গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর
এবং সেগুলির প্রধান
মুঘল প্রশাসনের
গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলি ছিল
১। দেওয়ানের
নেতৃত্বে খাজাঞ্চি(এক্সচেকার) আর রাজস্ব
২। ইম্পিরিয়াল হাউসহোল্ড,
প্রধান খানইসামান
৩। বক্সী পদাধিকার
বলে সেনা খাজাঞ্চি এবং হিসাব দপ্তরের প্রধান
৪। ধর্মীয় আইন,
দেওয়ানি এবং ফৌজদারি, প্রধান কাজি
৫। ধর্মীয় দান এবং
বিভিন্ন দানকর্ম, প্রধান সদর
৬। সেন্সরশিপ অব
পাবলিক মরাল, প্রধান মুস্তাসিব
এগুলোর থেকে অধস্তন,
কিন্তু র্যাঙ্কিংএ এগুলির সমান
৭। তোপখানা – প্রধান
মীর আতিশ আর দারোগাইতোপখানা
৮। গোয়েন্দা এবং ডাক
বিভাগ প্রধান ডাকচৌকির দারোগা
উজির
মুঘল সাম্রাজ্যে
উজির(উজির শব্দটা এসেছে পারসি বিচির(সংস্কৃত বিচার – খালিফদের সময় স্বরাষ্ট্র
সচিবের পদের নাম ছিল কাতিব বা লেখক। কিন্তু আব্বাসিদ সাম্রাজ্য পারসিক প্রশাসন
ব্যবস্থা ধার করে প্রথম এই পদের নাম দিল উজির। আস্তে আস্তে উজির নিজের কাজের পরিধি
বাড়াতে শুরু করলেন – ক্রমশ তিনি খাজাঞ্চিখানার প্রধান হয়ে উঠতে থাকেন, সম্রাটকে
কারা কি আবেদন করবেন তা তিনি নির্ধারণ করতেন। অটোমান তুর্কদের সময় কখোনো সাত জন
উজিরের পদ দেখা যায়। ইসলামিক শব্দকোষে বলছে, ‘প্রশাসক হিসেবে পরের দিকে উজির উচ্চ
শ্রেণীর আমলা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।’ দক্ষিণাত্যের সুলতানি সাম্রাজ্যে, উচ্চপদের
আমলা(যেমন শাহজী ভোঁসলে বা আবিসিনিয় জাঞ্জিরার য়াকুত খান)দের নাম ছিল উজির। কিন্তু
এটা উত্তর ভারতের জন্য নয়) থেকে, যার অর্থ বিচার দেওয়া। আজকের প্রধানমন্ত্রী পদের সমতুল। এটা একটা
হরিফিক উপাধি, যার মানে নির্দিষ্ট কোন দপ্তরের দায়িত্বে থাকা আমলা। তিনি রাজস্ব
দপ্তরের প্রধান ছিলেন। কিন্তু এই কাজটা তিনি করতেন দেওয়ান হিসেবে। সব দেওয়ান কিন্তু
উজির হতেন না। মুঘল সাম্রাজ্য কোন হিন্দু দেওয়ানকে উজির উপাধি দেওয়া হয় নি। আকবরের
সময় প্রধানমন্ত্রী উকিল পদে বৃত হতেন, আর অর্থমন্ত্রী হতেন উজির; আর ছিল
দেওয়ানিকুল এবং জায়গিরের দেওয়ান, বুউতাতের দেওয়ান এবং দানখয়রাতের জন্য
দেওয়ান(সূত্র আইনিআকবরি)।
শুরুতে, উজির ছিলেন
রাজস্ব দপ্তরের উচ্চতম পদাধিকারী, ফলে বাস্তবিকভাবে বিভিন্ন দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ
তাঁর হাতে চলে আসে। যখন সম্রাট শিশু, অক্ষম বা ভোগবিলাসী – সে সময় উজির
সেনাপ্রধানের কাজ করতেন। উজির পদের এই ইতিহাসে আমরা বুঝলাম এই পদটা অসামরিক এবং
তিনি যদি সেনা প্রধান হন, তাহলে তা বোঝা যাবে হয় সাম্রাজ্য পতনউন্মুখ বা
সাম্রাজ্যে কোন অস্বাভাবিক অবস্থা চলছে। অবশ্য মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যান্য
উচ্চপদস্থ আমলাদের মত উজিরও একটা ছোট সেনাদলের দায়িত্বে ছিলেন, কোথাও কোথাও লড়াইও
করতেন। কিন্তু যেহেতু তিনি সারাক্ষণ সম্রাটের কাছাকাছি থাকতেন, সম্রাটেরা তাকে
সেনার দায়িত্ব দিতেন না, সেনাবাহিনী থেকে তাকে দূরেই রাখতেন।
উজিরের দপ্তর দেশের
সমস্ত রাজস্ব আদায়ের নথিপত্র, হিসাব এবং সুব থেকে পাঠানো ডেস্প্যাচেস এবং সেনার
