(গত কয়েকদিন ধরে বাংলায় মারোয়াড়িদের ভোট দেওয়া ইত্যদি নিয়ে বেশ বিতর্ক
তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে জুটেছিল কুমারবাবুর সিরাজ সংক্রান্ত প্রকাশনা এবং
আমাদের পলাশি বিষয়ক উত্তর। ফলে সেই সময় বুঝতে কিছু লেখা তৈরি করার ভাবনা
মাথায় আসে। তার প্রথম বিষয় এই লেখাটি। এটি দ্বিতীয় খণ্ড। এই লেখাটির সঙ্গে
বাংলা মায়ের সে সময়ের সমৃদ্ধির বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। লেখাগুলো
বড় হবে।
ভাল লাগলে পড়বেন, মন্তব্য করবেন, আতঙ্ক হলে ক্ষমাঘেন্না করে এড়িয়ে যাবেন। - উইভার্স, আর্টিজান, ট্রাডিশনাল পার্ফর্মিং আর্টিস্টস গিল্ডের পক্ষে বিশ্বেন্দু)
পুর্বপ্রকাশিতের পর...
টাঁকশালে দামি ধাতু ভাঙ্গিয়ে মুদ্রা তৈরি করতে জগতশেঠেরা বাটা নিত। যারা বাংলায় ব্যবসা করতেন তাঁদের প্রত্যেক বছর জগতশেঠেদের থেকে বাটা দিয়ে মুদ্রা ছাপ দিয়ে নিতে হত। শুধু এই কর্মেই জগতশেঠেদের বিপুল মুনাফা হতে থাকে। বাংলা সুবায় সে সময় নানান ধরনের মুদ্রা চলত। অথচ বাংলার মুদ্রা ব্যবস্থায় কোন মাতস্যন্যায় আসে নি(এ নিয়ে আমাদের যুক্তি অন্য - সে পরে কোন দিন - বিশ্বেন্দু)। সব মুদ্রার টিকি বাঁধা ছিল শেঠেদের কোঠিতে। তারা স্রফদের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করত। বাঙ্গালয় যত সোনা বা দামি ধাতু আসত তা প্রথমে জমা দিতে হত জগতশেঠ নিয়ন্ত্রিত টাঁকশালে।
জগতশেঠেদের অন্যতম কাজ ছিল বাংলার ভুমিরাজস্ব জমা নেওয়া আর সেগুলি দিল্লিতে চালান করা। নবাব বছরের প্রথম দিনে যে পুন্যাহ পালন করতেন, সারা সুবা থেকে সে দিন সমস্ত জমিদার তাঁদের দেয় ভুমিরাজস্ব জমা দিত শেঠেদের কোঠিতে। তার পর তাঁরা পদমর্যাদা অনুযায়ী খেলাত নিতেন নবাবের দরবার থেকে। শেঠেদের কোঠি থেকে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ দিল্লির রাজদরবারেতে হুন্ডি কাটা হত। ১৭২৮ থেকে ১৭৪০ পর্যন্ত বাংলার রাজস্বের এক বিপুল অংশ দিল্লির কোঠি কেন্দ্রিয় রাজস্বে জমা করেছে। অর্থাৎ জগতশেঠের কোঠি, বাংলা সুবার স্টেট ব্যাঙ্ক রূপে কাজ করত। নবাবের দরবারের আমিরদের বক্তব্য ছিল কোঠি (ফতেচাঁদের এস্টেট) নবাবের তোষাখানা রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলায় ১৭০৬ সালে মানিকচাঁদ ইংরেজদের সঙ্গে প্রথম কাজ শুরু করেন। ১৭১৮ থেকে ১৭৩০ পর্যন্ত ব্রিটিশেরা কোঠি থেকে গড়ে বছরে চার লাখ টাকা ধার করত। হয়ত পাটনা, ঢাকা, কলকাতা কোঠিও প্রায় একই পরিমান অর্থ ধার করত। ধারের ব্যাপারটা জটিল হয়ে পড়ে কোম্পানির আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা জুড়ে যাওয়ায়। ব্রিটিশেরা এই দুটি আলাদা করলেও শেঠেরা ব্যবসাকে আলাদারূপে দেখত না – এ নিয়ে বচসা মতান্তর হয় – রাজসভা পর্যন্ত গড়ায়। ব্রিটিশদের জগতশেঠেদের নীতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়েছে, ফতেচাঁদকে সমঝে চলতে হয়েছে।
