ষষ্ঠ অধ্যায়
উত্তরভারতের হিন্দু সাম্রাজ্যবাদঃ বাঙ্গালির সমুদ্রযাত্রা
(প্রবন্ধ অনুবাদের পূর্বে স্পষ্ট কথা বলে দেওয়া দরকার এই অনুবাদের দায়িত্ব নেওয়া সংগঠন কোনভাবেই সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার প্রসারে বিশ্বাসী নয়, বরং স্থানীয় মানুষের ওপর যে কোন চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতির বিরোধী)
ভারতের অন্যান্য সমাজও ভারতের পূর্ব দিকে সমুদ্র বাণিজ্যে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল। ইতিহাস প্রমান প্রাচীন বৌদ্ধ সময়ের পরে থেকে খ্রিষ্ট শতের প্রথদিক পর্যন্ত পূর্ব ভারতের বাঙ্গালিরা সামরিক, ধর্মীয় এবং সমুদ্র বাণিজ্যযাত্রা করেছে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে। আজ এটি প্রমাণিত সত্য যে প্রাচীন বাঙ্গালিরা আজকের(বইটির লেখকের ভূমিকা ১৯১০ সালের – অনুবাদক) আধুনিক ভারতের সীমানার বাইরে ভীষণ ঝঞ্ঝা উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে বিদেশে রাজত্ব করেছিল এবং সেদেশগুলির নানান পণ্য নিয়ে ভারতে আসত। এটাও উল্লেখ করা জরুরি যে বাংলায় বেশ কিছু ধর্মান্দোলন ঘটেছে। খ্রিষ্ট শতের প্রথম দিকে ধর্ম প্রচারের জন্য উদ্যমী বৌদ্ধ বাঙালিরা চিন, কোরিয়া এবং জাপানে তাঁদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন – এদের মধ্যে অন্যতম অতীশ দীপঙ্কর এবং শীলভদ্র এশিয় খ্যাতি অর্জন করেছেন এবং বৌদ্ধ জগতে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। আজ আমরা জানতে পারছি জাপানের হরিউজি(Horiuzi) মন্দিরে পুরোহিতের জিম্মায় যে পুঁথি রয়েছে তা ১১ শতের বাংলা অক্ষরে রচনা হয়েছিল। ফলে বাঙ্গালীর অসাধারণ উদ্যম সূর্য ওঠার দেশে গিয়েও পৌছেছিল। শিল্পী এবং শিল্প সমালোচকেরা আজ নিশ্চিত যে জাভার বরবুদর(বড় বুদ্ধ?)এ যে স্থাপত্য এবং শিল্প কলা খোদিত হয়েছে তাঁর অন্যতম শ্রেয় যায় বাঙালি স্থপতি আর ভাষ্করদের। এঁরা কলিঙ্গ এবং গুজরাটি শিল্পীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই প্রাচীন সভ্যতা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন। এই বিশাল মন্দিরে বিভিন্ন খোদাইএর কাজে যে সব সমুদ্রপোতের ক্ষুদ্র চিত্র দেখাযায় সেগুলি সিংহল, জাভা, সুমাত্রা, চিন এবং জাপানে ধর্মীয়, সাম্রাজ্যবাদী, শিল্প এবং বাণিজ্য কর্মে যাবার জন্য নিম্ন বঙ্গের অধিবাসীরা তৈরি করত। মহাবংশ এবং অন্যান্য বৌদ্ধ সাহিত্যে ৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বাংলার রাজা বিজয় ৭০০ জন সঙ্গী নিয়ে সিংহলে সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল এবং সিংহ পরিবারের নামে এই দ্বীপের নামকরণ করেছিল – এবং সেই সাম্রাজ্যই আজ সিংহলি ইতিহাসের শুরুর শুরু হিসেবে গণ্য হয়। এরও আগের সময়ে ভাগলপুরের চম্পার বাঙ্গালিরা কোচিন চিনে(যতদূর সম্ভব দক্ষিণ ভিয়েতনাম - চম্পাদেশ) সাম্রাজ্য স্থাপন করে সেদেশের নামকরণ করে নিজেদের দেশের নামে। শুধু দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াই নয় নবম শতে বারেন্দ্রর ভাস্কর, ধীমান ও তাঁর পুত্র বীটপাল নেপালে যান এবং তাঁদের ভাস্কর্যের ঘরাণা ছড়িয়ে পড়ে তিব্বত, চিন থেকে অন্যান্য বৌদ্ধ দেশেও।
