সমালোচ্য দারুমূৰ্ত্তিটি রামপালের
সন্নিহিত পঞ্চসারবিনোদপুর নিবাসী প্রভুপাদ
শ্ৰীযুক্ত মুকুন্দলাল গোস্বামী মহাশয় সংগ্ৰহ করিয়া ঢাকা মিউজিয়মে উপহার
দিয়াছিলেন। একটি আমলকশীর্ষ রেখমন্দিরতলে
দেবতা ত্রিভঙ্গ ভঙ্গীতে দাঁড়াইয়া
আছেন। মণ্ডকে মুকুট, কানে কুণ্ডল, কেশভার
স্ত্রীলোকের মত খোঁপা করিয়া বাঁধা, -খোঁপার প্রা(ন্ত)টি পক্ষী-চঞ্চুর মত, দুই
লহর মুক্তার মালা দিয়া চঞ্চুটি বেষ্টিত। দেবতা দক্ষিণ হস্তের
দুইটি অঙ্গুলি দিয়া অপূর্ব লীলায় একটি তরবারির বাঁট ধরিয়া আছেন, তরবারি নীচের দি(কে) ঝুলিতেছে। ধরিবার কোমল ভঙ্গীটি এবং
তরবারির নিম্নমুখত্ব হইতে হিংসাধৰ্ম্মী
অস্ত্রের অহিংসত্ব সূচিত হইতেছে। দেবতার বামস্কন্ধ হইতে একখানি কোঁচানো চাদর পুষ্পিতাগ্র
হইয়া হাঁটুর নীচে ঝুলিয়া পড়িয়াছে। আর একখানি কোঁচানো
চাদর দেবতার বামহস্তে ধৃত। দেবতার গলায়, বাহুতে, কটিতে, মণিবন্ধে
স্ত্রীলোকের মত অলঙ্কার-প্রাচুর্য্য। কটিদেশ হইতে প্রায়
হাঁটু পৰ্যন্ত ঝালরের মত কয়েক গুচ্ছ
রত্নমালা দুলিতেছে। দক্ষিণ পদের
উপর ভর করিয়া দাঁড়াইয়া দেবতা বঁ-পা খানি তাহার পিছনে
নৃত্যভঙ্গীতে স্থাপিত করিয়াছেন, নূপুরশোভিত
পা-খানি অঙ্গুলির উপর ভর করিয়া আছে। দেবতার পায়ের তলে পুষ্পরাশি ছড়াইয়া আছে। দেবতার মুখে এবং
সৰ্ব্বাবয়বে নবযৌবনের অপূৰ্ব্ব লাবণ্য এই হাজার বছরের
পুরাতন কাষ্ঠখণ্ড খানিতেও যে-প্রকার অবিকৃতভাবে
রক্ষিত আছে, তাহাতে শিল্পীর প্রশংসায় দর্শকের মন মুখর না
হইয়া পারে না |
মূৰ্ত্তির মস্তকের উপর মন্দিরের প্রতিকৃতি দেখি৷ ইহাই সিদ্ধান্ত করিতে হয় যে এই মূৰ্ত্তি দেবমূৰ্ত্তি। এই নবযৌবনরসে উচ্ছল খড়্গধারী কিশোর মূৰ্ত্তি
কোন দেবতার ? বাহনের অভাব বৌদ্ধত্বসূচক এবং হস্তে খড়্গ ও সৰ্ব্বশরীরে
অলঙ্কারবাহুল্য মঞ্জুশ্রীসূচক। মঞ্জুশ্রী বৌদ্ধগণের বিদ্যার দেবতা । ইঁহার নানা প্রকারভেদ আছে। ডক্টর শ্রীযুক্ত বিনয়তোষ ভট্টাচাৰ্য্য তাহার Buddhist Iconography নামক পুস্তকে বাক, ধর্ম্মধাতু, বাগীশ্বর, মঞ্জুঘোষ, সিদ্ধৈকবীর, বজ্রানঙ্গ, নামসংগীতি, বাগীশ্বর, মঞ্জুবর,
মঞ্জুকুমার, অরপচন, স্থিরচক্র, বাদিরা(?), মঞ্জুনাথ,—এই ত্রয়োদশ প্রকার মঞ্জুশ্রীর পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। কিন্তু
ইহাদের কাহারও সহিত আলোচ্য মূৰ্ত্তিটির মিল খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। একমাত্র
স্থিরচক্ৰ মঞ্জুশ্রীর বর্ণনার সহিত আলোচ্য মূৰ্ত্তিটির কিছু
মিল লক্ষ্য করা
যায়।
৬৫৩ পাতায় মানচিত্র প্রাচীন বাংলার রাজধানী শ্রীবিক্রমপুর
(৬৫৪পাতা)
ডক্টর ভট্টাচার্য্য-প্রদত্ত স্থিরচক্রের বর্ণনা নিম্নরূপ :– "স্থিরচক্রের এক হস্তে তরবারি, অপর
হস্তদ্বারা তিনি বর প্রদান করিতেছেন। তাঁহার বর্ণ শ্বেত, ভ্রমরবর্ণের
অলঙ্কারে তাঁহার দেহ মণ্ডিত। পদ্মের
উপর চন্দ্রাসনে তিনি উপবিষ্ট। তিনি চীরক(বস্ত্রসমূহ)ধারী। ঐ সমস্ত বস্ত্রের প্রভায় তাঁহার দেহ উজ্জ্বল। তাঁহার সৰ্ব্বাঙ্গে রাজকুমারের মত অলঙ্কার।তাঁহার আনন
শৃঙ্গার-রসে সমুদ্ভাসিত। প্রজ্ঞাদেবী তাঁহার সঙ্গিনী, তাঁহারও
আনন শৃঙ্গার-রসে সমুজ্জ্বল ও হাস্যদীপ্ত।”
ডক্টর ভট্টাচাৰ্য
স্থিরচক্রের কোন মূৰ্ত্তি দেখেন নাই, এবং ছবিও দিতে পারেন নাই। বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের চিত্রশালায় রক্ষিত একটি মূৰ্ত্তিকে তিনি স্থিরচক্র বলিইয়া সসন্দেহে নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন এবং ছবিও দিয়াছেন। এই
মূৰ্ত্তিটির সহিতও উপরের বর্ণনার সৰ্ব্বাংশে মিল
নাই।
তবে আমাদের আলোচ্য মূৰ্ত্তিটি কি স্থিরচক্ৰ মঞ্জুশ্রী নহে ?
মিলও যে কিছু কিছু পাওয়া যাইতেছে ! আমাদের দেবতাটির হাতে এবং গলায় কোঁচানো চাদরখানি যে-ভাবে স্থাপিত তাহাতে স্পষ্টই বুঝা যায়, ইহা শুধু শোভার্থে প্রদত্ত হয় নাই, ইহা এই দেবতার একটি বিশেষ চিহ্ন। কাজেই স্থিরচক্রের ‘চীরক’ পাওয়া যাইতেছে। হস্তে তরবারিও
মিলিতেছে। সৰ্ব্বাঙ্গে রাজকুমারের মত অলঙ্কারও
দেখা যাইতেছে। কিন্তু সঙ্গে প্রজ্ঞাদেবী ত দেখা যায় না !
বৌদ্ধ “সাধনমালা” নামক
বৌদ্ধ দেবদেবীর পূজাপদ্ধতি গ্রন্থখানি ডক্টর ভট্টাচার্যের Buddhist Iconography গ্রন্থের প্রধান অবলম্বন ছিল। সাধনমালায়
কয়েকথানি প্রাচীন পুঁথি মিলাইয়া ১৯২৫ সনে ডক্টর ভট্টাচার্ষ্য এই সাধনমালার একটি উংকৃষ্ট সংস্করণ
"গাইকোবাড় প্রাচ্য গ্রন্থমালা"র অন্তর্গত করিয়া বড়োদা হইতে প্রকাশিত করিয়াছেন। সাধনমালায় স্থিরচক্রের দুইটি সাধনপদ্ধতি প্রদত্ত হইয়াছে। প্রথম
সাধনটি (নং ৪৪) পদ্যময়, উহার অল্পাংশ গদ্যে লিখিত। দ্বিতীয়
সাধনটি গদ্যে লিখিত, উহার রচয়িতার নাম মুক্তক। উভয় সাধন হইতেই
প্রয়োজনীয় অংশগুলি উদ্ধৃত করা হইতেছে — প্রথম
সাধনের আরম্ভ :
শ্ৰীমদগীর্গরিমানিরস্ত সকল ভ্রান্তি প্রতানোজ্জলং
প্রোদ্যদেগৈর গভস্তিবিম্ববিমলং বুদ্ধং চ বালাকৃতিং।
বিভ্রানং করবা(?)লমুদগীতরুচিং প্রজ্ঞাং চ মত্বাদরাৎ
আত্মামুস্মরণায় লিখ্যত ইদং তচ্চক্ররত্বং ময়া।।
এই শ্লোকটি সাধন-রচয়িতার মুখবন্ধ।
বাংলায় ইহার নিম্নরূপ অনুবাদ করা যায় :
"নবপল্লবের মত উজ্জ্বল, শ্ৰীমান, বাক্যগরিমা দ্বারা যিনি সকল ভ্রান্তি
নিরস্ত করিয়াছেন, উদগত শ্বেত আলোকবিম্বের মত বিমল, যিনি
জ্যোতিষ্মান তরবারি ধারণ করিয়া আছেন, সেই বালকের মত আকৃতি বুদ্ধকে এবং প্রজ্ঞাদেবীকে সাদরে নমস্কার করিয়া নিজের পুনঃ পুনঃ
স্মরণের জন্য আমাকর্তৃক এই চক্ররত্ন লিখিত হইল।”
এইখানে দেখা যাইতেছে, রচয়িতা
বালাকৃতি স্থিরচক্রকে এবং প্রজ্ঞাদেবীকে নমস্কার করিয়া সাধন রচনা আরম্ভ করিতেছেন।
স্থিরচক্রের সহিত প্রজ্ঞা থাকিবেন, এমন
কোন কথা ইহাতে নাই। পরের একটি শ্লোকে আছে, সাধক
মুঃ এই বীজ হইতে জাত সুন্দর পত্রসমন্বিত ইন্দীবরের চিন্তা করিবেন। তাহার উপরে চন্দ্রাসনে
উপবিষ্ট বাগীশ্বরের ধ্যান করিবেন।
ভ্রমরের মত কৃষ্ণ এবং উজ্জল বস্তুসমূহ
হইতে নি:সৃত রক্তরশ্মিসমূহ দ্বারা ইনি নিবিড় অন্ধকার দূর করিতেছেন এবং ইনি সৰ্ব্ব প্রকার বরপ্রদাননিপুণ।
লালিত্য শৃঙ্গাররসাভিরামং
(?) লক্ষ্মীম্।
বীরং কুমারাভরণং
দধানং
ধ্যায়াং পদং তস্য সমীহমানঃ॥
No comments:
Post a Comment