কেন জানানেই, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই ছিল বাংলার নবাবদের সবথেকে বেশি দরকষাকষি – যদিও কিছু বিধিনিষেধ ছাড়া দিল্লি থেকে তারা টাকা ছাপাবার ফারুকশিয়রের ফর্মান হাসবুলহুকুম হাসিল করেছিল। ব্রিটিশ আর ডাচেদের বাংলার টাঁকশাল দখলের চেষ্টা বরাবরই বাংলার নবাবেরা বাধা দিয়ে এসেছে। যদিও দাক্ষিণাত্যে আর্কট টাকা ছাপাত ব্রিটিশেরাই। মুর্শিদকুলি, সুজাউদ্দিন, আলিবর্দি এবং সিরাজ পর্যন্ত প্রথমে জগতশেঠ ফতেচাঁদ এবং তাঁর পর জগতশেঠ মহতাব রাই নবাবের হয়ে মুদ্রা ছাপানোর কাজটি করে এসেছেন। ফারুকশিয়রের ফর্মানে ছিল যে মাদ্রাজের মুদ্রা যদি সুরাটের মত গুণমানে হয়, সেগুলি বাংলায় বাটা ছাড়া চালাতে দিতে হবে। বাস্তবে এটাও বাংলায় প্রয়োগ করা যায় নি।
জগতশেঠেরা পূর্বভারতের সবথেকে বড় ব্যাঙ্কার ছিল। তাঁরা মুদ্রা বিনিমিয়ের হার, দামি ধাতু নিশ্চিতভাবে হাত বদল করা এবং নির্দিষ্ট পরিমান ঋন নির্দিষ্ট সময়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মাহির ছিল। বড় হয়ে ওঠা পুঁজির যে সব ভাইসেস গুলি থাকে যেমন বর্তমান সময়ের লটারি/জুয়াড়ি অর্থনীতি (স্পেকুলেটিভ স্পিরিট), তাতে বিশ্বাস করতেন না জগত শেঠেরা। তাঁদের ওপর নির্ভর করা যেত, তাঁরা বুঝদার ছিলেন এবং বড় ব্যবসার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন। যদিও তাঁদের ব্যবসা সরাসরি রাষ্টের সঙ্গে মিলেমিশে চলত, যা আদতে আধুনিক ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার নীতির বিপরীত, কিন্তু পলাশির আগে পর্যন্ত তাঁরা মূল ব্যবসার নীতি মেনে চলতেন মন্তব্য করেছেন নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিনহা।
লিটল অন্যান্য ব্রিটিশার ঐতিহাসিকদের মত জগতশেঠেদের সঙ্গে ব্রিটিশদের কি সম্পর্ক ছিল তা নিয়েই শুধু কলমপাত করেছেন। অথচ বাংলার স্বাধীন সিদ্ধান্তের (ব্যবসায়ীদের থেকে দাদন নিয়েও সেই অগ্রিম প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন পলাশি পূর্ব বাংলার তাঁতি বা অন্য উতপাদক) তাঁতিদের সুতির এবং রেশমের কাপড়, বাংলা সুবার সোরাসহ হাজার পণ্যদ্রব্য কেনার তুমুল প্রতিযোগিতা ছিল ব্যবসায়ী মহলে, ফলে নির্দিষ্ট সময়ে ধারের পরিকাঠমো তৈরি হয়েছিল বাংলায়। জগত শেঠদের নীতিই ছিল কম সময়ে ধার দেওয়া। সেই সময়ের বাংলার আর্থ ব্যবস্থায় সেই নীতি খাপে খাপ খেয়ে গিয়েছিল। ১৭৫৭ সালে ডাচেরা তাদের থেকে বার্ষিক ৯ শতাংশ সুদে চার লাখ ধার নেয়। চন্দনগর দখল হওয়ার বছরে ফরাসিরা ধার করে পনের লক্ষ। ঢাকা বা কলকাতা, হুগলী, চন্দননগর বা অন্তর্দেশিয় বা আন্তর্জাতিক – যে কোন ব্যবসার সাফল্য নির্ভর করে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমানে ঋন পাওয়ার পরিকাঠামো রয়েছে কিনা তার ওপর। