(গত কয়েকদিন ধরে বাংলায়
মারোয়াড়িদের ভোট দেওয়া ইত্যদি নিয়ে বেশ বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে
জুটেছিল কুমারবাবুর সিরাজ সংক্রান্ত প্রকাশনা এবং আমাদের পলাশি বিষয়ক
উত্তর। ফলে সেই সময় বুঝতে কিছু লেখা তৈরি করার ভাবনা মাথায় আসে। তার প্রথম
বিষয় এই লেখাটি। এটি তৃতীয় খণ্ড। এই লেখাটির সঙ্গে বাংলা মায়ের সে সময়ের
সমৃদ্ধির বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। লেখাগুলো বড় হবে।
ভাল লাগলে পড়বেন, মন্তব্য করবেন, আতঙ্ক হলে ক্ষমাঘেন্না করে এড়িয়ে যাবেন। - উইভার্স, আর্টিজান, ট্রাডিশনাল পার্ফর্মিং আর্টিস্টস গিল্ডের পক্ষে বিশ্বেন্দু)
পুর্বপ্রকাশিতের পর...
পলাশির কিছু বছর পরে কলকাতায় ব্রিটিশেরা টাঁকশাল চালু করলেও জগতশেঠেদের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু ছিল। সিক্কা রুপি নির্ভর ব্যবসা তাঁদের অসীম সম্পদের উৎস। সিক্কা রুপি এক বছর তার নিজস্ব মুদ্রা মানে চলত। পরের বছর তার দাম অবমূল্যায়ন হত ৩ শতাংশ হিরসানস সূত্রে। পরের বছরে আরও ২ শতাংশ কমত – তখন তার নাম হত সোনাউত। বাংলা সুবার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের - ফরাসি আর্কট, ডাচ আর্কট, মাদ্রাদ আর্কট, ওয়াজিরি, নারায়নী ইত্যাদি মুদ্রা চালু ছিল। সিক্কা রুপির দাম অনুসারে স্রফেরা সেগুলির মূল্যমান নির্ধারণ করত। এই জটিল ব্যবসাটা জগতশেঠের কোঠি থেকে পাঁচ দশক ধরে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তাঁরা বাজারের সব থেকে বড় স্রফেদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। পলাশির পর শেঠেদের দ’য়ে পড়তে দেখে স্রফেরা স্বাধীন হয়ে উঠল। সেই শতের ষাটের দশকে বাংলার মুদ্রা ব্যবস্থা জুড়ে অরাজকতা। জগতশেঠ কুশলচাঁদ এবং মহারাজা উদতচাঁদ এই অবস্থা সামাল দিতে পারলেন না। নয়ের দশক পর্যন্ত বাংলা জুড়ে এই অবস্থা চলেছিল। তার পর জগতশেঠেদের কোঠির মৃত্যু ঘটে।
১৭৬৫র দেওয়ানি পাওয়ার পর ব্রিটিশ ইন্সট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটা সমতি তৈরি করে – সেখানে সদস্য ছিলেন নায়েব দেওয়ান মহম্মদ রেজা খাঁ, মহারাজা দুর্লভ রাম, জগতশেঠ কুশল চাঁদ এবং মহারাজা উদতচাঁদ। খাজাঞ্চিখানায় তিনটে আলাদা আলাদা তালা ও চাবি তৈরি হয়। এর একটি জগত শেঠেদের কাছে ছিল। তাঁরা এই ব্যবস্থাটি মেনে নিতে পারেন নি অবশ্যই। পলাশির পর প্রথমেই যে অধিকারটি তাঁদের থেকে কেড়ে নেওয়া হল সেটি হল, বিভিন্ন মুদ্রা পরীক্ষা, যাচাই, ওজন করা এনং সিক্কা রুপির প্রেক্ষিতে সেগুলির ওপর বাটা নির্ধারণ করার একচ্ছত্র ক্ষমতা। কাচা আমদানির ওপর এটি ছিল তাঁদের স্রফিয় রোজগার(স্রফেজ)। বোল্টস কন্সিডারেশন...