদায়ি মোট খালসা রাজস্বের কিছু কম। এই কম অর্থ আদায়ের বড় কারণ হিবে ধরা হয় সে সময়ে বাঙলার রাজনৈতিক আস্থিরতাকে। রাজস্ব বিষয়ে স্থায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই তাকে কোচবিহার এবং অসম অভিযানে চলে যেতে হয়।

ঢাকায় প্রশাসন চালানোর সময় খালসা জমিতে কৃষকদের থেকে তিনি তাঁর প্রজ্ঞা এবং বাস্তবতা প্রয়োগ করে রাজস্ব আদায় করেছেন।

অন্যদিকে মনসবদারদের থেকে জায়গিরগুলির আদায়ও খুব কিছু সন্তোষজনক ছিল না। যেহেতু সেগুলি দূরে দূরে ভিন্ন ভচি পরগণায় অবস্থিত ছিল, এবং তাদের সঙ্গে জুড়ে ছিল প্রচুর অংশিদার, ফলে কৃষকদের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ত। কৃষকদের ওপর অত্যাচার হত এবং পরগণাগুলি শেষ পর্যন্ত জনশূন্য থেকেই যেত।

সায়ুরঘাল জমিগুলি বিষয়ে বলা যায়, মীর জুমলা নিজের জায়গিরে প্রচুর আয়মাদার এবং জলপানি পাওয়া গুণীকে বসিয়েছিলেন। এছাড়াও বহু মানুষ যারা সম্রাটের থেকে শুল্কশূন্য জমি ভোগের ফরমান পেতেন তারাও এই সব জমিতে বসতেন। কিন্তু বহু সময় দেখা গিয়েছে জায়গিরদারের বদলি বা মৃত্যুর পর বহু সময়ে এই ভোগদখলকারীর উত্তরাধিকারীদের হাতে এই জমিগুলি ভোগের পাট্টা থাকত না। মীর জুমলার মৃত্যুর পর তার জায়গিরে এই ধরণের শুল্কমুক্ত জমির(মদদইমাশ, আয়মা, সয়ুরঘাল) দখলদারি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ১৬৬০ সালে সদর, কাজি রিজভি এই ধরণের অধিকারগুলির দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। যাদের হাতে সম্রাট বা জায়গিরদারের ফরমান ছিল না, তাদের তিনি জমির ভোগদখল থেকে উচ্ছেদ করেন। জমিগুলি জায়গিরদারদের এস্টেটে দখলিকৃত হয়। আয়মাদারদের জমি কর্ষণের অধিকার দেওয়া হল, এবং তাদের রাজস্বও দিতে হত। এই নির্দেশ আয়মাদারদের ওপরে খুব গভীর হল, কেননা আয়মাদারেরা জমি চাষ করতেন না, ফলে তাদের রাজস্ব দেওয়ার কোন সুযোগই ছিল না। তারা সদর, কাজি রিজভির বিরুদ্ধে শায়েস্তা খাঁয়ের কাছে অভিযোগ করেন এবং তার প্রতিবিধান তারা উসুল করেন শায়েস্তা খানের থেকে।

জাকাত, আয়ের একের চল্লিশভাগের একভাগ কর আদায় হতে থাকল হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সওদাগর(মার্চেন্টস), ভ্রমণকারীদের থেকে এবং শুল্ক(কাস্টম - হাসিল) আদায় করা হতে থাকল কারিগর, ব্যবসায়ী(ট্রেডসমেন), খুশনসিন(নবাগত বা ধনী)দের থেকে। পরগনাগুলিতে জায়গিরদার বা জমিদার নিঃসন্তান রায়ত, নবাগত, বা মরন্মুখ ব্যক্তিদের সম্পত্তি, এমন কি স্ত্রী, কন্যা দখল নিতে শুরু করত।

তাঁর সময়কালে মীর জুমলা দ্রুত এবং যথাযোগ্য বিচারের ব্যবস্থা করেন। তিনি নিজে প্রশাসনিক কাজে আকবরের দেখানো পদ্ধতির অত্যন্ত অনুগামী ছিলেন, ফলে তাঁর কাছে বিচার চাইতে আসা সাধারণের তিনি কোন বাধা ছাড়াই সরাসরি বিচার দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তিনি নদীর মুখোমুখি নিজের আসনে বসে অস্ত্রহীন উচ্চনীচ ধনীনির্ধন ভেদাভেদ না করেই যথাযোগ্য বিচার করতেন। ঢাকার নারায়ণগঞ্জের কাছে খিজিরপুরে থাকাকালীন দই বেচানী এক মহিলাকে ডেকে তাঁর এক চাকর অর্থ ছাড়াই দই নিয়েছিল। সেই মহিলা সঙ্গে সঙ্গে নবাবের কাছে বিচার চেয়ে বসল। স্বভাবত চাকরটি সেই অভিযোগ অস্বীকার করে। তাকে বমির ওষুধ দিয়ে বমি করানো হলে দেখা গেল সে খাবারের সঙ্গে দইও বমি করে। সুবাদার তখন তাঁর পেট কেটে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রেখেদিয়েছিলেন, যাতে এ ধরণের কাজ করতে গিয়ে অন্যেরা সতর্ক হয়। সে সময় জনশ্রুতি ছিল, মীর জুমলার এই বিচারের পদ্ধতি এমন কার্যকর হয় যে কেউ একটাও খড় চুরি করত না।