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সহজ এবং নিরবিচ্ছিন্ন ঋনের সুযোগ যে কোন ব্যবসায়ীর অন্যতম প্রধান চাহিদা।
আগেই বলেছি পূর্ব ভারতের আর্থ ব্যবস্থায় জগতশেঠের কুঠি ছিল একমাত্র ব্যবস্থাপক। শুধু দেশে বা দিল্লিতেই নয় বিদেশেও হুণ্ডির জাল ছড়ানো ছিল। মধ্য এশিয়ার তুরানি ব্যবসায়ী, বসরা, মোকা, জেড্ডায় ব্যবসা করা আর্মেনিয় ব্যবসায়ীরা, উত্তর ভারতের ব্যবসায়ী, ব্রিটিশ, ফরাসি, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ কোম্পানি এমন কি কোম্পানির আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়েও ধার দিতেন জগতশেঠেরা। সুতি বস্ত্র, কাঁচা রেশম, রেশম বস্ত্র এবং সোরা ব্যবসায় যে অমিত দক্ষতা তৈরি করেছিল পূর্ব ভারত, তার জাল ছড়িয়ে ছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে কিভা আর বোখারার খানাতে পর্যন্ত, ভূমধ্যসাগর থেকে অস্ত্রাখান ছাড়িয়ে মস্কো পর্যন্ত। সে ব্যবসা কত পরমান ছিল তা আজ আর জানা যায় না।
আন্তোনোভার গবেষনার সূত্র জানতে পারছি, রুশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যে পাঞ্জাবি, সিন্ধ, মুসলমান, মারোয়াড়ি, শিখেরা ব্যবসা করতেন তাঁদের কোন না কোনভাবেই মুর্শিদাবাদের জগতশেঠেদের কোঠিতে টিকি বাঁধা থাকত। রুশ তথ্যপঞ্জিতে যে সব ব্যবসায়ির নাম পাওয়া যাচ্ছে – মাটু, বলরাম, সুখানন্দ, চান্তু, কাসিরাম, মগনদাস বা ভারতীয়-তিব্বতি ব্যবসায়ী সক্কলে জগতশেঠেদের কোঠির হুন্ডি ব্যবহার করত। ১৭৪৭এর নাদির শাহের হত্যাকাণ্ড এবং তার পরে যে ঘটনাবলীর সূত্রপাত হয় তাতে সাময়িকভাবে পারস্যের সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়িক সূত্র কিছু সময়ের জন্য কেটে যায়। যদুনাথ সরকারের লাইফ অব নাজিবুদ্দৌলা প্রবন্ধ উল্লেখ করে নরেন্দ্র কৃষ্ণ লিখছেন, ১৭৫৭য় আফগানি লুঠেরা আহমদ শাহ দিল্লিতে প্রবেশ করেন, তার লুঠের ছাড়পত্র ছিল একমাত্র জগতশেঠ। আমির ওমরাহ’র লুঠের খাজানার আফগানিস্তানে পৌঁছে দেওয়ার দায় নিতে হত শেঠেদের – এমনই ছিল তাঁদের নাম-যশ। শুধু ব্যবসাই নয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দুর্যোগেও শেঠেরা বিপুল পরিমান অর্থ ব্যবস্থা করতেন। অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে উত্তরভারতের ঋণের বাজারের অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল মুর্শিদাবাদ।(চলবে)...