এ বলছেন, শেঠেদের মানের অবস্থার অবনতি হলে পাটনার এক শেঠ জগতশেঠেদের অনুকরণে জমিদারদের থেকে রাজস্ব আদায় করতেন। তার ওপর ১০ শতাংশ কমিশন(পাটোয়ান) রেখে একটা পাট (হাতচিটা) জমিদারদের দিতে শুরু করেন। এইভাবে সুবার প্রত্যেকটি অঞ্চলের আর্থিক ব্যবস্থাপনা থেকে জগতশেঠেরা দ্রুত হারিয়ে যেতে শুরু করেন।
তাঁদের সম্মানের এত দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে যে, পলাশির মাত্র আট বছর পর ১৭৬৫ সালে জগতশেঠ কুশলচাঁদ আর মহারাজা উদতচাঁদ- তখনও ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শেঠ কোঠির মালিক – কলকাতা কাউন্সিলে জন্সটোন, সিনিয়র, লিসেস্টার এবং মিডল্টন তাদেরকে যেভাবে উপহাস করল তা অন্তত এক দশক আগেও অশ্রুতপূর্ব ছিল। কাউন্সিল তাঁদের অবাধে বাজারে কাজ করতে দেওয়ার ‘সুযোগ’এর বদলে ১,২৫,০০০ টাকা ঘুষ দাবি করল। ১৭৬৬ সালে জগত শেঠেরা মির্জাফরকে দেয় ৫১ লক্ষ টাকা দাবি করে। ক্লাইভ নবাবের হয়ে মাত্র ২১ লক্ষ টাকা শোধ করার প্রতিশ্রুতি দিল তাও দশ বছরের কিস্তিতে - যার অর্ধেক ব্রিটিশ দেবে আর অর্ধেক নবাব। ক্লাইভ তাঁদের অর্থগৃধ্নু বলে বসল। ক্লাইভ বলল জমিদারেরা সরকারের বাকেয়া পাঁচ বছরের টাকা মেটাচ্ছে না – এবং এই কাজে জমিদারদের সাহায্য করছেন জগতশেঠেরা। আর যে শেঠ পরিবারের সদস্যদের মির কাশেম বন্দী করে রেখেছে, তাঁদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করুক ধার করেই হোক বা তাঁদের পরিবারের গয়না বন্ধক দিয়েই হোক। যাইহোক ক্লাইভ কুশলচাঁদকে বছরে তিনলাখ টাকা পেনসন দিয়ে অবসর নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন।
সেই সময়ে কুশলচাঁদের মাসের খরচ ছিল এক লক্ষ টাকা। মহতাব রাই আর স্বরূপচাঁদ ১৭৪৭ সালে বছরে দেড় লক্ষ টাকার ঢাকাই মসলিন কিনতেন। আব্দুল করিম, ঢাকা দ্য মুঘল ক্যাপিট্যাল বইতে বলছেন সে সময় নবাব পরিবার মসলিন কিনত ৩ লক্ষ টাকা্র। শেঠ পরিবার পলাশির পর যে দ’য়ে পড়েছিল, সে সময় তার পক্ষে বাপ ঠাকুদ্দার অমিব্যয়িতা ধরে রাখা আত্মহত্যার সামিল ছিল। হান্টার বলছেন ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় তিনি মাত্র ৫০০০ টাকা দান করেন, উল্টোদিকে বুকাননের দিনাজপুর রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, দিনাজপুরের এক অনামা ব্যবসায়ী ৫০০০০ টাকা দান করে অন্নসত্রের জন্য। যতদিন ক্লাইভ ছিলেন ততদিন কিছু না কিছু ভাবে শেঠেদের সঙ্গে লুঠেরা ব্রিটিশ কোম্পানির একটা না একটা যোগাযোগ ছিল। তারপর যখন রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরিত হল, সে পলকা সুতোটুকুও ছিঁড়ে গেল - জগতশেঠেদের পতন সম্পূর্ণ হল।