তাঁর কাছে খবর ছিল ঢাকার কাজি মোল্লা মুস্তাফা ঘুষ নেন এবং মীর আদিল তাকে এই কাজে সাহায্য করেন। তিনি উভয়কেই ঢাকা থেকে বহিষ্কার করেন এবং স্বয়ং ধর্মীয় এবং অন্যান্য বিষয়ে বিচারের দায় নিজের কাঁধে তুলে নেন। তিনি যেটিকে ঠিক বলে বিশ্বাস করেন সেটি নিজে পালন করতেন। অসমের পথে অভিযান করার সময় নির্দেশ দিয়ে গেলেন কোরানীয় বিধিতে যে বিচার হবে সেটি করবেন শেখ আজম, কিন্তু কাগজকলমে তিনি কাজির পাঞ্জা ব্যবহার করতে পারবেন না। ধার দেওয়া বা ধার শোধ চাইবার বা চুরি যাওয়া সম্পদ ফেরত পাওয়ার সময় রাষ্ট্র থানা মার্ফত একের চল্লিশাংশ কেটে রেখে দিত। বিচারকের সামনে অভিযোগ করা বাদী বিবাদী মমলার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তাদের ধরে রাখা হত, এবং যিনি সমন বা নির্দেশ নিয়ে যেতেন তাকে প্রত্যেক দিন শুল্ক দিতে হত যা রাজস্ব হিসেবে জমা পড়ত।
(চলবে)

Tuesday, January 24, 2017

মাটির ঘ্রাণ নেওয়ার দুঃসাহস

যতদিন গ্রামীন মানুষদের পাশে রয়েছেন ততদিন আপনি বাংলার দিদি
১৭৫৭র পর বাংলার দেশজ কারু-বস্ত্র-অভিকর শিল্পীদের জীবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মতো গুরুত্ব দেওয়ার কাজ কেউ করেনি - সামাজিক গুরুত্ব আর আর্থিক গুরুত্বও। অভিকর শিল্পীরা মাসে ১০০০টাকা ভাতা পাচ্ছেন, তার সঙ্গে নিয়মিত অনুষ্ঠান। ভাবা যায় না। আগের সরকার তাঁদের শুধু পরিচয়-পত্র দিতে যেভাবে গড়িমসি করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। মমতা সরকার যেভাবে শিল্পীদের নানান কাজে তাঁদের উৎপাদন আর শিল্পের চরিত্র বজায় রেখে সরকারের নানান কাজে সামিল করছেন তা উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। শুধু মেলার সংখ্যা এত বেড়েছে যে পরম-এর দোকানে পণ্য দেওয়ার মতো যোগ্য শিল্পী মিলছে না। গ্রাম বাংলার পরম্পরার উৎপাদন-বিতরণের ইতিহাসে বিশ্ববাংলার থেকে বড় ঘটনা ঘটেনি। আসলে কেউ লক্ষ করছেন কি না জানি না, গ্রাম বাংলায় সরাসরি এই মানুষদের হাতে সম্পদ জড়ো হচ্ছে। এতদন এই টাকাটা শহরের মানুষই ভোগ করতেন নানান ভাবে এই মানুষদের জন্য কাজের ছুতোয় - ইওরোপ কথিত তথাকথিত লোকসংস্কৃতির গবেষণা করতে গিয়ে। সেই মধ্যবিত্তীয় সুযোগ নেওয়ার প্রবণতা মমতা সরকার রাখেননি।
শুধু মাত্র ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে এই কথা বলার আগে দুবার ভাবতাম। ভাবতাম শুধু তোয়াজ করার কাজ করছে। কিন্তু তাঁদের সারাবছর অনুষ্ঠান করতে দিতে হবে - এর থেকে বড় সিদ্ধান্ত কোনো সরকার নেয়নি। এর আগে আমরা বেশ কিছু মেলা করেছি, কিছু কলকাতায় কিছু প্রত্যন্ত গ্রামে। দেখেছি ছোট উৎপাদকেরা নিজেদের জিনিসপত্র বিক্রি করে রোজগার করতেন। কিন্তু অভিকর শিল্পীদের সেই সুযোগ নেই। তাহলে? আমাদের বহু কষ্ট করে টাকা যোগাড় করতে হত তাঁদের দেওয়ার জন্য।
এই ভাবনাটা মমতা করেছেন। সারা বছর সরকারি অনুষ্ঠানের আগে বাংলানাটকের মতো এনজিওরা নিয়ে চলে যেত - অথচ তাঁরা কোটি কোটি টাকা দান পান। তাঁরা আমলাদের রসেবসে রেখে কাজ তুলতেন। সেই কোম্পানিগুলিকে কাজ থেকে হঠিয়ে দিয়েছেন মমতা। এই কাজ করতে শুধু প্রশাসনিক দক্ষতা, দৃঢতা বা বিশ্বাযোগ্যতা প্রয়োজন হয় তাই নয় প্র্য়োজন হয় মাটির ঘ্রাণ নাকে নেওয়ার দুঃসাসহকে। এই গণতন্ত্রতে মধ্যবিত্তকে চটিয়ে টিকে থাকা যায় না - বিগত ৩৪ বছর তার প্রমাণ। বামফ্রন্ট বিগত ৩৪ বছরে গ্রামীণ মধ্যবিত্তকে তোয়াজ করে বেঁচেছে আর সাধারণদের খুদকুঁড়ো দিয়েছে। সেই কাজের চাল ফেরতা করে দিলেন মমতা। অসংখ্য কুর্ণিশ।
যতদিন গ্রামীন মানুষদের পাশে রয়েছেন ততদিন আপনি বাংলার দিদি