বাংলার সমুদ্রযাত্রা এবং বাণিজ্যের বর্ণনা বাঙালিদের সাহিত্যে উপযুক্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। ধনপতি, শ্রীমন্ত বা চাঁদসওদাগরের নায়কত্বে রচিত গ্রামে গঞ্জে গীত হওয়া চণ্ডী বা মনসার গানে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে ধর্মের ঘোমটার আবরণে। যেভাবে সেক্ষপিয়রের আন্টনিও তাঁর বৃহৎ বাণিজ্যপোতের(argosy) প্রথমটি ট্রিপোলি, দ্বিতীয়টি ইন্ডিজ, তৃতীয়টি মেক্সিকো এবং চতুর্থটি ইংলন্ডের পানে পাঠান, আমাদের বাংলার শ্রীমন্ত তাঁর বাণিজ্য তরী নিয়ে বাণিজ্যে যান করমণ্ডল উপকূলে, শ্রীলঙ্কায়, মালাক্কায়, জাভায় এবং চিনে। পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল লিখেছেন অন্তত ৫০ জন কবি যারা বাঙ্গালীর সমুদ্রযাত্রাকে বিশদে বর্ণনা করেছেন। দেবী চণ্ডীর স্তুতির পাশাপাশি প্রায় প্রতিটিতে সমুদ্রযাত্রার বিশদ বর্ণনা রয়েছে। এই লেখাগুলি ষোড়শ শতের শেষের দিকের রচনা। এবং সেই সাহিত্যে তাঁরা বাঙালির সমুদ্রিজয়ের কাহিনী খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করে গিয়েছেন। ত্রয়োদশ শতের কবি, যার উপাধি সুকবি, নারায়ণদেব চাঁদ সওদাগরের সমুদ্র বাণিজ্যের বিশদ বিবরণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। নারায়ণদাসের অনুগামী এবং তাঁর কাব্যে তথ্যে প্রণোদিত বংশীদাসও খুব বিশেদে বর্ণনা দিয়েছেন।
এই কাব্যগুলিতে সেই সময়ের বাংলার বাণিজ্যের একটা রূপরেখা পাওয়া যায়। কবিকঙ্কণ, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ(নাম ক্ষেমানন্দ, আর তিনি কেতকা বা মনসার দাস বলে কেতকাদাস – রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় কেতকাদাস আর ক্ষেমানন্দের মাঝে একটি কমা যোগ করে দুজনকে আলাদা মানুষ বানিয়ে দিয়েছেন) এবং অন্যান্যদের সূত্রে জানতে পারি নাবিকেরা সাধারণত পূর্ববঙ্গ থেকে জোগাড় হত। অর্ণবপোতগুলির কাব্যক নাম হত যেমন গঙ্গাপ্রদাস, সাগরফেণা, চন্দ্রপাট, রাজবল্লভ ইত্যাদি। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে খুব বিশদে সিংহলে যাওয়া ধনপতির সাতটি জাহাজের নাম বর্ণনা করেছেন - প্রথমে তুলিল ডিঙ্গা নাম মধুকর/শুধাই সুবর্ণে তাঁর বসিবার ঘর।/আর ডিঙ্গা তুলিলেক নাম দুর্গাবর।/ তবে তোলে ডিঙ্গাখানি নাম গুয়ারেখি। দ্বিপ্রহরের পথে যার মাথা কাঠ দেখি।।/ আর ডিঙ্গা তুলিলেক নাম শঙ্খচূড়। আশিগজ পানি ভাঙ্গি গাঙ্গে লয় কুল।/ তবে ডিঙ্গাখান তোলে নাম সিংহমুখী।/ সূর্য্যের সমানরূপ করে ঝিকিমিকি।।/ আর ডিঙ্গা তুলিলেক নাম চন্দ্রপান।/ তাথে ভরা দিলে দুই কূলে হয় থান।।/আর ডিঙ্গা তুলিলেক নামে ছোটমুখী।/ তাহে চালু ভরা চাহে হাজার এক পুটী।।/ সমধুনা দিয়া তবে গাইল সাত নায়। তড়িৎ গমনে ডিঙ্গা সাজিয়া চালায়।।/ সাতখানি ডিঙ্গা ভাসে ভ্রমরার জলে।/ গোঁজে বাঁধি রাখে ডিঙ্গা লোহার শিকলে।।/ তাঁর পিছে চলে ডিঙ্গা নাম চন্দ্রপাট/ যাহার উপরে চাঁদ মিলায়েছে হাট।।(বিজয়গুপ্ত)(এই কবিতাটি পাদটিকায় লিখেছেন লেখক)