বড় পুঁজি সাধারণত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া দাঁড়াতে পারে না। ১৭১৭ থেকে ১৭৫৬ পর্যন্ত তাঁরা বাংলা-বিহারে তাঁদের সমস্ত প্রতিযোগীকে বাজার থেকে হঠিয়ে দেয়। প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এই কোঠির। কিন্তু যারা তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে হেরে মাথা নিচু করে তাঁদের অপ্রতিহত দৌড় দেখছিলেন, তাঁরা এবার নতুন সময়ে উঠে দাঁড়ালেন। বোল্টস বলছেন ষাটের দশকের প্রথম দিকে পরিবারের পুঁজি ছিল ৭ কোটি টাকা। এটা দেশের মানুষের অঙ্ক – তিনি কন্সিডারেশন্স...এ লিখছেন। তাঁদের ক্ষমতা যখন অপ্রতিহত তখন হয়ত সে সংখ্যাটা দ্বিগুণ ছিল – ধরে নেওয়া গেল ১৪ কোটি। সাধারণত কোঠির বাতসরিক সুদ ছিল ৯ শতাংশ। ইওরোপে ওরিয়েন্টাল রেট অব ইন্টারেস্ট নিয়ে যে ধরণের প্রচার হয়েছে সে ধরণের কিছু জগতশেঠেরা দাবি করতেন না। সে সময় ব্যাঙ্ক অন ইংলন্ড ৮ শতাংশ সুদ নিত। তার সময় বাংলার ব্যঙ্কিং ব্যবস্থা উন্নতির চরম শিখরে ওঠে বলছেন নরেন্দ্র কৃষ্ণ। যে সামাজিক- রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে তাঁদের বিকাশ ঘটেছে, পলাশির পর সেই অবস্থা আর তার ফিরে পেলেন না। মুতক্ষরিণে গুলাম হুসেইন লিখছেন, ...আজ বোঝা যাবে না আলিবর্দির সময়ে তাঁরা কি ধরণের সম্মান, ক্ষমতা অর্জন করেছেন বাংলায়... তাঁদের ক্ষমতা এত দূর পর্যন্ত ছিল যে ভারতে বা দাক্ষিণাত্যে কোন ব্যাঙ্কারের পক্ষে সেই ক্ষমতা ভোগ করা সম্ভব ছিল না... তাঁদের সম্পদ রূপকথার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল... যে কোন সংখ্যাই কম বলে মনে হত... তাঁদের পুত্ররা ব্রিটিশদের ক্ষমতার কাছে হার মেনে গেল। বেটা ফ্রান্সিস এবং এলিজ কেয়ারি সম্পাদিত দ্য ফ্রান্সিস লেটার্সএ ফিলিপ ফ্রান্সিসের ব্রাদার ইন ল আলেক্সান্দার ম্যাকরাবিক আমেরিকায় তার বন্ধুকে লিখছেন ... এমন কি এই প্রজন্মে, ভারতের যে ব্যবসা আর (জগতশেঠেদের মত)ধনীরা ছিল, তার গুণমান তুলনা করতে হবে সলোমনের জাহাজ, ওফিরের সোনা বা তারসিসের জাহাজের সঙ্গে। ম্যাকরাবিক জগতশেঠেদের শেষ সময়ে এই এপিটাফটি লিখেছিলেন।
