জগদীশ নারায়ণ সরকার
৫। মীর জুমলার মৃত্যুর প্রভাব
বার্নিয়ে লিখছেন, ‘মীর জুমলার মৃত্যুর সংবাদে ভারত জুড়ে উত্তেজনার ঝড় তৈরি হল। বাওরি(Bowery)ও লিখছেন, তার রাজ্যের জ্ঞানী এবং সুচিন্তিত মানুষকে দুঃখ সাগরে ডুবিয়ে, মীর জুমলা মারা গেলেন। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হল, তা অপূরণীয়। সে সব থেকে দক্ষ নবাবকে হারাল। ২৩ এপ্রিল মীর জুমলার মৃত্যু সংবাদ লাহোরে আওরঙ্গজেবের কাছে পৌঁছল। মাঝের কিছু সময় ইতিশাম খান প্রশাসন এবং রায় ভগবতী দাস বাঙলা রাজস্ব প্রশাসনের দেখাশোনা করতেন। বাঙলা আর দাক্ষিণাত্যে মীর জুমলার সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রের নামে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সেটি তার পুত্রের দখলে ফিরিয়ে দিল মুঘল সাম্রাজ্য। নাতি মীর আবদুল্লাসহ, মীর জুমলার পরিবারবর্গ, তার সম্পত্তি, হাতি ইত্যাদি নিয়ে ইতিশাম খান সম্রাটের নির্দেশে দরবারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। সম্রাট নির্দেশ দিলেন যতক্ষণনা বিহার থেকে দাউদ খাঁ এসে পৌঁছচ্ছেন, ততক্ষণ দিলির খাঁ সুবাদার হিসেবে কাজ চালাবেন, এবং সুবাদার হিসেবে শায়েস্তা খাঁ যতক্ষণ না এসে পৌঁছচ্ছেন ততক্ষণ দাউদ খানই প্রশাসন চালাবেন।
বাঙলার প্রশাসন থেকে মীর জুমইলার মত দক্ষ, কড়া এবং প্রভাবশালী প্রশাসক চলে যাওয়ার পরে সুবা জুড়ে চরম অরাজকতা এবং প্রশাসনের কাঠামোয় শিথিলতা নেমে আসে। খানইখানানএর কড়া চাবুকে যে সব স্বার্থবাহী নিরস্ত ছিল, তারা নিজেদের চরিত্র জানান দিতে থাকে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী আমলা এবং ব্যক্তিরা প্রকাশ্যেই তাদের স্বার্থ পূরণ করতে উঠেপড়ে লাগল। ইতিসাম খান চরম দুর্বিনীত হয়ে উঠলেন। পদমর্যাদায় এবং ব্যক্তিত্বে তার থেকে অনেক ধাপ ওপরে থাকা দিলির খান অসন্তুষ্ট হলেও মনোভাব প্রকাশ্য করলেন না। প্রত্যেকেই স্বজনপোষণের চরম শিখরে উঠতে লাগল। ক্ষমতাচ্যুত জমিদারেরা তাদের জমিদারি দখল নিলেন। শিহাবুদ্দিন তালিশ এই সময়টিকে জঙ্গলের রাজত্ব নাম দিয়ে লিখছেন, মীর জুমলার মৃত্যুর পর বাংলায় অবিচার এবং বিদ্রোহ ছেয়ে যেতে শুরু করল।
সামরিক বাহিনীতেও এর প্রভাব কম পড়ে নি। মীর জুমলার মৃত্যুর পর কোচবিহার দখলের পরিকল্পনা স্থগিত করা হল। মীর জুমলা এই কাজে যাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আকসর খানের জেদএ দাউদখানের সমস্ত প্রস্তাব এবং পরামর্শ বিফলে গেল। আকসর খান নিজের জমিদারি চাকলা ফতেপুর ফিরে পেতে উদ্যোগী হয়ে উঠলেন।
মীর জুমলার পরওয়ানা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার শর্ত নিয়ন্ত্রিত হত। মীর জুমলার সমস্ত শুল্ক/কর দেওয়া থেকে ব্রিটিশদের বাঁচিয়ে রাখার পদক্ষেপএর আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠল, কেননা শাহজাহানের পরওয়ানা তখনও নতুন সম্রাট সম্মতি দেন নি। মীর জুমলার সময়ের বাধ্যবাধকতা থেকে বেরিয়ে এসে সর্বস্তরের আমলা, সওদাগরেদের থেকে বহিঃশুল্ক দাবি করল। মীর জুমলা তাদের ফোর্ট জর্জের যে অধিকার ব্রিটিশদের দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা তার শাসনে বসা উত্তরাধিকারীরা কিভাবে দেখবে তাই নিয়ে সংশয় দেখা দিল। ডাচেরা সম্রাটের থেকে ফরমান নিয়েছে এই যুক্তি দেখিয়ে বালেশ্বর, পাটনা এবং মাদ্রাজের কুঠিয়ালেরা সুরাটের কর্তাদের আওরঙ্গজেবের থেকে নতুন ফরমান আদায়ের জন্য উদ্যোগী হতে অনুরোধ করলেন। সুরাটের কর্তাদের গড়িমসিতে ক্ষুব্ধ বাঙলার কুঠিয়ালেরা দেওয়ান রায় ভগবতী দাসের থেকে একটা নির্দেশ নামায় পরিষ্কার করে নিলেন মীর জুমলার পরওয়ানা তখনও কার্যকর রয়েছে।
সপ্তম অধ্যায়
প্রথম পর্ব
অসম অভিযানের মুখবন্ধ – কোচবিহার জয়