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৬৬ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

মীর জুমলা খুব কঠিন ধাতের মানুষ ছিলেন, তিনি মন রাখা প্রতিশ্রুতিতে বিন্দুমাত্রও প্রভাবিত হতেন না। তিনি বহু সময় অপেক্ষা করলেন, কুঠিয়ালদের প্রতি সভ্যতা এবং শালীনতা প্রদর্শন করলেন। ক্রমে তাঁর দীর্ঘ অপেক্ষা রাগে রূপান্তরিত হল। আর কোন সমঝোতা নয়, অবিলম্বে নগদে টাকা ছাড়া অন্য কোন কিছুতে সন্তুষ্ট হবেন না জানিয়ে দিলেন। বালেশ্বরের সুবাদারকে বললেন সব ধরণের ব্রিটিশ রপ্তানির ওপর ৪% রপ্তানি শুল্ক প্রয়োগ করতে এবং বন্দরে জাহাজ ভেড়ানোর জন্য একটা শুল্ক চাপিয়ে দিতে এবং ত্রেভিসাকে হুগলীতে পাঠিয়ে দিতে। নভেম্বরে দেখা গেল ব্রিটিশদের সমস্ত ব্যবসাই প্রায় বন্ধের মুখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় বেনিয়াদের থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে যে সব বিপুল পণ্যের দাদন দেওয়া হয়েছে, তাকে সন্তষ্ট না করলে সে সবগুলি তিনি দখল নেবেন। হুগলী কুঠিয়ালের সামনে বিপুল দুর্যোগের ঘনঘটা। বিপুল বিনিয়োগে সে বছরের জন্য যে সব পণ্য তারা কিনেছেন, হয়ত মীর জুমলা তাদের সব জাহাজকে বন্দর ছাড়তে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন, সে সবের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি হবে তাই তাঁর মাথা ব্যথা থেকেই গেল। সারা ভারতের সরতাজ বাঙলার ব্রিটিশ ব্যবসা হাত ছাড়া হতে বসেছে দেখে ব্রিটিশদের টড়নক নড়ল যে জাহাজ কাণ্ডকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধা করে ফেলা অত্যন্ত জরুরি।

পাটনায় সোরা ব্যবসার নিষেধাজ্ঞায় উদ্বিগ্ন সুরাটের কুঠিয়াল মাদ্রাজের আধিকারিকদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়ে জাহাজ কাণ্ডকে যততাড়াতাড়ি সম্ভব মিটিয়ে নিতে এবং মীর জুমলার ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিলেন(৩ জুন ১৬৫৯)। একই সঙ্গে সেই নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ১২ অক্টোবর এক নির্দেশে গ্রিনহিল এস্টেট থেকে মীর জুমলাকে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশনামা জারি করলেন। নভেম্বরের শুরুতে মাদ্রাজের কুঠিয়াল, বাঙলার কুঠিয়ালকে পরামর্শ দিলেন যাতে তারা নবাবের চাহিদা মত যত বেশি সম্ভব ক্ষতিপূরণ দিয়ে ব্যাপারটার একটা স্থায়ী মিটমাট করে নেওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু হঠাতই তাঁর কানে মীর জুমলার যুদ্ধে হারের উড়ো খবর পৌ্ঁছনোয় তিনি বাংলার কুঠিয়ালদের জোর দিয়ে বললেন যে তারা যেন মীর জুমলাকে বুঝিয়ে দেন, মীর জুমলার কাজে যদি তাঁদের কোম্পানির ক্ষতি হয় তাহলে তাদের প্রত্যাঘাত করার যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। খবরটা যে সত্যি উড়ো এবং ভিত্তিহীন সেটা বাঙলার কুঠিয়ালেরা জানত এবং তারা জানত জাহাজ কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মীর জুমলার প্রকৃত ক্ষমতার ব্যপ্তি এবং মাদ্রাজের কুঠিয়ালের এ ধরণের পরামর্শ হাস্যকর ছাড়া আর কিছু নয়।