ভাল লাগলে পড়বেন, মন্তব্য করবেন, আতঙ্ক হলে ক্ষমাঘেন্না করে এড়িয়ে যাবেন। - উইভার্স, আর্টিজান, ট্রাডিশনাল পার্ফর্মিং আর্টিস্টস গিল্ডের পক্ষে বিশ্বেন্দু)
পুর্বপ্রকাশিতের পর...
টাঁকশালে দামি ধাতু ভাঙ্গিয়ে মুদ্রা তৈরি করতে জগতশেঠেরা বাটা নিত। যারা বাংলায় ব্যবসা করতেন তাঁদের প্রত্যেক বছর জগতশেঠেদের থেকে বাটা দিয়ে মুদ্রা ছাপ দিয়ে নিতে হত। শুধু এই কর্মেই জগতশেঠেদের বিপুল মুনাফা হতে থাকে। বাংলা সুবায় সে সময় নানান ধরনের মুদ্রা চলত। অথচ বাংলার মুদ্রা ব্যবস্থায় কোন মাতস্যন্যায় আসে নি(এ নিয়ে আমাদের যুক্তি অন্য - সে পরে কোন দিন - বিশ্বেন্দু)। সব মুদ্রার টিকি বাঁধা ছিল শেঠেদের কোঠিতে। তারা স্রফদের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করত। বাঙ্গালয় যত সোনা বা দামি ধাতু আসত তা প্রথমে জমা দিতে হত জগতশেঠ নিয়ন্ত্রিত টাঁকশালে।
জগতশেঠেদের অন্যতম কাজ ছিল বাংলার ভুমিরাজস্ব জমা নেওয়া আর সেগুলি দিল্লিতে চালান করা। নবাব বছরের প্রথম দিনে যে পুন্যাহ পালন করতেন, সারা সুবা থেকে সে দিন সমস্ত জমিদার তাঁদের দেয় ভুমিরাজস্ব জমা দিত শেঠেদের কোঠিতে। তার পর তাঁরা পদমর্যাদা অনুযায়ী খেলাত নিতেন নবাবের দরবার থেকে। শেঠেদের কোঠি থেকে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ দিল্লির রাজদরবারেতে হুন্ডি কাটা হত। ১৭২৮ থেকে ১৭৪০ পর্যন্ত বাংলার রাজস্বের এক বিপুল অংশ দিল্লির কোঠি কেন্দ্রিয় রাজস্বে জমা করেছে। অর্থাৎ জগতশেঠের কোঠি, বাংলা সুবার স্টেট ব্যাঙ্ক রূপে কাজ করত। নবাবের দরবারের আমিরদের বক্তব্য ছিল কোঠি (ফতেচাঁদের এস্টেট) নবাবের তোষাখানা রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলায় ১৭০৬ সালে মানিকচাঁদ ইংরেজদের সঙ্গে প্রথম কাজ শুরু করেন। ১৭১৮ থেকে ১৭৩০ পর্যন্ত ব্রিটিশেরা কোঠি থেকে গড়ে বছরে চার লাখ টাকা ধার করত। হয়ত পাটনা, ঢাকা, কলকাতা কোঠিও প্রায় একই পরিমান অর্থ ধার করত। ধারের ব্যাপারটা জটিল হয়ে পড়ে কোম্পানির আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা জুড়ে যাওয়ায়। ব্রিটিশেরা এই দুটি আলাদা করলেও শেঠেরা ব্যবসাকে আলাদারূপে দেখত না – এ নিয়ে বচসা মতান্তর হয় – রাজসভা পর্যন্ত গড়ায়। ব্রিটিশদের জগতশেঠেদের নীতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়েছে, ফতেচাঁদকে সমঝে চলতে হয়েছে।