অর্ণবপোতগুলি নাবিকদের মধুর সঙ্গীতে দিকদিগন্তরে ভেসে চলত। বহু দেশে সাধারণ জিনিস দিয়ে দুর্মূল্য বস্তু সংগৃহীত হত(মূলার বদলে দিল গজদন্ত – বিজয়গুপ্ত অথবা শুক্তার বদলে মুক্তা দিল/ভেড়ার বদলে ঘোড়া -কবিকঙ্কণ)।
সেযুগে বাংলার বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির মধ্যে প্রধান ছিল সাতগাঁ বা চিনাদের ভাষায় বা চরিত্রপুরা(Tcharitrapoura) বা টলেমির বর্ণনায় বিশাল আয়তনের বাণিজ্য কেন্দ্র। আর ছিল পূর্ববঙ্গের সোনারগাঁও। ভাগলপুরের চম্পাও খুব বড় বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল যেখান থেকে বাণিজ্য পোতগুলি বার্মা উপকূলের সুবর্ণভূমিতে গিয়ে পৌঁছত। তবে প্রাচীন বাংলার সব থেকে বড় দর্শনীয় স্থানের নাম ছিল, সমুদ্র তীরে বৌদ্ধ ধর্মস্থান তাম্রলিপ্ত। মহাবংশয় এই স্থানের নাম উল্লেখ রয়েছে হয়ত পেরিপ্লাসের অজানা লেখক যখন গঙ্গার মুখের কাছে অবস্থিত বড় বাণিজ্য কেন্দ্র যার রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল দুর্মূল্য, সুদর্শন কাপড় উল্লেখ করছেন আমরা ধরে নিচ্ছি যে তিনি তাম্রলিপ্তির কথাই বলছেন। এই শহরের ইতিহাস অশোকের রাজত্বপূর্ব সময়ের, এমনকি হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় সাহিত্যে এই উল্লেখ পাওয়া যায়। ৩০০-৪১৪ সালে ফাহিয়েন ভারত ভ্রমণে এসে লেখেন এখানে(তাম্রলিপ্তে) প্রত্যেকটিতে একজন করে পুরোহিতের নেতৃত্বে মোট ২৪টি সাংঘারাম রয়েছে। এই শহরে দুবছর কাটিয়ে তিনি শীতের সময়(অর্থাত উত্তরপূর্ব মৌসুমীবায়ু বেয়ে) একটি বাণিজ্য জাহাজে করে দক্ষিণ পশ্চিমের দিকে রওনা হয়ে যান। তাঁরা চৌদ্দ দিন রাত সমুদ্রে অতিবাহিত করে শ্রীলঙ্কায় উপস্থিত হন। এর আড়াইশ বছর পরে চিনের আরও একজন প্রখ্যাত ধর্ম পরিব্রাজক লেখনিতে পাচ্ছি তখন শহরে ১০টি বৌদ্ধ স্তুপ, হাজার ভিক্ষু এবং ২০০ফুট উঁচু একটি অশোক স্তম্ভ শোভিত তমলুক ছিল ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য শহর। এটি সমুদ্রের মুখে অবস্থিত, সমুদ্রে সড়ক বা জলপথে যাওয়া যায়। তিনি বলছেন শহরে দামি দামি পণ্য সাজানো থাকত এবং শহরবাসীরা ধনী ছিলেন। অন্য একজন পরিব্রাজক ইতসিং বাংলার এই বন্দর শহর সম্বন্ধে লিখেছেন, পূর্বভারতের শেষ ভূখণ্ড থেকে তাম্রলিপ্তি ৪০ যোজন দূরে অবস্থিত – এই শহরে পাঁচ থেকে ছয়টি বৌদ্ধস্তুপ রয়েছে, জনগণ ধনী...চিনে ফেরার পথে আমরা এইস্থানে কিছুকালের জন্য নেমেছি(তাকাকুসু’র ইতসিং থেকে)।
