ভারতেও প্রায় একই
সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সুবাদার বা আঞ্চলিক প্রশাসক এবং দেওয়ান বা সেই অঞ্চলের
রাজস্ব প্রধানের। এই দুই পদের মধ্যে সরকারিভাবে বিরোধ জিইয়ে রাখা নীতি
নেওয়া হত আবার ওপরওয়ালাদের কাছে তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে যে সব
অভিযোগ-প্রত্যাভিযোগ যেত, তাতে অধ্যাপক বেকারের ভাষায় তাদের ওপরে তীক্ষ্ণ
নিজর রাখার কৌশল দেখা যায়; এবং এর বিশদ বিবরণ আমার স্টাডিজ ইন ঔরঙ্গজেবস
রেইনএ সপ্তদশ খ্রিষ্টাব্দে ওডিসার ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে দিয়েছি।
ফলে ভারতেও, ভারতের বাইরের ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর মতই বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখার নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল।
সরকারের দ্বিতীয় চরিত্র মৌলভাবে সামরিক। ভারতের মাটিতে বহুকাল ধরে এই সামরিকতার প্রবণতা থাকায়, মুঘল সাম্রাজ্য সেই চরিত্রকে বদলাতে চায় নি। প্রশাসনের ওপরের স্তরের প্রত্যেকটি আমলাকে সামরিক তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হতে হত, তাকে কিছু ঘোড়ার মালিক করে, ন্যুনতম মনসব অভিধায় অভিহিত করা হত। ঘোড়াগুলির সংখ্যায় তার পদমর্যাদা এবং তার বেতন নির্ধারিত হত। প্রশাসনের আমলা(সিভিল সার্ভেন্টস), ধর্মীয় গুরুরা, ডাকবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মী, আবগারি বা চুঙ্গী বিভাগের আমলা এবং এমন কি সাধারণ করণিক এবং খাজাঞ্চিখানার নিম্নস্তরের কর্মীরাও মনসবদার অর্থাৎ সেনাবাহিনীর কর্মী পদে অভিষিক্ত হতেন। সামরিক বাহিনীর পদমর্যাদার তালিকায় তাঁদের পদের মর্যাদার ক্রমতালিকা তৈরি হত। তাদের বেতন দেওয়া হত বক্সী বা সেনাবাহিনীর খাজাঞ্চিখানা থেকে। তাদের পদোন্নতি হত সাধারণভাবে সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুসারে। এই অবস্থা থেকে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি, প্রশাসনিক এবং সামরিক, উভয় সেবার ক্ষেত্রেই আমরা যে তত্ত্ব দেখতে পাই তা হল সমগ্র সাম্রাজ্যে কোন অসামরিক খাঞ্চিখানা ছিলই না। তবে আমরা যেন মনে রাখি, বেতন দেওয়ার জন্য স্বাক্ষর করতেন বক্সী বা সেনাবাহিনীর প্রধান খাজাঞ্চি, কিন্তু(যুদ্ধ বা কুচ করে সাম্রাজ্যের প্রান্তের দিকে যাওয়ার সময় বাদ দিলে) অসামরিক প্রশাসনের বেতন দেওয়ার কাজটা করতেন কিন্তু বেসামরিক প্রশাসক দেওয়ান।
তৃতীয়ত, ভূমি রাজস্ব বিষয়ে মুঘল প্রশাসনের একটা চরিত্র হল তাঁরা ভারতের যে আবহমান কালের রীতিনীতি, সেগুলির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং সেগুলি ইসস্লামি আইন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে যায় নি। তাদের পূর্বের ইসলামি শাসকেরাও মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যে রাজস্ব পরিকাঠামো আর ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল কয়েক হাজার বছরের চেষ্টায়, সেই ব্যবস্থায় বিন্দুমাত্র মাথা গলাবার চেষ্টা করবেন না, যতক্ষণ সেই প্রশাসকেরা রাষ্ট্রের বরাদ্দ রাজস্ব ঠিকঠাক হিসেবে তুলে দিয়েছে; এমনকি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দু আমলাদেরও বদলের চেষ্টা করেন নি।
ভূমিরাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে একই কথা বলা যায়। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে একটা পারম্পরিক রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। একমাত্র রাষ্ট্রের এই আয়ের ক্ষেত্রে কোরাণ ভিত্তিক আইন কার্যকর হয় নি। অথচ ভারতের বাইরে যে সব ইসলামি রাষ্ট্র ছিল তারা কিন্তু রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে চরমতমভাবে ইসলামি আইন কার্যকর করতে চেষ্টা করেছে। এবং ইন্ডো-মহামেডান রাষ্ট্রে(ফিরোজ শাহ তুঘলক)র ইতিহাসেও চেষ্টা হয়েছে চলতি রীতিনীতি বদলে শারিয়তি আইন বলবত করার। ফলে সপ্তদশ শতে বিকশিত বিপুল মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যাপক ভূমিরাজস্বের রোজগার, দুটি পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে ১। দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষিত হিন্দু রীতিনীতির পরিবর্তন না আনা এবং ২। এ ব্যবস্থায় আরবি তত্ত্বের অনুপস্থিতি।