শেষে ১ ডিসেম্বর ত্রেভিসা কেনের সঙ্গে হুগলি ত্যাগ করে মীর জুমলার শিবিরের দিকে রওনা হল মীর জুমলার সঙ্গে জাহাজ কাণ্ডটির দরাদরি করে স্থায়ী সমাধানের উদ্দেশ্যে। নবাবের সঙ্গে তার যে সব শর্তে চুক্তি হয় সেগুলি হল- ১) সমস্ত দখল নেওয়া পণ্য সহ জাহাজটি তাকে অবিলম্বে ফিরিয়ে দিতে হবে। ২) ক্ষতিপূরণের অর্থের বিষয়টি নিয়ে তাঁর পক্ষ থেকে তাবাতাবাই এবং ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে সর্বশ্রী ঊম আ কোর্ট এবং জার্সি যৌথভাবে দেখাশোনা করবেন এবং এটি আগামী চার মাসের এই হিসেব মধ্যে শেষ করতে হবে। মীর জুমলার ভাবভঙ্গী দেখে ত্রেভিসার মনে হল তাকে সন্তুষ্ট না করতে পারলে নবাব ব্রিটিশদের খোলা হাতে ব্যবসা করার ছাড়পত্র দেবেন না। কিন্তু ৭ জুমাদা ১০৭০, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৬৬০ সালে শাহজাহানের ফার্মানের অনুসরণে তিনি ত্রেভিসার সমস্ত আশঙ্কা উপেক্ষা করে বাস্তবতা অনুসরণ করে ব্রিটিশেরা যাতে ব্যবসা করতে পারেন, সে উদ্দেশ্যে যথাবিহিত দস্তক এবং পরওয়ানা জারি করেন।

ষষ্ঠ অধ্যায়
বাঙলার সুবাদার মীর জুমলা
১। বাঙলার সুবাদারি প্রাপ্তি
সুজার আরাকানে পলায়ন এবং মীর জুমলার ঢাকা প্রবেশের খবরে দশ দিনের উতসবের নির্দেশ দিলেন আওরঙ্গজেব(২৪মে)। শেষ ষোল মাস মীর জুমলা নানান বিপদ সামলে যেভাবে সাম্রাজ্যকে সেবা করেছেন, সেই কাজের পুরস্কার স্বরূপ তাকে বাঙলার সুবাদার পদে নিয়োগ করা হল।

জারি করা ফরমানে পাদশাহ স্পষ্টভাবে তাঁর পদপ্রাপ্তির কারণ উল্লেখ করেছেন। যে বিজয় তিনি অর্জন করেছেন, তাতে একজন মহান ক্ষমতাশালী চক্রবর্তী রাজাও গর্বিত হতেন, এবং যে আনুগত্যে, যে সাহসিকতায়, যে দক্ষতায়, যে প্রজ্ঞায় তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করে সাফল্য অর্জন করেছেন, তাঁর পদপ্রাপ্তি সেই সব গুণেরই প্রতিফলন মাত্র। মীর জুমলা তাঁর পুত্রকে লিখছেন, যে বাংলায় সঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। তাই এই প্রদেশে যোগ্য সুবাদারের পদপ্রাপ্তিটা মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে খুব জরুরি পদক্ষেপ ছিল। আওরঙ্গজেব তাকে লিখলেন, ‘সামগ্রিকভাবে, বহু বছর ধরে, বাঙলার প্রশাসনে গাছাড়া মনোভাব এবং শৈথিল্য, আনুগত্যের অভাব, এবং বিদ্রোহ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে, এবং সে তথ্য তোমার অজানা নয়... প্রত্যেক জেলায় স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের মদতে দাঙ্গা আর বিদ্রোহের আগুণ জ্বলছে।’ এর আগে মীর জুমলা বাঙলার সুবাদারির পদ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই যুক্তিতে, যে এই স্বার্থপর পদক্ষেপে তাঁর অনুগামীরা তাকে ভুল বুঝে তাঁর থেকে দূরে সরে যাবে। কিন্তু পাদশাহের যুক্তি ছিল বাঙলার মত গুরুত্বপূর্ণ সুবার দায়িত্ব তিনি মীর জুমলা ছাড়া অন্য কারোর হাতে দিতে বিন্দুমাত্র উতসাহী নন, কেননা মীর জুমলার আনুগত্য, দক্ষতা সততা, বিচারের পদ্ধতি এবং নৈতিকতাই তাকে এই পদে যোগ্য করে তুলেছে।

তাঁর আগের মনসব ছাড়াও তাকে হপ্ত হাজারহফত হাজার সওয়ারএর মধ্যে ৩০০০ সওয়ার হবে শেহ আসপা দু আসপা। এক কোটি দাম বেতন ছাড়াও তনখা হিসেবে আগের সুবাদারদের জন্য বরাদ্দ মহালগুলি থেকে বেছে বেছে সব থেকে ভাল জাগিরগুলি দেওয়া হল। একটি অপূর্ব খিলাত, কন্সতান্তিনোপলের তুর্কি সম্রাটের আস্তাবলে থেকে শাহজাহানের ৩১তম জালুসে(বছরে)র উপলক্ষ্যে উপহার দেওয়া থেকে সব থেকে ভাল, বিশেষ এবং দ্রুততম ইরাকি এবং আরবি ১০টি ঘোড়ার সঙ্গে সম্রাটের নিজের আস্তাবলের আরও ৪০টি তাতারি(তুর্কি, ইংরেজদের ভুলভাল উচ্চারণে টাট্টু ঘোড়া) ঘোড়া, একটি মদ্দা হাতি সহ কয়েকটি হাতি দেওয়া হল। এর পরেও বলা হল, কোন মহালকে তিনি যদি খারাপ মনে করেন, এবং সেটি বদলে যদি অন্য কোন ভাল পরগণা মহাল হিসেবে চান, তাহলে তার ইচ্ছে পাদসাহকে জানিয়ে সেটি বদল করে দেওয়া হবে। এ ছাড়াও একটি রত্ন খচিত কোমর বন্ধনী তাঁর সঙ্গে রত্ন খচিত তরবারি, যেটির হাতল আকীক(agate) রত্নদ্বারা তৈরি উপহার দেওয়া হয়।