উত্তরভারতের হিন্দু সাম্রাজ্যবাদঃ বাঙ্গালির সমুদ্রযাত্রা
(প্রবন্ধ অনুবাদের পূর্বে স্পষ্ট কথা বলে দেওয়া দরকার এই অনুবাদের দায়িত্ব নেওয়া সংগঠন কোনভাবেই সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার প্রসারে বিশ্বাসী নয়, বরং স্থানীয় মানুষের ওপর যে কোন চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতির বিরোধী)
ভারতের অন্যান্য সমাজও ভারতের পূর্ব দিকে সমুদ্র বাণিজ্যে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল। ইতিহাস প্রমান প্রাচীন বৌদ্ধ সময়ের পরে থেকে খ্রিষ্ট শতের প্রথদিক পর্যন্ত পূর্ব ভারতের বাঙ্গালিরা সামরিক, ধর্মীয় এবং সমুদ্র বাণিজ্যযাত্রা করেছে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে। আজ এটি প্রমাণিত সত্য যে প্রাচীন বাঙ্গালিরা আজকের(বইটির লেখকের ভূমিকা ১৯১০ সালের – অনুবাদক) আধুনিক ভারতের সীমানার বাইরে ভীষণ ঝঞ্ঝা উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে বিদেশে রাজত্ব করেছিল এবং সেদেশগুলির নানান পণ্য নিয়ে ভারতে আসত। এটাও উল্লেখ করা জরুরি যে বাংলায় বেশ কিছু ধর্মান্দোলন ঘটেছে। খ্রিষ্ট শতের প্রথম দিকে ধর্ম প্রচারের জন্য উদ্যমী বৌদ্ধ বাঙালিরা চিন, কোরিয়া এবং জাপানে তাঁদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন – এদের মধ্যে অন্যতম অতীশ দীপঙ্কর এবং শীলভদ্র এশিয় খ্যাতি অর্জন করেছেন এবং বৌদ্ধ জগতে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। আজ আমরা জানতে পারছি জাপানের হরিউজি(Horiuzi) মন্দিরে পুরোহিতের জিম্মায় যে পুঁথি রয়েছে তা ১১ শতের বাংলা অক্ষরে রচনা হয়েছিল। ফলে বাঙ্গালীর অসাধারণ উদ্যম সূর্য ওঠার দেশে গিয়েও পৌছেছিল। শিল্পী এবং শিল্প সমালোচকেরা আজ নিশ্চিত যে জাভার বরবুদর(বড় বুদ্ধ?)এ যে স্থাপত্য এবং শিল্প কলা খোদিত হয়েছে তাঁর অন্যতম শ্রেয় যায় বাঙালি স্থপতি আর ভাষ্করদের। এঁরা কলিঙ্গ এবং গুজরাটি শিল্পীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই প্রাচীন সভ্যতা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন। এই বিশাল মন্দিরে বিভিন্ন খোদাইএর কাজে যে সব সমুদ্রপোতের ক্ষুদ্র চিত্র দেখাযায় সেগুলি সিংহল, জাভা, সুমাত্রা, চিন এবং জাপানে ধর্মীয়, সাম্রাজ্যবাদী, শিল্প এবং বাণিজ্য কর্মে যাবার জন্য নিম্ন বঙ্গের অধিবাসীরা তৈরি করত। মহাবংশ এবং অন্যান্য বৌদ্ধ সাহিত্যে ৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বাংলার রাজা বিজয় ৭০০ জন সঙ্গী নিয়ে সিংহলে সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল এবং সিংহ পরিবারের নামে এই দ্বীপের নামকরণ করেছিল – এবং সেই সাম্রাজ্যই আজ সিংহলি ইতিহাসের শুরুর শুরু হিসেবে গণ্য হয়। এরও আগের সময়ে ভাগলপুরের চম্পার বাঙ্গালিরা কোচিন চিনে(যতদূর সম্ভব দক্ষিণ ভিয়েতনাম - চম্পাদেশ) সাম্রাজ্য স্থাপন করে সেদেশের নামকরণ করে নিজেদের দেশের নামে। শুধু দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াই নয় নবম শতে বারেন্দ্রর ভাস্কর, ধীমান ও তাঁর পুত্র বীটপাল নেপালে যান এবং তাঁদের ভাস্কর্যের ঘরাণা ছড়িয়ে পড়ে তিব্বত, চিন থেকে অন্যান্য বৌদ্ধ দেশেও।
