Buddhist Iconography গ্রন্থে ডক্টর ভট্টাচার্য্য প্রথম ছত্রের পাঠ ধরিয়াছেন (পৃ ৩০,
পাদটীকা)—“লালিত্য শৃঙ্গাররসাভিরামাং ” সাধনমালাতে ইহার শুদ্ধ পাঠ— “রামং"ই
আছে। কাজেই স্থিরচক্রের সহিত প্রজ্ঞা আছেন বলিয়া
ডক্টর ভট্টাচাৰ্য্য যে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, মূলে
তাহা কোনই ভিত্তি নাই। উপরের শ্লোক হইতে দেখা যায় দেবতার মূৰ্ত্তি
লালিত্য এবং শৃঙ্গার-রসের দ্বারা মনোরম তাঁহার মুখশ্ৰী প্রস্ফুটিত কমলসদৃশ। তিনি বীর এই কুমারাভরণধারী।
মুক্তক-রচিত দ্বিতীয় সাধনটিতে আছে যে মুঃ-কারং উজ্জ্বল কমলের উপর—
কুঙ্কুমাভং পঞ্চচীরং কুমারাভরণং শৃঙ্গারৈকরসং খড়্গপুস্তকং ধরং বাগীশ্বরমাত্মানং চন্দ্ৰস্থং
ধ্যায়াৎ।"
(৬৫৫পৃ) প্রথম সাধনে পুস্তকের কথা নাই, দ্বিতীয়
সাধনে পুস্তকের কথা বেশী আছে। যাহা হউক, বালাকৃতি, লালিত্য
ও শৃঙ্গার-রসে উজ্জল, চীরকধারী, কুমারাভরণে
সজ্জিত, খড়্গধর আমাদের এই মূৰ্ত্তিটি যে স্থিরচক্রমঞ্জুশ্রী দেবের এই বিষয়ে আমরা প্রায় নিশ্চিত হইতে পারি। সহস্র বৎসর
পূৰ্ব্বে নিপুণ শিল্পী দেবমূৰ্ত্তির গায়ে যে লালিত্য, শৃঙ্গার-রস এবং নবযৌবনের অপূৰ্ব্ব শ্ৰী ফুটাইয়া তুলিয়াছিল, দারু-ভাস্কর্য্যের অপূৰ্ব্ব
নিদর্শন এই মূৰ্ত্তিটিতে তাহার
লুপ্তাবশেষ দেখিয়া এ-যুগেও আমরা
বিস্মিত ও প্রশংসামুখর না হইয়া পারি না।
মূৰ্ত্তিটি উচ্চতায় চারি ফুট সাড়ে-নয় ইঞ্চি। ইহার বয়স সম্বন্ধে সাধারণ
ভাবে এইটুকুই বলা যায় যে, এই মূৰ্ত্তি
প্রাক-মুসলমান যুগের। ১৩০৫ খ্ৰীষ্টাব্দে পূৰ্ব্ববঙ্গে মুসলমান-অধিকার
বিস্তৃত হইয়াছিল। এই মূৰ্ত্তি তাহার পূর্ব্ববর্ত্তী । বিশেষ করিয়া বলিতে গেলে বলিতে হয়, আনুমানিক
১২৪০ খ্ৰীষ্টাব্দে সেন-বংশের পতনের পর ১৩০৫ খ্ৰীষ্টাব্দের মধ্যে পুৰ্ব্ববঙ্গে
বিক্রমপুর রাজধানীতে “নারায়ণকৃপাপ্রসাদসমাপাদিত গৌড়রাজ্যং" অধিরাজ দনুজমাধব শ্ৰীমদ্দশরথ দেবের বংশের রাজত্ব। এই অধিরাজ দনুজমাধব দশরথ দেব মুসলমান
ঐতিহাসিকগণের নিকট দনুজ রায় বলিয়া পরিচিত। ইনি পরম বৈষ্ণব, নারায়ণের
কৃপায় গৌড়রাজ্য—অর্থাৎ
বিস্তৃত সেন-রাজ্যের পূর্ববঙ্গস্থ অংশে অধিকারী হইয়াছেন বলিয়া নিজের আদাবাড়ী তাম্রশাসনে লিখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার বংশের অধিকার
কালে রাজবাড়ীর অভ্যন্তরে,
অথবা অব্যবহিত বাহিরে বৌদ্ধ মন্দিরের অবস্থান বিশেষ সম্ভবপর বলিয়া মনে না। দনুজ রায়ের বংশের
পূর্ববৰ্ত্তী সেন-বংশ ও বর্ম্মণ বংশের অধিকারকাল সম্বন্ধেও সেই কথা খাটে।
তবে এক (সমস্যা?) আছে। সামলবৰ্ম্মের বজ্রযোগিনী শাসনে দেখা
