প্রাচীন শিল্পশাস্ত্রকারগণ যে-সমস্ত উপাদানে দেবমূর্ত্তি গঠিত করিতে উপদেশ দিয়াছেন, কাষ্ঠও
তাহদের মধ্যে একটি । আজিও তাই দেশের নানা দেবমন্দিরে
কাঠময় দেবমূৰ্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়। শ্ৰীক্ষেত্রের বিখ্যাত জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা কাষ্ঠনিৰ্ম্মিত। পশ্চিম-বঙ্গের নানা স্থানে চৈতন্য ও নিত্যানন্দের
এবং তাঁহাদের অনুবর্ত্তিগণের দারুময় মূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠিত আছে।
ঢাকা জেলার ধামরাই গ্রামে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত
যশোমাধব-মূৰ্ত্তিও কাষ্ঠনিৰ্ম্মিত। উপাদানহিসাবে কাষ্ঠ কিন্তু অচিরস্থায়ী। সেই জন্য এই ক্ষেত্রে যুগে যুগে প্রস্তরই অধিকতর আদর লাভ করিয়া আসিয়াছে। প্রস্তরে, বিশেষতঃ কৃষ্ণপ্রস্তরে, নিৰ্ম্মিত
হইলে প্রতিমার আর জরা-মরণ নাই! বাংলা দেশে সহস্ৰ বৎসর পূর্বে কৃষ্ণপ্রস্তরে যে-সমস্ত প্রতিমা নিৰ্ম্মিত্ত হইয়াছিল, দেশীয় চিত্রশালাগুলিতে তাহাদের অনেক নমুনা
সংগৃহীত হইয়াছে। নমুনাগুলি আজিও এমন তাজা রহিয়াছে যে, উহাদের বয়স যে হাজার
বছর হইতে চলিল, উহাদের অবয়ব দেখিয়া তাহা বুঝিবার উপায় নাই। কালের সহস্ৰ পদক্ষেপের কোন
চিহ্নই প্রতিমাগুলির গাত্রে অঙ্কিত হয় নাই ।
বঙ্গের এমন ভাস্কৰ্য্য, আজ সম্পূর্ণ লোপ পাইয়াছে।
বাঙালী-হৃদয়ের উচ্ছল আনন্দরসধারা আর দেবমূৰ্ত্তিতে
মূৰ্ত্তিপরিগ্রহ করে না। বঙ্গীয়
ভাস্কর্য বলিতে আমরা বুঝি সেই ভাস্কর্য
যাহা ১২০০ খ্ৰীষ্টাব্দের কাছাকাছি, ঝড়ে যেমন করিয়া প্রদীপ নিবিয়া যায়, তেমনই
নিবিয়া গিয়াছিল। পুরাতন পুষ্করিণীর পঙ্কোদ্ধার করিতে, প্রাচীন
গড়-খাল হইতে মাটি তুলিতে সেই আমলের শত শত প্রস্তরমূৰ্ত্তি বাহির
হইইয়া পড়িয়া আমাদিগকে বঙ্গীয় ভাস্কর্য্যের সহিত পরিচিত করিয়াছে । কিন্তু
প্রাচীন বঙ্গে দারু-ভাস্কর্য্য কি প্রকারের ছিল, তাহা
কি জানিবার কোন উপায় নাই ? প্রস্তর অপেক্ষা কাষ্ঠ সহজপ্রাপ্য ও সস্তা।
দারু-তক্ষণকার্যও প্রস্তর তক্ষণ অপেক্ষা সহজসাধ্য। কাজেই
ভাস্কর্য্যে প্রস্তরের সঙ্গে সঙ্গে কাষ্ঠেরও
প্রচুর ব্যবহার হইত, এই অনুমান
অসঙ্গত নহে। প্রাচীন বঙ্গের দারু-ভাস্কর্য্যের নমুনা কি সম্পূর্ণ বিনষ্ট
হইয়াছে?
বাংলা দেশ ঝড়বৃষ্টির দেশ। উই-ইঁদুরের উৎপাতও এদেশে অত্যন্ত বেশী। কাজেই সাত-আট শত বৎসর, নয় শত বা হাজার বৎসরের দারু-ভাস্কর্ষ্যের নমুনা সম্পূর্ণ (৬৫২পাতা শুরু) বিনষ্ট
হইয়া থাকিলেও বিস্ময়ের বিষয় হইত না। কলিকাতা-চিত্রশালায় প্রাচীন
দারু-ভাস্কর্য্যের নমুনা বিশেষ আছে বলিইয়া অবগত নহি। রাজশাহী চিত্রশাল অথবা বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের চিত্রশালার অবস্থাও একই প্রকারের। সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গের প্রাচীন রাজধানী শ্রীবিক্রমপুর নগরীর নালা-পুষ্করিণী হইতে প্রাকমুসলমান যুগের দারু-ভাস্কর্য্যের অনেকগুলি নমুনা আমরা ঢাকার চিত্রশালার জন্য সংগ্ৰহ করিতে সমর্থ হইয়াছি। ত্রিপুরা জেলা হইতেও
একটি নমুনা সংগৃহীত হইয়াছে। ভাস্কর্য্যের মত সেই আমলের দারু-তক্ষণশিল্পও কত দূর উন্নতি লাভ করিয়াছিল, পাঠকগণ এই সমস্ত নমুনা হইতে আশা করি
তাহার স্পষ্ট একটা ধারণা পাইবেন । বঙ্গের ভাস্কৰ্য্য ত লুপ্ত
হইয়াছে, প্রস্তরশিল্পী বাংলা দেশে আজ নাই বলিলেই চলে।
আর প্রস্তর দুপ্রাপ্যও, কাজেই অনিশ্চিত
পৃষ্ঠপোষকের ভরসায় পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয়পূৰ্ব্বক প্রস্তরসংগ্রহে
শিল্পীগণের উৎসাহের আতিশয্য না-হইবারই কথা। কিন্তু কাষ্ঠ ত বাংলা দেশে আজও দুষ্প্রাপ্য
বা দুর্মূল্য নহে। প্রাচীন বঙ্গের দারু-তক্ষণ শিল্পের
পুনরুজ্জীবনও কি বাংলা দেশে আর সম্ভব নহে ?
আজ দারু-ভাস্কর্য্যের যে চমৎকার নিদর্শনটির পরিচয় দিতে বসিয়াছি, উহা
বাংলার প্রাচীন রাজধানী শ্রীবিক্রমপুর নগরীর (রামপাল) কেন্দ্রে অবস্থিত বল্লাল-বাড়ীর চৌগাড়া ১-চিহ্নিত
স্থানে পাওয়া গিয়াছিল। সঙ্গীয় মানচিত্রে প্রাচীন রাজধানীর কেন্দ্রে বল্লাল-বাড়ী ও উহার চৌগাড়ার অবস্থান দ্রষ্টব্য। ঢাকা
মিউজিয়মে সংগৃহীত প্রত্ননিদর্শনসমূহের আধাআধি এই
প্রাচীন রাজধানীর পুরাতন দীঘিপুষ্করিণী গড়-খাল হইতে পাওয়া।
প্রস্তরমূৰ্ত্তির ত কথাই নাই, এই আয়তন হইতে
দারু-ভাস্কর্ষ্যের নমুনাও অনেকগুলি পাওয়া
গিয়াছে। ক্রমশঃ সেগুলির পরিচয় দিতেছি।
No comments:
Post a Comment