বাংলার সমুদ্রযাত্রা এবং বাণিজ্যের বর্ণনা বাঙালিদের সাহিত্যে উপযুক্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। ধনপতি, শ্রীমন্ত বা চাঁদসওদাগরের নায়কত্বে রচিত গ্রামে গঞ্জে গীত হওয়া চণ্ডী বা মনসার গানে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে ধর্মের ঘোমটার আবরণে। যেভাবে সেক্ষপিয়রের আন্টনিও তাঁর বৃহৎ বাণিজ্যপোতের(argosy) প্রথমটি ট্রিপোলি, দ্বিতীয়টি ইন্ডিজ, তৃতীয়টি মেক্সিকো এবং চতুর্থটি ইংলন্ডের পানে পাঠান, আমাদের বাংলার শ্রীমন্ত তাঁর বাণিজ্য তরী নিয়ে বাণিজ্যে যান করমণ্ডল উপকূলে, শ্রীলঙ্কায়, মালাক্কায়, জাভায় এবং চিনে। পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল লিখেছেন অন্তত ৫০ জন কবি যারা বাঙ্গালীর সমুদ্রযাত্রাকে বিশদে বর্ণনা করেছেন। দেবী চণ্ডীর স্তুতির পাশাপাশি প্রায় প্রতিটিতে সমুদ্রযাত্রার বিশদ বর্ণনা রয়েছে। এই লেখাগুলি ষোড়শ শতের শেষের দিকের রচনা। এবং সেই সাহিত্যে তাঁরা বাঙালির সমুদ্রিজয়ের কাহিনী খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করে গিয়েছেন। ত্রয়োদশ শতের কবি, যার উপাধি সুকবি, নারায়ণদেব চাঁদ সওদাগরের সমুদ্র বাণিজ্যের বিশদ বিবরণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। নারায়ণদাসের অনুগামী এবং তাঁর কাব্যে তথ্যে প্রণোদিত বংশীদাসও খুব বিশেদে বর্ণনা দিয়েছেন।
এই কাব্যগুলিতে সেই সময়ের বাংলার বাণিজ্যের একটা রূপরেখা পাওয়া যায়। কবিকঙ্কণ, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ(নাম ক্ষেমানন্দ, আর তিনি কেতকা বা মনসার দাস বলে কেতকাদাস – রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় কেতকাদাস আর ক্ষেমানন্দের মাঝে একটি কমা যোগ করে দুজনকে আলাদা মানুষ বানিয়ে দিয়েছেন) এবং অন্যান্যদের সূত্রে জানতে পারি নাবিকেরা সাধারণত পূর্ববঙ্গ থেকে জোগাড় হত। অর্ণবপোতগুলির কাব্যক নাম হত যেমন গঙ্গাপ্রদাস, সাগরফেণা, চন্দ্রপাট, রাজবল্লভ ইত্যাদি। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে খুব বিশদে সিংহলে যাওয়া ধনপতির সাতটি জাহাজের নাম বর্ণনা করেছেন - প্রথমে তুলিল ডিঙ্গা নাম মধুকর/শুধাই সুবর্ণে তাঁর বসিবার ঘর।/আর ডিঙ্গা তুলিলেক নাম দুর্গাবর।/ তবে তোলে ডিঙ্গাখানি নাম গুয়ারেখি। দ্বিপ্রহরের পথে যার মাথা কাঠ দেখি।।/ আর ডিঙ্গা তুলিলেক নাম শঙ্খচূড়। আশিগজ পানি ভাঙ্গি গাঙ্গে লয় কুল।/ তবে ডিঙ্গাখান তোলে নাম সিংহমুখী।/ সূর্য্যের সমানরূপ করে ঝিকিমিকি।।/ আর ডিঙ্গা তুলিলেক নাম চন্দ্রপান।/ তাথে ভরা দিলে দুই কূলে হয় থান।।/আর ডিঙ্গা তুলিলেক নামে ছোটমুখী।/ তাহে চালু ভরা চাহে হাজার এক পুটী।।/ সমধুনা দিয়া তবে গাইল সাত নায়। তড়িৎ গমনে ডিঙ্গা সাজিয়া চালায়।।/ সাতখানি ডিঙ্গা ভাসে ভ্রমরার জলে।/ গোঁজে বাঁধি রাখে ডিঙ্গা লোহার শিকলে।।/ তাঁর পিছে চলে ডিঙ্গা নাম চন্দ্রপাট/ যাহার উপরে চাঁদ মিলায়েছে হাট।।(বিজয়গুপ্ত)(এই কবিতাটি পাদটিকায় লিখেছেন লেখক)