কুশলচাঁদ আর উদিতচাঁদ পরিবারের ব্যবসার পতন আটকাতে পারছেন না – সাধারণ ছোট ব্যাঙ্কারেরা যাদের এতদিন ধর্তব্যের মধ্যেই আনতেন না জগতশেঠের পরিবার – কোঠির মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। একে একে নিভিছে দেউটি – একে একে খসে পড়ছে কোঠির সযত্নে গাঁথা এক একটা ইট চোখের সামনে অথচ দুই পুরষ সেই বার্ধক্যকে চোখে দেখে যেতে হচ্ছে। মির কাশিম বোলাকি দাসকে দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে নতুন একটা কোঠি তৈরির চেষ্টা ফল ফলল না – কিন্তু প্রচেষ্টা প্রতিহত রইল। বেনারসে গোপাল দাস, ভবানী দাস বল্লম দাস নতুন কোঠি শুরু করার তোড়জোড় করলেন – এবং তা কাজ আরম্ভ করেও দিল। দেশিয় ভাষায় আট আনার(অর্ধেক) অংশিদার গোপাল দাস ১৭৮৭তে দেহত্যাগ করেন। বেনারসে যে সংস্থার নাম হবে ভয়রাম(ভাইরাম?) গোপাল দাস আর কলকাতা আর মুর্শিদাবাদে মনোহর দাস দ্বারকা দাস – তার শুরুর পুঁজি গিয়ে দাঁড়াল এক কোটি টাকায়। কোঠির শাখা খুলল নাগপুর, কটক, বম্বে, সুরাট, পুণা, কলকাতা আর মুর্শিদাবাদে। উত্তরভারতে জগতশেঠেদের কাজের তুলনায় দেশিয় ব্যবসায় এদের গুরুত্ব অনেক বেশি হতে শুরু করল। গোপালদাসের চার সন্তানের মধ্যে মনোহর দাস ১৮১৮ সালে মারা গেলেন। পুত্র মুকুন্দ ২০ লাখ টাকা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করলেন। এর পর থেকে জগতশেঠেদের ব্যবসার মত পূর্বভারতে কোন একটি কুঠি অসীম বিনিয়োগ জোগাড় দেওয়ার অবস্থায় রইল না। হাজারো বিনিয়োগকারী উঠে এল।
জগত শেঠেদের অস্তমিত হওয়ার পর নরেন্দ্র কৃষ্ণ বলছেন পূর্ব ভারতের ব্যঙ্কিং ব্যবস্থা হুন্ডি আর সুদে খাটানো ক্ষুদ্র শিল্পে পরিণত হল। (চলবে)...
ভাল লাগলে পড়বেন, মন্তব্য করবেন, আতঙ্ক হলে ক্ষমাঘেন্না করে এড়িয়ে যাবেন। - উইভার্স, আর্টিজান, ট্রাডিশনাল পার্ফর্মিং আর্টিস্টস গিল্ডের পক্ষে বিশ্বেন্দু)
পুর্বপ্রকাশিতের পর...
পলাশির কিছু বছর পরে কলকাতায় ব্রিটিশেরা টাঁকশাল চালু করলেও জগতশেঠেদের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু ছিল। সিক্কা রুপি নির্ভর ব্যবসা তাঁদের অসীম সম্পদের উৎস। সিক্কা রুপি এক বছর তার নিজস্ব মুদ্রা মানে চলত। পরের বছর তার দাম অবমূল্যায়ন হত ৩ শতাংশ হিরসানস সূত্রে। পরের বছরে আরও ২ শতাংশ কমত – তখন তার নাম হত সোনাউত। বাংলা সুবার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের - ফরাসি আর্কট, ডাচ আর্কট, মাদ্রাদ আর্কট, ওয়াজিরি, নারায়নী ইত্যাদি মুদ্রা চালু ছিল। সিক্কা রুপির দাম অনুসারে স্রফেরা সেগুলির মূল্যমান নির্ধারণ করত। এই জটিল ব্যবসাটা জগতশেঠের কোঠি থেকে পাঁচ দশক ধরে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তাঁরা বাজারের সব থেকে