আওরঙ্গজেব তাঁকে নির্দেশ দিলেন বিক্ষুব্ধদের শান্ত করতে, আইনভঙ্গকারীদের শাস্তি দিতে, গোলান্দাজ এবং বন্দুকবাজদের আয়ত্ত্বে আনতে – বিশেষ করে নোবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলিকে, রাস্তা, রাজপথের আবাধ গতায়াতের বন্দোবস্ত করতে এবং এই কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী জারি করতে। সম্রাট তাকে লিখলেন, ‘অশক্তের ওপর ক্ষমতাশালীর হাত, শোষকের ওপর শোষিতের হাত বলপূর্বক সরিয়ে দিতে হবে। জীবনের সব ক্ষেত্রে শারিয়তের আইন প্রযুক্ত এবং বিচার সুনিশ্চিত করবে। সর্বশক্তিমানের সৃষ্টি সব জীবের বিশেষ করে গৃহী এবং বিদেশি ভ্রমণকারীদের শান্তি দেওয়া তাদের উন্নতি ঘটানো দরকার, এবং সীমান্তের ওপর সদা সতর্ক তোমার নজরদারি থাকুক। অত্যাচারীদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে যাতে কৃষকেরা যাতে চাষের কাজ অবাধে করতে পারে সেই দিকে তোমার মনযোগ ধাবিত হোক।’

পরগনার বিভিন্ন বিদ্রোহী জমিদার বিশেষ করে অসমীয়া এবং মগেদের শাস্তি দেওয়ার কাজে মীর জুমলাকে নির্দেশ দেন, কেননা এরা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার এবং দুর্ব্যবহার করত। ইসলামের সৌভাতৃত্ব এবং ধর্মাচার অবাধ করার জন্য তিনি মীর জুমলাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সেনানীকে অন্তত এক বছর বাংলায় থাকার নির্দেশ দিয়ে কয়েকজনকে দিল্লিতে ডেকে নিয়েছিলেন। এবং যদি মীর জুমলা তাদের মধ্যে থেকে কাউকে যোগ্য মনে করে রেখে দেওয়ার প্রস্তাব সম্রাটকে দেন তাহলে তাঁর অনুরোধ পালন করা হবে।

আওরঙ্গজেবের ৪৪তম জন্মদিবসে(১৫ জুলাই, ১৬৬০) মীর জুমলার সুজার বিরুদ্ধে জয় স্মরণে রাখতে তাকে নতুন করে সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাঙলা জয়ের জন্য তিনি খানইখানান এবং সিপাহসালার উপাধি অর্জন করলেন, ৭০০০ মনসবদার করা হয় তাকে, পাশাপাশি তাঁর পদকে আরও ২০০০ দু আসপা শেহ আসপা বাড়ানো হয়। তাঁর ব্যক্তিগত অনুগামীর মধ্যে ২০০০কে দু আসপা শেহ আসপা করা হয়। এই উপলক্ষ্যে তাকে একটি বিশেষ খেলাত এবং একটি সোনার তরোয়ালও দেওয়া হয়।
(চলবে)

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৬৫ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার
ষষ্ঠ পর্ব
ইওরোপিয়দের সঙ্গে মীর জুমলার সম্পর্ক(১৬৫৮-৬০)

১। জাহাজ পর্ব তখনও সমাধা হয় নি
১৬৫৮র চুক্তিতে গ্রীনহিলের কুঠিয়ালির সময় মীর জুমলার যে জাহাজটি ব্রিটিশেরা দখল করেছিল, সেই পর্ব তখনও সমাধানের পথে হাঁটে নি। গ্রিনহিল সেটি এডোয়ার্ড উইন্টারকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন, উইন্টার সেটি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যে মীর জুমলার বাড়তে থাকা প্রভাবে শঙ্কিত হয়ে সুরাটের আধিকারিকরা মাদ্রাজ দপ্তরকে জানাল(২৭ নভেম্বর ১৬৫৮) উইন্টারের থেকে জাহাজটির দাম উসুল করা হোক। মীর জুমলাকে শান্ত করা না গেলে মছলিপত্তনম এবং অন্যান্য এলাকার ব্যবসা সঙ্কটে পড়তে পারে এমন কি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। কমিটি অব নিউ জেনারেল স্টক(১৩ সেপ্টেম্বর ১৬৫৮) এই বিষয়ে কোন দায় নিতে অস্বীকার করে এবং কুঠিয়ালদের হুঁশিয়ারি দিয়ে আগামী দিনে স্থানীয় রাজনীতিতে মাথা ঢোকালে কি হাল হতে পারে তা এই ঘটনাটা থেকে শিক্ষা নিতে।