অর্ণবপোতগুলি নাবিকদের মধুর সঙ্গীতে দিকদিগন্তরে ভেসে চলত। বহু দেশে সাধারণ জিনিস দিয়ে দুর্মূল্য বস্তু সংগৃহীত হত(মূলার বদলে দিল গজদন্ত – বিজয়গুপ্ত অথবা শুক্তার বদলে মুক্তা দিল/ভেড়ার বদলে ঘোড়া -কবিকঙ্কণ)।
সেযুগে বাংলার বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির মধ্যে প্রধান ছিল সাতগাঁ বা চিনাদের ভাষায় বা চরিত্রপুরা(Tcharitrapoura) বা টলেমির বর্ণনায় বিশাল আয়তনের বাণিজ্য কেন্দ্র। আর ছিল পূর্ববঙ্গের সোনারগাঁও। ভাগলপুরের চম্পাও খুব বড় বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল যেখান থেকে বাণিজ্য পোতগুলি বার্মা উপকূলের সুবর্ণভূমিতে গিয়ে পৌঁছত। তবে প্রাচীন বাংলার সব থেকে বড় দর্শনীয় স্থানের নাম ছিল, সমুদ্র তীরে বৌদ্ধ ধর্মস্থান তাম্রলিপ্ত। মহাবংশয় এই স্থানের নাম উল্লেখ রয়েছে হয়ত পেরিপ্লাসের অজানা লেখক যখন গঙ্গার মুখের কাছে অবস্থিত বড় বাণিজ্য কেন্দ্র যার রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল দুর্মূল্য, সুদর্শন কাপড় উল্লেখ করছেন আমরা ধরে নিচ্ছি যে তিনি তাম্রলিপ্তির কথাই বলছেন। এই শহরের ইতিহাস অশোকের রাজত্বপূর্ব সময়ের, এমনকি হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় সাহিত্যে এই উল্লেখ পাওয়া যায়। ৩০০-৪১৪ সালে ফাহিয়েন ভারত ভ্রমণে এসে লেখেন এখানে(তাম্রলিপ্তে) প্রত্যেকটিতে একজন করে পুরোহিতের নেতৃত্বে মোট ২৪টি সাংঘারাম রয়েছে। এই শহরে দুবছর কাটিয়ে তিনি শীতের সময়(অর্থাত উত্তরপূর্ব মৌসুমীবায়ু বেয়ে) একটি বাণিজ্য জাহাজে করে দক্ষিণ পশ্চিমের দিকে রওনা হয়ে যান। তাঁরা চৌদ্দ দিন রাত সমুদ্রে অতিবাহিত করে শ্রীলঙ্কায় উপস্থিত হন। এর আড়াইশ বছর পরে চিনের আরও একজন প্রখ্যাত ধর্ম পরিব্রাজক লেখনিতে পাচ্ছি তখন শহরে ১০টি বৌদ্ধ স্তুপ, হাজার ভিক্ষু এবং ২০০ফুট উঁচু একটি অশোক স্তম্ভ শোভিত তমলুক ছিল ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য শহর। এটি সমুদ্রের মুখে অবস্থিত, সমুদ্রে সড়ক বা জলপথে যাওয়া যায়। তিনি বলছেন শহরে দামি দামি পণ্য সাজানো থাকত এবং শহরবাসীরা ধনী ছিলেন। অন্য একজন পরিব্রাজক ইতসিং বাংলার এই বন্দর শহর সম্বন্ধে লিখেছেন, পূর্বভারতের শেষ ভূখণ্ড থেকে তাম্রলিপ্তি ৪০ যোজন দূরে অবস্থিত – এই শহরে পাঁচ থেকে ছয়টি বৌদ্ধস্তুপ রয়েছে, জনগণ ধনী...চিনে ফেরার পথে আমরা এইস্থানে কিছুকালের জন্য নেমেছি(তাকাকুসু’র ইতসিং থেকে)।
No comments:
Post a Comment