১। সুজার কবল থেকে বাংলার নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেওয়ার পরে পরেই ভীমবেগে মুঘল ভারতের উত্তরপূর্ব ভারতের অসম রাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা ছকে ফেলা হল। ইওরোপিয় লেখকেদের বক্তব্য মুঘল পাদশাহ ভেবেচিন্তেই তার রণকুশল সেনানায়ককে সব থেকে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন যাতে মীর জুমলা দিল্লি থেকে বহুকাল বহুদূরে থাকতে বাধ্য হন। এই আক্রমণের পরিকল্পনার পিছনে আরও একটা বিষয় কাজ করছিল, মীর জুমলা তার বাহিনীকে নিয়ে বার্মা হয়ে চিন অভিযানের স্বপ্ন দেখে বিশ্বজয়ী হবার বাসনা মনে মনে পোষণ করতেন। অসম বুরুঞ্জীর লেখকদের অভিযোগ যে মীর জুমলা তার স্বপ্ন সাকার করতে সম্রাটের অনুমতি পর্যন্ত নেন নি। তবে বাদশাহের যে ফারমানে(জুন ১৬৬০) মীর জুমলাকে বাঙলার সুবাদার নিয়োগ করা হয়েছিল, সেই নথিতেই তাকে বাঙলার ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণ করে,। তাকে অসম এবং আরাকানের রাজাদের আক্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক কাজটি ছিল পালিয়ে থাকা সুজাকে আরাকান থেকে প্রত্যার্পন। তবে মীর জুমলা আরাকান আক্রমণ সাময়িক স্থগিত রেখে প্রথমে কোচবিহার-অসম অভিযানের অনুমতি আওরঙ্গজেবের থেকে নিয়েছিলেন।
তবে আমাদের মনে হয় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল কোচবিহার-অসম জিতে শুধু সাম্রাজ্যের সম্মান বজায় রাখাই নয়, সাম্রাজ্যকে নিরাপদ রাখাও অন্যতম দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। ১৬৩৯ সালের অসম-মুঘল চুক্তি অনুযায়ী পশ্চিম অসমের গুয়াহাটি থেকে মানস(মানাহা) নদী পর্যন্ত ভূভাগটি ছিল মুঘল নিয়ন্ত্রণে। তাদের ফৌজদার গুয়াহাটি থেকে কামরূপ সরকার শাসন করতেন। ১৬৫৭য় শাহজাহানের অসুস্থতা এবং সুজার বাঙলা সুবার নিয়ন্ত্রণ ঢিলে হয়ে যাওয়া আর তার নৌবহর শক্তিহীন হয়ে যাওয়ার পরেই হাজো শুদ্ধ মানস থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের উত্তরতটের এলাকায় দুটি আগুন(মার্চ এপ্রিল ১৬৫৮) জ্বলে ওঠে।
পশ্চিম থেকে মুঘল অধিকৃত কোচবিহার রাজ্যের রাজা প্রাণনারায়ন স্বাধীনতা ঘোষণা করে প্রজা এবং মুসলমানদের ওপর অত্যাচার শুরু করে হাজোয় শিবির স্থাপন করে। পূর্ব থেকে আক্রমন করে রাজা জয়ধ্বজ সিংহের সেনানায়ক বরগোঁহাই তাংচু সান্দিকুই করতোয়া পর্যন্ত জমি দখল করার মানসিকতা নিয়ে। কোন প্রতিরোধ না করতে পেরে মুঘল ফৌজদার মীর লুফতুল্লা পালিয়ে আসে জাহাঙ্গীর নগর(ঢাকা)। সান্দিকুই কোচেদের হাজোয় পরাজিত করে তাড়িয়ে দেয় এবং হারার পর মুঘলদের সঙ্গে যৌথ লড়ায়ে কোচেদের প্রস্তাব সান্দিকুই প্রত্যাখ্যান করে, বারিতলা পর্যন্ত কোনরকম বাধা ছাড়াই এগিয়ে এসে হাটশিলা বা হাতডোবা(ঢাকা থেকে মাত্র কিছু দূরে কারিবাড়ি বা কারাইবাড়িতে)য় সেনা ছাউনি স্থাপন করে, মুঘলদের স্থানীয় বাজারে আসার নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং অত্যাচারের ঝাঁটাপেটা করে বহু মুঘলকে গ্রেফতার করে, তারা সেখানেই বসবাস করতে বাধ্য হয়।
মীর জুমলার বাঙলা প্রবেশের ঠিক আগে মুঘলদের মাথা ব্যথা ঘটানোর এই সব কাণ্ডগুলির কিছু আগে জাহাঙ্গীর আর শাহজাহানের সময় যথাক্রমে সৈয়দ আবু বকর এবং আব্দুস সালামকে অহোমেরা গ্রেফতার করে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে মুঘলেরা কিছু করতে পারে নি। আওরঙ্গজেবের কালে মীর জুমলা বাঙলার ক্ষমতা দখল করলে তাকে এইগুলির প্রতিশোধ নিতে বলা হয়। এটা যে শুধু সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা ছিল তাই নয়, তার কাছের ওয়াকিয়ানবিশ বলছেন, বিধর্মী অহমিয়াদের ওপর ধর্মযুদ্ধ চালাতে চাইছিলেন, যাতে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেওয়া যায়, মূর্তিপুজকদের শিক্ষা দেওয়া যায়, ইসলামি ধর্মাচারণের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলিয়ে নিতে বাধ্য করা যায় এবং অবিশ্বাসীদের আচার আচরণ নিষিদ্ধ করা যায়।
(চলবে)