মীর জুমলার জাহাজ উদ্ধারে সম্রাট আওরঙ্গজেবের ফরমানের উত্তরে মীর জুমলার ব্যবসায়িক আধিকারিক মীর মহম্মদ হুসেইন টাপা টাপা(তাবাতাবাই) উইন্টারের কবল থেকে জাহাজটি উদ্ধারের দাবি জানালেন। মছলিপত্তনপমের কুঠিয়াল এই বিষয়ে মাথা গলাতে আস্বীকার করাতে টাপা টাপা(তাবাতাবাই) ব্রিটিশদের হাতে বন্দী মীর জুমলার সেনানী কাজি (মহম্মদ হাশিম)র মুক্তির দাবি জানালেন। এই সব হুঁশিয়ারিতে কোম্পানি এবং আধিকারিকেরা আশংকা করছিলেন যে তাদের ব্যবসার ওপরে আঘাত আসতে চলেছে।
ভারতের কোম্পানি এখন দুটি মতদ্বৈধতায় পড়েছে – একদিকে মীর জুমলার জাহাজ ফেরতের জোরালো দাবি কোম্পানির ইংলন্ডের কর্মকর্তা, বিশেষ করে গ্রিনহিলের উত্তরসূরী এজেন্ট চেম্বার, তার স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে কোন দায় নিতে অস্বীকার করছে, অন্যদিকে কোম্পানির নির্দেশে উইন্টার সেটি মীর জুমলার ব্যবসায়িক আধিকারিকের কাছে ফেরত দিয়েও পরে সেটি কেড়ে নেন, সে বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

২। বিহার আর বাংলায় মীর জুমলার দায়িত্ব
জাহাজ পর্বের আরও জটিলতা বাড়ল বাংলা-বিহারে জুড়ে সুজার বিরুদ্ধে লড়তে মীর জুমলাকে আওরঙ্গজেব সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ায়। যদিও ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা মীর জুমলাকে যমের মত ভয় করত, কিন্তু জাহাজ কাণ্ড সমাধানে তাদের উদ্দেশ্যটা অনেকটা ঘটনা প্রবাহের গতি এবং সিংহাসনের দখলের লড়াতে মীর জুমলার জড়িয়ে থাকা এবং তাঁর ভাগ্য পরিবর্তনের ওপর বহুলভাবে ছেড়ে দিয়েছিল। যদিও বাঙলার কুঠিয়ালেরা এই ঘটনাকে দেখছিল করমণ্ডল কুঠির দায়িত্ব হিসেবে, মীর জুমলা জাহাজ কাণ্ডকে দেখতেন সামগ্রিকভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে জড়িয়েই, এবং তিনি স্পষ্টতই মনে করতেন জাহাজ কাণ্ডে বাঙলার কুঠিয়ালেরা তাদের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। ফলে তার প্রথম কাজটাই হল এই ঘটনার শাস্তি স্বরূপ ব্রিটিশেরা যাতে বিহার থেকে সোরা কিনতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। তাঁর সঙ্গে দু’দুবার দেখা করেন পাটনা কুঠির কুঠিয়াল চেম্বারলিন। দ্বিতীয় আলোচনায়(২১ ফেব্রুয়ারি ১৬৫৯) মীর জুমলা ৬০০টাকার উপঢৌকন পেয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন, ব্রিটিশ কুঠিয়ালকে জলদস্যু বা ছিঁচকে চোরের থেকে বেশি মর্যাদা দেন নি। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি ব্রিটিশদের মাল পরিবহনে গাড়ি, নৌকোগুলি দখল হলে তাঁর সাপেক্ষে অগ্রিম ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দস্তক দিতে অস্বীকার করেন এবং একই সঙ্গে বলেন চেম্বারলিনকে গ্রেফতার এবং তাঁর কুঠিকে দখল না করে তাদের প্রতি তিনি যথেষ্টই দয়া দেখিয়েছেন। চেম্বারলিন যেন এটা মনে রাখেন।

সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মীর জুমলার জয় ব্রিটিশদের বাধ্য করল যতদূর সম্ভব মীর জুমলারকে শান্ত রাখার নীতি গ্রহণ করতে। জাহাজটি হয় ফেরত পাওয়া যাবে নয়ত ক্ষতিপূরণ, এবং এই বিষয়টি তিনি বালেশ্বরের কুঠিয়ালের মাধ্যমে সেন্ট জর্জের কুঠিয়ালকে সাড়ে চারমাসের মধ্যে সমাধান করতে অনুরোধ করেছেন, চেম্বারলিনের এই আশ্বাসে পাটনায় ব্রিটিশদের ব্যবসার আনুমতি দিলেন মীর জুমলা এবভং বললেন তাঁর কর্মচারী সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র হাতে পেয়ে সন্তুষ্ট হলে জাহাজ কাণ্ডের সমাধান হয়েছে বলে তিনি মেনে নেবেন।