নথিপত্র পেত। বিভিন্ন উতসবে তিনি সম্রাটের প্রতিনিধি হয়ে উপস্থিত থাকতেন। সম্রাটের
নির্দেশে তিনি নিজের বয়ানে অনুমত্যনুসারে(হাসবুলহুকুম) বসিয়ে চিঠি লিখতে পারতেন। আগের
বরাদ্দের কিছু ছোট পরিমান অর্থ বরাদ্দ ব্যতীত, সব ধরণের ফর্মানে দেওয়ানের
হস্তাক্ষর থাকতে হত। রণক্ষেত্রে সেনা আর কারখানার কারিগর ছাড়া সব ধরণের পেমেন্ট
তাঁর দপ্তর মার্ফতই হত। সম্রাটের সঙ্গে নিয়মিত আলাপ আলোচনা করে, নির্দেশ নিয়ে,
রাজস্ব দপ্তরের খাজাঞ্চিখানার অবস্থা বুঝে রাজস্ব আদায়ের সব প্রশ্ন, পদ্ধতি ঠিক
করতেন দেওয়ান। মুঘল আমলে বিখ্যাত উজিরেরা পারসিক শায়েরিতে চোস্ত ছিলেন, এবং বিদেশে
পাঠানো নানান ধরণের চিঠিপত্র সম্রাটের হয়ে মুসাবিদা করতেন এঁরাই।
বক্সী, খাজাঞ্চীখানা
প্রধান
মুঘল প্রশাসনের
প্রত্যেক প্রশাসকই কিছু সংখ্যক ঘোড়ার অধিকারী মনসবদার হতেন। প্রত্যেকেই একই ধরণের
উপাধি পাওয়ার একটা মানে করাযায় যে হিসেবের এবং বেতন দেওয়ার সুবিধের জন্য। এর মানে
এই নয় যে তাকে বাস্তবিক কিছু সংখ্যক ঘোড়া মেন্টেন করতে হত। তাত্বিকভাবে প্রত্যেক
অসামরিক প্রশাসক সেনা দপ্তরের অধীন ছিলেন, ফলে তাঁর মাইনে হিসেব করা এবং তা পাস
করতেন সেনা দপ্তরের প্রধান খাজাঞ্চি, যার পদের নাম বক্সী। সাম্রাজের বহর বাড়ার
সঙ্গে সঙ্গে বক্সীদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। ঔরঙ্গজেবের শেষ সময়ে একজন প্রধান
বক্সী ছিলেন যার পদের নাম মীর বক্সী, জনগনের ভাষায় প্রথম বক্সী, তাঁকে সাহায্যের
জন্য ছিল তিনজন ছিলেন, যাদের পদের আগে দ্বিতীয় তৃতীয় আর চতুর্থ উপসর্গ বসত।
মুঘল সাম্রাজ্যের
যুদ্ধের জন্য প্রত্যেক সেনা বাহিনীর প্রধান হতেন সেই সময়ের জন্য একজন রাজ পরিবারের
সঙ্গে জুড়ে থাকা ব্যক্তি(যদি পাওয়া যেত), সাধারণত যুবরাজ, এবং তিনি যদি নাবালক
হতেন, তাহলে তাকে সাহায্যের জন্য থাকতেন একজন সাদাচুলো নোবেল। তবে আমরা বহু সময়
দেখেছি, সিপাহশালার নামে সেনাধ্যক্ষ নিয়ুক্ত হতেন। এটা সম্মান্সূচক উপাধি, এর
সঙ্গে বাস্তবিক বিশাল মুঘল সেনাপতি হওয়ার কোন যোগ ছিল না। সম্রাট ছিলেন একমাত্র
সেনাপ্রধান।
আর্টিলারি বিভাগটির
দায়িত্বে ছিলেন একজন সেনানায়ক, মীর আতিশ, জনগণের ভাষায় দারোগাইতোপখানা। শুধু
আর্টিলারি সেনাই নয় মাস্কেটিয়ার্সও তাঁর অধীনে থাকত। ইওরোপের তুর্করা মুঘল
সাম্রাজ্যের থেকে যুদ্ধবিদ্যায় অনেক এগিয়ে ছিল, তাই বহু সময়ে মীর আতিশ পদটিতে
তুর্কি সেনা বাহিনী এমন কি পারসিক বাহিনী থেকে উপযুক্ত সেনা খোঁজা হত।
মোটামুটি বলা যায়
ভারতীয় মুসলমানেরা অদ্ভুতভাবে আর্টিলিয়ারি ব্যবস্থাপনায় অসীম অদক্ষ ছিলেন। এই
বাহিনী তুর্ক এবং ফিরিঙ্গি কামান এবং বন্দুকবাজ যোদ্ধায় পরিপূর্ণ ছিল। মাস্কেটিয়ার্সদের নেওয়া হত বুন্দেলা,
বাহেলিয়ার মত হিন্দু সমাজ থেকে এমনকি বক্সারের অধিবাসীদেরও নেওয়া হত সেনায়। প্রত্যেক সুবার সেনাবাহিনীতে আর্টিলারি প্রধান থাকতেন।
আমি এখানে
সেনাবাহিনী নিয়ে খুব কিছু বলব না, কেননা এই বিষয়টি উইলিয়ম আর্ভিন বিশদে লিখে গিয়েছেন
আর্মি অব দ্য ইন্ডিয়ান মুঘলসএ।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment