রামপাল দীঘির
দক্ষিণ পারে জল শুকাইয়া অনেকটা স্থান ভরাট
হইয়া গিয়াছে। ঐ ভরাট জমির ২-চিহ্নিত স্থান হইতে মাটি তুলিতে কয়েক বৎসর পূৰ্ব্বে দুইটি কারুকার্য্য-মণ্ডিত কাষ্ঠপ্তম্ভ পাওয়া যায়। স্তম্ভ দুইটি বহু দিন পর্যন্ত আবিষ্কর্ত্তা শেখ আবদুল গণি এবং
শেখ আবদুল রহমন ভ্রাতৃদ্বয়ের বাড়ীতে পড়িয়া ছিল। সংবাদ পাইয়া আমি দেখিতে যাই। আমার অনুরোধে উক্ত ভ্রাতৃদ্বয় স্তম্ভ দুইটি ঢাকা মিউজিয়মে
উপহার প্রদান করেন।
স্তম্ভ দুইটি লম্বায় নয় ফুট পাঁচ ইঞ্চি, আকৃতিতে চতুষ্কোণ, নিম্নাংশে এক-একটি ধার এগার ইঞ্চি প্রশস্ত। স্তম্ভ দুইটির নিম্ন, মধ্য এবং শীর্ষ প্রদেশ নিপুণ কারুকার্য্য ও চিত্রাদি ভূষিত। স্তম্ভ
দুইটির চিত্র এই সঙ্গে দেওয়া গেল। নিম্নে পৃষ্ঠগুলির নিম্নাংশের কারুকার্য্যের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া গেল।
১ম স্তম্ভ ১ম
পৃষ্ঠ। দেবী খড়্গধারী অসুরের সহিত যুদ্ধ করিতেছেন। দেবীর হস্তেও হ্রস্ব একটি তরবারি।
ঐ, দ্বিতীয় পৃষ্ঠ। ঋষি ও মৃগের চিত্র।
ঐ, তৃতীয় পৃষ্ঠ। ভূমিতে পা গুটাইয়া বসা
একটি উটের চিত্র।
ঐ, চতুর্থ পৃষ্ঠ । ধনুঃশর ভূমিতে নিক্ষেপ করিয়া এক রাজকুমার হাতের উপর মাথা
রাখিয়া বিষণ্ণ ভঙ্গীতে একটি গাছের নীচে বসিয়া আছেন।
-
দ্বিতীয় চিত্রের
সহিত মিলাইয়া অর্থ করিলে, “মৃগী-আসক্ত ঋষিপুত্র হত্যা করিয় মগরাজা
পাণ্ডুর বিষণ্ণতা” বলিয়া এই চিত্ৰখানির ব্যাখ্যা করা যায়।
দ্বিতীয় স্তম্ভ, প্রথম পৃষ্ঠ। কৃত্তিমুখ নামে প্রসিদ্ধ
ভাস্কৰ্য্য চিহ্ন।
ঐ, দ্বিতীয় পৃষ্ঠ। অতিভঙ্গ ভঙ্গীতে নৃত্যপরায়ণা রমণী।
ঐ, তৃতীয় পৃষ্ঠ । ধনুঃশরধারিণী রমণীর পাখী-শিকারের দৃশ্য। সঙ্গে একটি কিশোরী।
উপরে দুইটি পাখী উড়িয়া যাইতেছে। ধনুর ছিলা পাখীর
দিকে এবং বাণ রমণীর নিজের দিকে স্থাপিত ব্যঙ্গচিত্র।
ঐ, চতুর্থ পৃষ্ঠ। লতাপাতা ।
একটি স্তম্ভ যে কৃত্তিমুখ চিহ্নাঙ্কিত, ইহা হইতেই বলা যায় যে, স্তম্ভ দুইটি প্রাক-মুসলমান যুগের। এগুলি ঐ আমলের দারু-তক্ষণ শিল্পের
উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এই সঙ্গে একটি বৃহৎ দ্বারের চৌকাঠের
উপরের কাষ্ঠখানির চিত্র দেওয়া গেল। ইহার উপরে পরস্পরে জড়ান দুইটি নাগের প্রতিমূৰ্ত্তি অঙ্কিত আছে। দিনাজপুর
(পৃ৬৫৭) জেলার বানগড়ে কষ্টিপাথরে নির্ম্মিত একটি
পূর্ণাঙ্গ নাগদ্বার আবিষ্কৃত
হয়। উহা অদ্যাপি দিনাজপুর রাজবাটীতে রক্ষিত আছে। আমাদের নাগদ্বার কাষ্ঠখানি নাটেশ্বর গ্রামের
দেউলের উত্তরস্থ একটি পুষ্করিণী হইতে মানচিত্রে-৩ চিহ্নিত স্থানে আবিষ্কৃত হইয়াছিল।
এই সঙ্গে যে একটি স্তম্ভশীর্ষের চিত্র দেওয়া হইল উহা
সোনারঙ্গ গ্রামের দেউলের নিম্নস্থ পুষ্করিণীতে, মানচিত্রে ৪ চিহ্নিত স্থানে পাওয়া
গিয়াছিল। উহাতে দেখা যায়, স্তম্ভদ্বয়ের অভ্যন্তরে ত্রিভঙ্গ
খিলানের নিম্নে যোগস্বামী বিষ্ণু যোগাসনে বসিয়া আছেন। এই স্তম্ভশীর্ষটি এত ভারী যে মনে হয় যেন কাঠ পাথর হইয়া গিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে কাঠ কাঠই আছে, পাথর হয় নাই। কিন্তু যে কাঠ হাজার বছর পরেও এমন দৃঢ়সত্ত্ব, তাই মূলে যে কত বড় বৃক্ষের সার ছিল ভাবিয়া বিস্মিত হইতে হয়।
সঙ্গীয়
গরুড়-মূৰ্ত্তিটি রঘুরামপুর গ্রামে রামপাল দীঘি হইতে অনতিদূরে একটি পুরাতন পুষ্করিণী খুঁড়িতে পাওয়া গিয়াছিল। পঞ্চসার গ্রাম-নিবাসী
শ্ৰীযুক্ত পরেশনাথ মহলানবীশ মহাশয় নিজ ব্যয়ে এই পুষ্করিণী খনন করান এবং উহা হইতে কয়েকটি প্রস্তর ও ধাতব মূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হয়। কাষ্ঠনিৰ্ম্মিত এই
গরুড়-মূৰ্ত্তিটিও এই খননেই পাওয়া গিয়াছিল। গরুড়ের মুখে বুদ্ধি ও আনন্দের দীপ্তি প্রকৃতই উপভোগ্য এবং শিল্পীর অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচায়ক।
মানচিত্রে ইহার প্রাপ্তিস্থান ৫-অঙ্কে চিহ্নিত করা গেল। কাষ্ঠনিৰ্ম্মিত বিষ্ণুমূৰ্ত্তির যে একখানি ছবি
দেওয়া গেল, ঐ মূৰ্ত্তি ত্রিপুরা জেলার মুরাদনগর থানায় কৃষ্ণপুর নামক গ্রামে প্রাপ্ত।
মূর্তিটি কৃত্তিমুখসমন্বিত এবং সেন-যুগের বিষ্ণুমূর্ত্তিগুলির অনুরূপ।
দারু-ভাস্কর্যের একটি সুন্দর নিদর্শন বিক্রমপুরস্থ আড়িয়ল
পল্পীমণ্ডলের মিউজিয়মেও সংগৃহীত হইয়াছে।
No comments:
Post a Comment