যায়, তিনি নারায়ণের প্রীতিকামনায় বিষ্ণুচক্রমুদ্রা দ্বারা মুদ্রিত তাম্রশাসন দ্বারা ভীমদেব-প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ দেবী প্রজ্ঞাপারমিতার মন্দিরে ভূমি দান করিতেছেন। কাজেই বর্মণযুগে রাজবাড়ীর নিকটেও বৌদ্ধ মন্দিরের অবস্থান অসম্ভব নহে। বৰ্ম্ম-বংশের পূৰ্ব্বে
পরমসৌগত মহারাজাধিরাজ শ্রীচন্দ্র বিক্রমপুর রাজধানী হইতে
পূৰ্ব্ববঙ্গ (চৌকাঠের উপরের কাঠ। নাটেশ্বর গ্রামে প্রাপ্ত – ছবি)
(৬৫৬পৃষ্ঠা) শাসন করিয়া গিয়াছেন। তাহার আমলে (আনুমানিক
৯৮৫ খ্ৰীষ্টাব্দ হইতে ১০২০ খ্ৰীষ্টাব্দ) রাজবাড়ীতে বৌদ্ধ
মন্দির থাকাই স্বাভাবিক এবং এমন অপূর্ব কলানৈপুণ্যমণ্ডিত মূৰ্ত্তি ঐ আমলেই নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল বলিয়া নিৰ্দ্ধারণ যুক্তিসঙ্গত। এই হিসাবে এই
দারু-মূৰ্ত্তিটির বয়স প্রায় ৯৩৭ বৎসর হইয়াছে বলিয়া নিৰ্দ্ধারণ করা যায়।
ইছামতী নদীর তীর
হইতে দক্ষিণে প্রসৃত একটি সুপ্রশস্ত রাস্তার দুই পারে
কি ভাবে বিক্রমপুর রাজধানীটি গড়িয়া উঠিয়াছিল, মানচিত্ৰখানি অনুধাবন করিলেই তাহা বুঝা
যাইবে। হিন্দু-আমলের এই সুপ্রশস্ত রাস্তা
অদ্যাপি কাচকী দরজা নামে পরিচিত এবং এই ইছামতী-তীর হইতে প্রায় ৫০ মাইল দক্ষিণস্থ প্রাচীন পদ্মা-মেঘনাসঙ্গম পৰ্য্যন্ত অদ্যাপি ইহার অস্তিত্ব অনুসরণ
করা যায়। ইছামতীতীর হইতে আরম্ভ করিয়া মাকুহাটীর খাল পর্য্যন্ত এই রাস্তার যে অংশ, সেই প্রায় ছয় মাইল বিস্তৃত স্থানে, রাস্তার দুই ধারে এবং বিস্তৃত জলাশয়গুলির পারে পারে নাগরিকগণের অট্টালিকা, দেবমন্দিরাদি নিৰ্ম্মিত হইয়া বিস্তৃত
নগর গড়িয়া উঠিয়াছিল। মানচিত্রে অনেকগুলি দীঘির
অবস্থান দেখান হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে বিখ্যাত রামপাল দীঘি লম্বায় মাইলের তৃতীয়াংশেরও বেশী। নৈর(পাদটিকা- এই নৈ এক
জন অজ্ঞাতকুলশীল রাজার নাম বলিয়া মনে হয় । পুকুরের আয়তন দেখিয়া মনে হয়, ইনি বেশ বড় রাজা ছিলেন। ভাগীরথীর উভয় কুলেও নৈহাটি অভিধেয় গ্রামগুলির নামে, এই রাজারই নাম বিজড়িত রহিয়াছে বলিয়া
বোধ হয়। অপর পক্ষে বক্তব্য এই যে, নৈ নদী শব্দের অপভ্রংশ হওয়াও অসম্ভব নহে।)
পুকুর এবং ধামারণের দীঘি রামপালের দীঘি হইতে আয়তনে
বড় কম নহে। বিক্রমপুরে প্রাচীন দেবালয়ের ধ্বংসাবশেষ ঢিপিগুলি দেউল নামে পরিচিত। দেউলগুলির সংলগ্ন প্রায়ই একাধিক দীঘি বিদ্যমান। এই সমস্ত ছোটবড়
দীঘি হইতে সৰ্ব্বদাই কাঠ ও পাথরের প্রাচীন মূৰ্ত্তি ইত্যাদি বাহির হইতেছে। এইরূপ কয়েকটি দারুভাস্কর্য্যের পরিচয় দিয়া প্রবন্ধ সমাপ্ত করিব।
No comments:
Post a Comment