বড় স্রফেদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। পলাশির পর শেঠেদের দ’য়ে পড়তে দেখে স্রফেরা স্বাধীন হয়ে উঠল। সেই শতের ষাটের দশকে বাংলার মুদ্রা ব্যবস্থা জুড়ে অরাজকতা। জগতশেঠ কুশলচাঁদ এবং মহারাজা উদতচাঁদ এই অবস্থা সামাল দিতে পারলেন না। নয়ের দশক পর্যন্ত বাংলা জুড়ে এই অবস্থা চলেছিল। তার পর জগতশেঠেদের কোঠির মৃত্যু ঘটে।
১৭৬৫র দেওয়ানি পাওয়ার পর ব্রিটিশ ইন্সট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটা সমতি তৈরি করে – সেখানে সদস্য ছিলেন নায়েব দেওয়ান মহম্মদ রেজা খাঁ, মহারাজা দুর্লভ রাম, জগতশেঠ কুশল চাঁদ এবং মহারাজা উদতচাঁদ। খাজাঞ্চিখানায় তিনটে আলাদা আলাদা তালা ও চাবি তৈরি হয়। এর একটি জগত শেঠেদের কাছে ছিল। তাঁরা এই ব্যবস্থাটি মেনে নিতে পারেন নি অবশ্যই। পলাশির পর প্রথমেই যে অধিকারটি তাঁদের থেকে কেড়ে নেওয়া হল সেটি হল, বিভিন্ন মুদ্রা পরীক্ষা, যাচাই, ওজন করা এনং সিক্কা রুপির প্রেক্ষিতে সেগুলির ওপর বাটা নির্ধারণ করার একচ্ছত্র ক্ষমতা। কাচা আমদানির ওপর এটি ছিল তাঁদের স্রফিয় রোজগার(স্রফেজ)। বোল্টস কন্সিডারেশন...এ বলছেন, শেঠেদের মানের অবস্থার অবনতি হলে পাটনার এক শেঠ জগতশেঠেদের অনুকরণে জমিদারদের থেকে রাজস্ব আদায় করতেন। তার ওপর ১০ শতাংশ কমিশন(পাটোয়ান) রেখে একটা পাট (হাতচিটা) জমিদারদের দিতে শুরু করেন। এইভাবে সুবার প্রত্যেকটি অঞ্চলের আর্থিক ব্যবস্থাপনা থেকে জগতশেঠেরা দ্রুত হারিয়ে যেতে শুরু করেন।
তাঁদের সম্মানের এত দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে যে, পলাশির মাত্র আট বছর পর ১৭৬৫ সালে জগতশেঠ কুশলচাঁদ আর মহারাজা উদতচাঁদ- তখনও ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শেঠ কোঠির মালিক – কলকাতা কাউন্সিলে জন্সটোন, সিনিয়র, লিসেস্টার এবং মিডল্টন তাদেরকে যেভাবে উপহাস করল তা অন্তত এক দশক আগেও অশ্রুতপূর্ব ছিল। কাউন্সিল তাঁদের অবাধে বাজারে কাজ করতে দেওয়ার ‘সুযোগ’এর বদলে ১,২৫,০০০ টাকা ঘুষ দাবি করল। ১৭৬৬ সালে জগত শেঠেরা মির্জাফরকে দেয় ৫১ লক্ষ টাকা দাবি করে। ক্লাইভ নবাবের হয়ে মাত্র ২১ লক্ষ টাকা শোধ করার প্রতিশ্রুতি দিল তাও দশ বছরের কিস্তিতে - যার অর্ধেক ব্রিটিশ দেবে আর অর্ধেক নবাব। ক্লাইভ তাঁদের অর্থগৃধ্নু বলে বসল। ক্লাইভ বলল জমিদারেরা সরকারের বাকেয়া পাঁচ বছরের টাকা মেটাচ্ছে না – এবং এই কাজে জমিদারদের সাহায্য করছেন জগতশেঠেরা। আর যে শেঠ পরিবারের সদস্যদের মির কাশেম বন্দী করে রেখেছে, তাঁদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করুক ধার করেই হোক বা তাঁদের পরিবারের গয়না বন্ধক দিয়েই হোক। যাইহোক ক্লাইভ কুশলচাঁদকে বছরে তিনলাখ টাকা পেনসন দিয়ে অবসর নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন।