গোলাগুলি এবং অন্যান্য রসদের সরবরাহ বিষয়ে ডাচেদের সাহায্য চাইতে কাশিমবাজারের কুঠিয়ালকে তাঁর শিবিরে ডেকে পাঠান মীর জুমলা। যেহেতু তাঁর জন্য ব্রিটিশেরা অপেক্ষা করে নি বলে ব্রিটিশদের কাশিমবাজার কুঠি বন্ধে নির্দেশ দেন তিনি। এই নিষেধাজ্ঞা তুলতে কুঠিয়াল কেনকে মে মাসে মীর জুমলার সঙ্গে দু’দুবার দেখা করতে হয়। মীর জুমলা উপঢৌকন নিতে আস্বীকার করেন এবং তাঁর জাহাজটিকে ফেরত এবং ৪০০০০টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। তিনি এর জন্য দুমাসের বেশি অপেক্ষা করতে পারবেন না জানিয়ে দেন, এবং এই কাজের ক্ষতিপূরণের মঞ্জুরিপত্র কেন যাতে বালেশ্বর এবং হুগলী থেকে আনিয়ে নিতে পারেন তাঁর জন্য তাকে বেশ কিছু দিন সময় দেন এবং এটি না করতে পারলে তাদের সব ব্যবসা বন্ধ করিয়ে দেওয়ার এবং সবধরণের অগ্রিম ক্ষতিপূরণের দস্তক না দেওয়ার এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের মজুদ সোরাও দখল করার হুমকি দেন। মে মাসের শেষের দিকে হুগলীর স্থানীয় কুঠিয়ালদের থেকে চিঠি নিয়ে ম্যাথিয়াস হলস্টেড মীর জুমলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন এবং সেই চিঠির প্রেক্ষিতে মীর জুমলা ব্রিটিশদের দাবি কিছুটা মেনে নেন। বালেশ্বর এবং হুগলীর কুঠিয়ালেরা নবাবের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৫০০০টাকা ধার্য করার সিদ্ধান্ত নেন। জুনের প্রথম দিকে হলস্টেড আর কেন মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করেন এবং এক মাসের মধ্যে তাঁর দখল করা পণ্যের দাম মিটিয়ে দিলে ব্রিটিশদের দস্তক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

ডাচ কুঠিয়াল ম্যাথায়াস ভ্যান ডেন ব্রোক মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করতে চললেন, ডচেরা হুগলী নদী নৌকো এবং কামান নিয়ে পাহারা দেওয়ার কাজ নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়ায় তাদের ব্যবসার পথ রোধ হয় নি। সে সময় কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছিল যে বিপুল অর্থের বিনিময়ে ডাচেরা হুগলীর প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। জুনের মাঝখানে শাহজাদা মহম্মদ সুলতান মীর জুমলার শিবির ছেড়ে সুজার বাহিনীতে যোগ দেওয়ায়, ব্রিটিশেরা সেই সুযোগে জাহাজ নিয়ে দরকষাকষির ব্যাপারটা একটু ঢিলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আগের চুক্তি অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের শুরুতে কেন মুর্শিদাবাদে এসে মীর জুমলা এবং বালেশ্বরের কুঠিয়াল ত্রেভিসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। যুদ্ধের অনিশ্চিতির বাহানা দেখিয়ে বালেশ্বরের কুঠিয়াল ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়া আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে এবং যুদ্ধের গতি কোন দিকে গড়ায় দেখে তা সিদ্ধন্ত নেওয়া হবে কেনকে বলে জানায়। ত্রেভিসা নবাবের সঙ্গে দেখা করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সুরাটের প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু এবং মছলিপত্তনমের মীর জুমলার আধিকারিকের চিঠি মীর জুমলার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন।
(চলবে)

Friday, January 20, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - বিশ্ববাংলা বিপনী

আমলারা সাংসদ যোগেন চৌধুরীর ছবি কেনার সময় তাঁর ছবির উতপাদন ব্যয় চাইবেন তো?

বেশ বড় লেখা হবে। দয়াকরে চোখ বুলোবেন। ভাঙ্গড়ের বিপ্লবী উত্তাপে যেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পিছনে চলে না যায়।

আমরা মনে করি মমতা সরকার গ্রামের বিকাশের জন্য যা করেছেন, সেই কাজ বিগত ২৫০ বছরে কোন সরকার করে নি।

অথচ সরকারের গ্রাম-লক্ষ উদ্দেশ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প - বিশ্ববাংলাকে রাস্তা ছাড়া করতে আমলারা উঠে পড়ে লেগেছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্ববাংলা বিপনী প্রকল্প শুরু করেছিলেন সরকারে আসার প্রথম বছর থেকেই। অসাধারণ ছিল সেই প্রকল্পটি - অতীতের ভুলগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে গ্রাম উদ্যোগীদের থেকে পণ্য কিনে বিক্রি করা।

সমস্যা ছিল। বিশ্ববাংলার দাম।

বিপনীগুলোয় পণ্য কি দামে বিক্রি হয়, তা ভুক্তোভুগীরা নিশ্চই খেয়াল করেছেন। মাস পাঁচেক আগে দীপঙ্কর(দে)দা একটা শাড়ি কিনতে গিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলেন।