কেন জানানেই, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই ছিল বাংলার নবাবদের সবথেকে বেশি দরকষাকষি – যদিও কিছু বিধিনিষেধ ছাড়া দিল্লি থেকে তারা টাকা ছাপাবার ফারুকশিয়রের ফর্মান হাসবুলহুকুম হাসিল করেছিল। ব্রিটিশ আর ডাচেদের বাংলার টাঁকশাল দখলের চেষ্টা বরাবরই বাংলার নবাবেরা বাধা দিয়ে এসেছে। যদিও দাক্ষিণাত্যে আর্কট টাকা ছাপাত ব্রিটিশেরাই। মুর্শিদকুলি, সুজাউদ্দিন, আলিবর্দি এবং সিরাজ পর্যন্ত প্রথমে জগতশেঠ ফতেচাঁদ এবং তাঁর পর জগতশেঠ মহতাব রাই নবাবের হয়ে মুদ্রা ছাপানোর কাজটি করে এসেছেন। ফারুকশিয়রের ফর্মানে ছিল যে মাদ্রাজের মুদ্রা যদি সুরাটের মত গুণমানে হয়, সেগুলি বাংলায় বাটা ছাড়া চালাতে দিতে হবে। বাস্তবে এটাও বাংলায় প্রয়োগ করা যায় নি।
জগতশেঠেরা পূর্বভারতের সবথেকে বড় ব্যাঙ্কার ছিল। তাঁরা মুদ্রা বিনিমিয়ের হার, দামি ধাতু নিশ্চিতভাবে হাত বদল করা এবং নির্দিষ্ট পরিমান ঋন নির্দিষ্ট সময়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মাহির ছিল। বড় হয়ে ওঠা পুঁজির যে সব ভাইসেস গুলি থাকে যেমন বর্তমান সময়ের লটারি/জুয়াড়ি অর্থনীতি (স্পেকুলেটিভ স্পিরিট), তাতে বিশ্বাস করতেন না জগত শেঠেরা। তাঁদের ওপর নির্ভর করা যেত, তাঁরা বুঝদার ছিলেন এবং বড় ব্যবসার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন। যদিও তাঁদের ব্যবসা সরাসরি রাষ্টের সঙ্গে মিলেমিশে চলত, যা আদতে আধুনিক ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার নীতির বিপরীত, কিন্তু পলাশির আগে পর্যন্ত তাঁরা মূল ব্যবসার নীতি মেনে চলতেন মন্তব্য করেছেন নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিনহা।
লিটল অন্যান্য ব্রিটিশার ঐতিহাসিকদের মত জগতশেঠেদের সঙ্গে ব্রিটিশদের কি সম্পর্ক ছিল তা নিয়েই শুধু কলমপাত করেছেন। অথচ বাংলার স্বাধীন সিদ্ধান্তের (ব্যবসায়ীদের থেকে দাদন নিয়েও সেই অগ্রিম প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন পলাশি পূর্ব বাংলার তাঁতি বা অন্য উতপাদক) তাঁতিদের সুতির এবং রেশমের কাপড়, বাংলা সুবার সোরাসহ হাজার পণ্যদ্রব্য কেনার তুমুল প্রতিযোগিতা ছিল ব্যবসায়ী মহলে, ফলে নির্দিষ্ট সময়ে ধারের পরিকাঠমো তৈরি হয়েছিল বাংলায়। জগত শেঠদের নীতিই ছিল কম সময়ে ধার দেওয়া। সেই সময়ের বাংলার আর্থ ব্যবস্থায় সেই নীতি খাপে খাপ খেয়ে গিয়েছিল। ১৭৫৭ সালে ডাচেরা তাদের থেকে বার্ষিক ৯ শতাংশ সুদে চার লাখ ধার নেয়। চন্দনগর দখল হওয়ার বছরে ফরাসিরা ধার করে পনের লক্ষ। ঢাকা বা কলকাতা, হুগলী, চন্দননগর বা অন্তর্দেশিয় বা আন্তর্জাতিক – যে কোন ব্যবসার সাফল্য নির্ভর করে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমানে ঋন পাওয়ার পরিকাঠামো রয়েছে কিনা তার ওপর। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সহজ এবং নিরবিচ্ছিন্ন ঋনের সুযোগ যে কোন ব্যবসায়ীর অন্যতম প্রধান চাহিদা।