সেই সময়ে কুশলচাঁদের মাসের খরচ ছিল এক লক্ষ টাকা। মহতাব রাই আর স্বরূপচাঁদ ১৭৪৭ সালে বছরে দেড় লক্ষ টাকার ঢাকাই মসলিন কিনতেন। আব্দুল করিম, ঢাকা দ্য মুঘল ক্যাপিট্যাল বইতে বলছেন সে সময় নবাব পরিবার মসলিন কিনত ৩ লক্ষ টাকা্র। শেঠ পরিবার পলাশির পর যে দ’য়ে পড়েছিল, সে সময় তার পক্ষে বাপ ঠাকুদ্দার অমিব্যয়িতা ধরে রাখা আত্মহত্যার সামিল ছিল। হান্টার বলছেন ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় তিনি মাত্র ৫০০০ টাকা দান করেন, উল্টোদিকে বুকাননের দিনাজপুর রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, দিনাজপুরের এক অনামা ব্যবসায়ী ৫০০০০ টাকা দান করে অন্নসত্রের জন্য। যতদিন ক্লাইভ ছিলেন ততদিন কিছু না কিছু ভাবে শেঠেদের সঙ্গে লুঠেরা ব্রিটিশ কোম্পানির একটা না একটা যোগাযোগ ছিল। তারপর যখন রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরিত হল, সে পলকা সুতোটুকুও ছিঁড়ে গেল - জগতশেঠেদের পতন সম্পূর্ণ হল।
বড় পুঁজি সাধারণত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া দাঁড়াতে পারে না। ১৭১৭ থেকে ১৭৫৬ পর্যন্ত তাঁরা বাংলা-বিহারে তাঁদের সমস্ত প্রতিযোগীকে বাজার থেকে হঠিয়ে দেয়। প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এই কোঠির। কিন্তু যারা তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে হেরে মাথা নিচু করে তাঁদের অপ্রতিহত দৌড় দেখছিলেন, তাঁরা এবার নতুন সময়ে উঠে দাঁড়ালেন। বোল্টস বলছেন ষাটের দশকের প্রথম দিকে পরিবারের পুঁজি ছিল ৭ কোটি টাকা। এটা দেশের মানুষের অঙ্ক – তিনি কন্সিডারেশন্স...এ লিখছেন। তাঁদের ক্ষমতা যখন অপ্রতিহত তখন হয়ত সে সংখ্যাটা দ্বিগুণ ছিল – ধরে নেওয়া গেল ১৪ কোটি। সাধারণত কোঠির বাতসরিক সুদ ছিল ৯ শতাংশ। ইওরোপে ওরিয়েন্টাল রেট অব ইন্টারেস্ট নিয়ে যে ধরণের প্রচার হয়েছে সে ধরণের কিছু জগতশেঠেরা দাবি করতেন না। সে সময় ব্যাঙ্ক অন ইংলন্ড ৮ শতাংশ সুদ নিত। তার সময় বাংলার ব্যঙ্কিং ব্যবস্থা উন্নতির চরম শিখরে ওঠে বলছেন নরেন্দ্র কৃষ্ণ। যে সামাজিক- রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে তাঁদের বিকাশ ঘটেছে, পলাশির পর সেই অবস্থা আর তার ফিরে পেলেন না। মুতক্ষরিণে গুলাম হুসেইন লিখছেন, ...