যে দামে আমলারা পণ্য কিনতেন তার থেকে অন্তত চারগুণ দামে সেই পণ্য তাদের দোকানে বিক্রি করতেন। সেই চড়ানো দামের ভাগিদার হতেন না গ্রামীন উতপাদকেরা। এই নীতি হয়ত কর্পোরেট/ব্যক্তিগত উদ্যমের আপণে চলতে পারে, কিন্তু কেন কোনও সরকারি উদ্যমে চলবে তার কোন সদুত্তর ছিল না।

এবং গত কয়েক বছর ধরেই গ্রামীন উদ্যোগীরা তাদের পণ্যের নির্দিষ্ট দাম বাড়াবার দরবার করছিলেন। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ধুয়ো দেখিয়ে সেগুলি এড়িয়ে গিয়েছেন কর্মকর্তারা। আর দাম বাড়াবার কথা বললেই পণ্য না নেওয়ার পরোক্ষ হুমকি তো ছিলই।

এ প্রসঙ্গে বলা ভাল বিশ্ববাংলার পণ্য কেনে এবং টাকা দেয় মঞ্জুষা। সেখানে তিন/চার মাসের আগে টাকাই পাওয়া যায় না।

তবুও চলছিল। বেশ ভালই। নানান অসুবিধে মোটামুটি মেনেই নিয়েছিলেন বাঙলার গ্রামীন উতপাদকেরা।

কিন্তু গোল লাগল গত পাঁচ ছ মাস আগে।

দপ্তরের আমলারা একটা ফরমান জারি করলেন, যাতে বলা হল প্রত্যেক সরবরাহকারীকে তাদের উতপাদনের ব্যয় দপ্তরকে জানাতে হবে - এবং একটা নির্দিষ্ট দিনে সেই ব্যয়ের তালিকা নিয়ে উতপাদকেদের আমলাদের কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে তাদের সন্তষ্ট করতে হবে। আমলারা যদি তাদের জবাবে সন্তুষ্ট হন, তাহলে তাদের থেকে যে দামে পণ্য কেনা হচ্ছে সেই দাম বজায় থাকবে, নয়ত কমবে।

পণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি তো খারিজই করা হল, উলটে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হল, যাতে উদ্যমীরা দাম কমাতে বাধ্য হয়।

এই নব্য আমলাতান্ত্রিক দাম কমানোর নীতি কি আদৌ বিশ্ববাংলা তৈরির নীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ?

সেই প্রসঙ্গে কতগুলি প্রশ্ন; সেগুলি জরুরি কি না ঠিক করবেন সরকারের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা -

১। সরকার গ্রামীন যে উৎপাদনগুলি কিনছে সেগুলির উতপাদন খরচ জানতে চেয়ে ফরমান জারি করতে পারে? এটি কতটা নীতি সাপেক্ষ? সেই বৈঠকে উপস্থিত না হলে কি তাদের কালো তালিকভুক্ত করার হুমকি দিতে পারে?

২। আমুল বা ব্রিটানিয়ারমত নামি ব্রাণ্ডের পণ্যের উতপাদন ব্যয় চাওয়া হবে তো? কোম্পানির আমলাদের জবাবে সরকারি আমলারা যদি সন্তুষ্ট না হন, তাহলে তাদের পণ্যের দাম কমাতে বলার বুকের পাটা ক'জন আমলার রয়েছে ?

২। গত চার/পাঁচবছর ধরে বিশ্ববাংলাকে এক পাটের জুতো উতপাদক(এক জোড়ার দাম মাত্র ১০০-১১০টাকা, এই দামে বাজারে অন্য কোন জুতো কিনে দেখুন) একই দামে জুতো সরবরাহ করে আসছেন।গত দু'বছর ধরে তাঁর দাম বাড়ানোর আকুতি সরকারের আমলারা প্রত্যেকবার খারিজ করে দিয়েছেন। সরকার কি মনে করে, শ্রমের মূল্য তো ছেড়েই দিলাম, এই কয়েক বছরে বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ে নি একই আছে?

৩। একটা ৫০০ টাকার মুখোশ আর ১০টাকার পুতুলের দাম কি তার কাঁচা মাল আর শ্রমের মূল্য দিয়ে নির্ধারিত হয়, নাকি তার পরম্পরারগুণে, তার ঐতিহ্যের টানে নির্ধারিত হয়।

৪। তাহলে প্রশ্ন এবার থেকে সরকারের আমলারা, সাংসদ যোগেন চৌধুরীর ছবি কেনার সময় তাঁর ছবির উতপাদন ব্যয় চাইবেন তো?

আমরা যারা এই মানুষদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, তাদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কাছে প্রশ্ন হল, আপনার সরকার মানুষের কাছে দায়বদ্ধ, আমলারা নয়। এই আমলারাই সরকারকে পথভ্রষ্ট করার জন্য অন্যতম অনুঘটক। মন্ত্রীরা কি আমলাদের এই নীতি সমর্থন করছেন?

আমরা মনে করি গ্রামীনেরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমলাদের কাছে নয়।