আগেই বলেছি পূর্ব ভারতের আর্থ ব্যবস্থায় জগতশেঠের কুঠি ছিল একমাত্র ব্যবস্থাপক। শুধু দেশে বা দিল্লিতেই নয় বিদেশেও হুণ্ডির জাল ছড়ানো ছিল। মধ্য এশিয়ার তুরানি ব্যবসায়ী, বসরা, মোকা, জেড্ডায় ব্যবসা করা আর্মেনিয় ব্যবসায়ীরা, উত্তর ভারতের ব্যবসায়ী, ব্রিটিশ, ফরাসি, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ কোম্পানি এমন কি কোম্পানির আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়েও ধার দিতেন জগতশেঠেরা। সুতি বস্ত্র, কাঁচা রেশম, রেশম বস্ত্র এবং সোরা ব্যবসায় যে অমিত দক্ষতা তৈরি করেছিল পূর্ব ভারত, তার জাল ছড়িয়ে ছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে কিভা আর বোখারার খানাতে পর্যন্ত, ভূমধ্যসাগর থেকে অস্ত্রাখান ছাড়িয়ে মস্কো পর্যন্ত। সে ব্যবসা কত পরমান ছিল তা আজ আর জানা যায় না।
আন্তোনোভার গবেষনার সূত্র জানতে পারছি, রুশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যে পাঞ্জাবি, সিন্ধ, মুসলমান, মারোয়াড়ি, শিখেরা ব্যবসা করতেন তাঁদের কোন না কোনভাবেই মুর্শিদাবাদের জগতশেঠেদের কোঠিতে টিকি বাঁধা থাকত। রুশ তথ্যপঞ্জিতে যে সব ব্যবসায়ির নাম পাওয়া যাচ্ছে – মাটু, বলরাম, সুখানন্দ, চান্তু, কাসিরাম, মগনদাস বা ভারতীয়-তিব্বতি ব্যবসায়ী সক্কলে জগতশেঠেদের কোঠির হুন্ডি ব্যবহার করত। ১৭৪৭এর নাদির শাহের হত্যাকাণ্ড এবং তার পরে যে ঘটনাবলীর সূত্রপাত হয় তাতে সাময়িকভাবে পারস্যের সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়িক সূত্র কিছু সময়ের জন্য কেটে যায়। যদুনাথ সরকারের লাইফ অব নাজিবুদ্দৌলা প্রবন্ধ উল্লেখ করে নরেন্দ্র কৃষ্ণ লিখছেন, ১৭৫৭য় আফগানি লুঠেরা আহমদ শাহ দিল্লিতে প্রবেশ করেন, তার লুঠের ছাড়পত্র ছিল একমাত্র জগতশেঠ। আমির ওমরাহ’র লুঠের খাজানার আফগানিস্তানে পৌঁছে দেওয়ার দায় নিতে হত শেঠেদের – এমনই ছিল তাঁদের নাম-যশ। শুধু ব্যবসাই নয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দুর্যোগেও শেঠেরা বিপুল পরিমান অর্থ ব্যবস্থা করতেন। অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে উত্তরভারতের ঋণের বাজারের অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল মুর্শিদাবাদ।(চলবে)...
No comments:
Post a Comment