আজ বোঝা যাবে না আলিবর্দির সময়ে তাঁরা কি ধরণের সম্মান, ক্ষমতা অর্জন করেছেন বাংলায়... তাঁদের ক্ষমতা এত দূর পর্যন্ত ছিল যে ভারতে বা দাক্ষিণাত্যে কোন ব্যাঙ্কারের পক্ষে সেই ক্ষমতা ভোগ করা সম্ভব ছিল না... তাঁদের সম্পদ রূপকথার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল... যে কোন সংখ্যাই কম বলে মনে হত... তাঁদের পুত্ররা ব্রিটিশদের ক্ষমতার কাছে হার মেনে গেল। বেটা ফ্রান্সিস এবং এলিজ কেয়ারি সম্পাদিত দ্য ফ্রান্সিস লেটার্সএ ফিলিপ ফ্রান্সিসের ব্রাদার ইন ল আলেক্সান্দার ম্যাকরাবিক আমেরিকায় তার বন্ধুকে লিখছেন ... এমন কি এই প্রজন্মে, ভারতের যে ব্যবসা আর (জগতশেঠেদের মত)ধনীরা ছিল, তার গুণমান তুলনা করতে হবে সলোমনের জাহাজ, ওফিরের সোনা বা তারসিসের জাহাজের সঙ্গে। ম্যাকরাবিক জগতশেঠেদের শেষ সময়ে এই এপিটাফটি লিখেছিলেন।
কুশলচাঁদ আর উদিতচাঁদ পরিবারের ব্যবসার পতন আটকাতে পারছেন না – সাধারণ ছোট ব্যাঙ্কারেরা যাদের এতদিন ধর্তব্যের মধ্যেই আনতেন না জগতশেঠের পরিবার – কোঠির মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। একে একে নিভিছে দেউটি – একে একে খসে পড়ছে কোঠির সযত্নে গাঁথা এক একটা ইট চোখের সামনে অথচ দুই পুরষ সেই বার্ধক্যকে চোখে দেখে যেতে হচ্ছে। মির কাশিম বোলাকি দাসকে দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে নতুন একটা কোঠি তৈরির চেষ্টা ফল ফলল না – কিন্তু প্রচেষ্টা প্রতিহত রইল। বেনারসে গোপাল দাস, ভবানী দাস বল্লম দাস নতুন কোঠি শুরু করার তোড়জোড় করলেন – এবং তা কাজ আরম্ভ করেও দিল। দেশিয় ভাষায় আট আনার(অর্ধেক) অংশিদার গোপাল দাস ১৭৮৭তে দেহত্যাগ করেন। বেনারসে যে সংস্থার নাম হবে ভয়রাম(ভাইরাম?) গোপাল দাস আর কলকাতা আর মুর্শিদাবাদে মনোহর দাস দ্বারকা দাস – তার শুরুর পুঁজি গিয়ে দাঁড়াল এক কোটি টাকায়। কোঠির শাখা খুলল নাগপুর, কটক, বম্বে, সুরাট, পুণা, কলকাতা আর মুর্শিদাবাদে। উত্তরভারতে জগতশেঠেদের কাজের তুলনায় দেশিয় ব্যবসায় এদের গুরুত্ব অনেক বেশি হতে শুরু করল। গোপালদাসের চার সন্তানের মধ্যে মনোহর দাস ১৮১৮ সালে মারা গেলেন। পুত্র মুকুন্দ ২০ লাখ টাকা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করলেন। এর পর থেকে জগতশেঠেদের ব্যবসার মত পূর্বভারতে কোন একটি কুঠি অসীম বিনিয়োগ জোগাড় দেওয়ার অবস্থায় রইল না। হাজারো বিনিয়োগকারী উঠে এল।
জগত শেঠেদের অস্তমিত হওয়ার পর নরেন্দ্র কৃষ্ণ বলছেন পূর্ব ভারতের ব্যঙ্কিং ব্যবস্থা হুন্ডি আর সুদে খাটানো ক্ষুদ্র শিল্পে পরিণত হল। (চলবে)...
No comments:
Post a Comment