এই দুই পরীক্ষিত এবং সফল ব্যবস্থা ছাড়া অন্যান্য দিকে কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলক বা ঔরঙ্গজেবের ধর্মান্ধতার সময় দেশিয় অন্যান্য কর ব্যবস্থার ওপর কোরাণি রীতিনীতি চাপিয়ে দেওয়ার যে কাজ হয়েছে তা বিন্দুমাত্র সফল হয় নি, বরং তাঁদের শাসনের পরে সেই পুরোনো পদ্ধতি আবার নতুন করে ফিরে এসেছে স্বমহিমায়। এ নিয়ে আমরা নির্দিষ্ট অধ্যায়ে বিশদে আলোচনা করব।
(হয়ত চলবে)
ফলে ভারতেও, ভারতের বাইরের ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর মতই বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখার নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল।
সরকারের দ্বিতীয় চরিত্র মৌলভাবে সামরিক। ভারতের মাটিতে বহুকাল ধরে এই সামরিকতার প্রবণতা থাকায়, মুঘল সাম্রাজ্য সেই চরিত্রকে বদলাতে চায় নি। প্রশাসনের ওপরের স্তরের প্রত্যেকটি আমলাকে সামরিক তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হতে হত, তাকে কিছু ঘোড়ার মালিক করে, ন্যুনতম মনসব অভিধায় অভিহিত করা হত। ঘোড়াগুলির সংখ্যায় তার পদমর্যাদা এবং তার বেতন নির্ধারিত হত। প্রশাসনের আমলা(সিভিল সার্ভেন্টস), ধর্মীয় গুরুরা, ডাকবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মী, আবগারি বা চুঙ্গী বিভাগের আমলা এবং এমন কি সাধারণ করণিক এবং খাজাঞ্চিখানার নিম্নস্তরের কর্মীরাও মনসবদার অর্থাৎ সেনাবাহিনীর কর্মী পদে অভিষিক্ত হতেন। সামরিক বাহিনীর পদমর্যাদার তালিকায় তাঁদের পদের মর্যাদার ক্রমতালিকা তৈরি হত। তাদের বেতন দেওয়া হত বক্সী বা সেনাবাহিনীর খাজাঞ্চিখানা থেকে। তাদের পদোন্নতি হত সাধারণভাবে সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুসারে। এই অবস্থা থেকে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি, প্রশাসনিক এবং সামরিক, উভয় সেবার ক্ষেত্রেই আমরা যে তত্ত্ব দেখতে পাই তা হল সমগ্র সাম্রাজ্যে কোন অসামরিক খাঞ্চিখানা ছিলই না। তবে আমরা যেন মনে রাখি, বেতন দেওয়ার জন্য স্বাক্ষর করতেন বক্সী বা সেনাবাহিনীর প্রধান খাজাঞ্চি, কিন্তু(যুদ্ধ বা কুচ করে সাম্রাজ্যের প্রান্তের দিকে যাওয়ার সময় বাদ দিলে) অসামরিক প্রশাসনের বেতন দেওয়ার কাজটা করতেন কিন্তু বেসামরিক প্রশাসক দেওয়ান।
তৃতীয়ত, ভূমি রাজস্ব বিষয়ে মুঘল প্রশাসনের একটা চরিত্র হল তাঁরা ভারতের যে আবহমান কালের রীতিনীতি, সেগুলির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং সেগুলি ইসস্লামি আইন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে যায় নি। তাদের পূর্বের ইসলামি শাসকেরাও মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যে রাজস্ব পরিকাঠামো আর ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল কয়েক হাজার বছরের চেষ্টায়, সেই ব্যবস্থায় বিন্দুমাত্র মাথা গলাবার চেষ্টা করবেন না, যতক্ষণ সেই প্রশাসকেরা রাষ্ট্রের বরাদ্দ রাজস্ব ঠিকঠাক হিসেবে তুলে দিয়েছে; এমনকি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দু আমলাদেরও বদলের চেষ্টা করেন নি।
ভূমিরাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে একই কথা বলা যায়। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে একটা পারম্পরিক রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। একমাত্র রাষ্ট্রের এই আয়ের ক্ষেত্রে কোরাণ ভিত্তিক আইন কার্যকর হয় নি। অথচ ভারতের বাইরে যে সব ইসলামি রাষ্ট্র ছিল তারা কিন্তু রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে চরমতমভাবে ইসলামি আইন কার্যকর করতে চেষ্টা করেছে। এবং ইন্ডো-মহামেডান রাষ্ট্রে(ফিরোজ শাহ তুঘলক)র ইতিহাসেও চেষ্টা হয়েছে চলতি রীতিনীতি বদলে শারিয়তি আইন বলবত করার। ফলে সপ্তদশ শতে বিকশিত বিপুল মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যাপক ভূমিরাজস্বের রোজগার, দুটি পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে ১। দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষিত হিন্দু রীতিনীতির পরিবর্তন না আনা এবং ২। এ ব্যবস্থায় আরবি তত্ত্বের অনুপস্থিতি।
এই দুই পরীক্ষিত এবং সফল ব্যবস্থা ছাড়া অন্যান্য দিকে কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলক বা ঔরঙ্গজেবের ধর্মান্ধতার সময় দেশিয় অন্যান্য কর ব্যবস্থার ওপর কোরাণি রীতিনীতি চাপিয়ে দেওয়ার যে কাজ হয়েছে তা বিন্দুমাত্র সফল হয় নি, বরং তাঁদের শাসনের পরে সেই পুরোনো পদ্ধতি আবার নতুন করে ফিরে এসেছে স্বমহিমায়। এ নিয়ে আমরা নির্দিষ্ট অধ্যায়ে বিশদে আলোচনা করব।
(হয়ত চলবে)
No comments:
Post a Comment