পলাশী উত্তর সময়ে উপনিবেশ তার লুঠ, খুন, গণহত্যা, অত্যাচার, অনাচার, অভিচার, অরাজক অবস্থা ঢাকার জন্যে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে এক সময়ের বিশ্বকেন্দ্র এশিয়া, তার কেন্দ্র উপমহাদেশ, উপমহাদেশের প্রধানতম উর্বর এলাকা বাংলা ভূখণ্ডের স্বচ্ছলতার জন্যে দায়ি সামাজিক কাঠামোগুলো ভাঙতে পরিকল্পিত মিথ্যা তত্ত্ব তথ্য ছড়ানো শুরু করে। নবাবি আমলের ঐতিহাসিকদের দিয়ে প্রায় অসত্য ইতিহাস লিখিয়ে বাংলা দখলের উপযোগিতা প্রমান করে।
শশাঙ্ক, পাল, সেন, সুলতানি, মুঘল এবং নবাবি আমলে বাংলা ভূখণ্ড ধারাবাহিক বিশ্ব বাণিজ্য প্রচেষ্টায় অসীম উচ্চতায় উঠেছিল। রাজা, পাদশা, সুলতান, নবাবেরা সুপ্রাচীন এশিয় সামাজিক রীতিনীতি মেনে সামাজিক কারিগর উৎপাদন ব্যবস্থাকে শুধু জোরদারই করেন নি, একই সঙ্গে কারিগর, চাষী এবং অন্যান্য সেবাদায়ীদের যতটা পারা যায় সামাজিক সুরক্ষা দিয়েছিলেন। তারাই ছিলেন চাষী আর কারিগরদের শেষ পালক।সারা বিশ্বের বণিকেরা ছুটে আসতেন বাংগালায় ঘাঁটি গেড়ে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে।
বাংলায় শুধু অসামান্য কারিগরই ছিলেন না দুর্দান্ত কৃষকও ছিলেন। দুরন্ত কৃষকেরা বাংলার বিপুল অকৃষি কারিগরদেরই মুখে নিরন্তর অন্ন জোগান নি, তাঁরা উপমহাদেশের কৃষি ঘাটতি এলাকা এবং মহাদেশের নানান দেশে খাবার রপ্তানি করেছেন নিয়মিত। প্রাকৃতিক সামরিক দুর্যোগে কৃষকদের বিনা সুদে হয়ত বা নামমাত্র সুদে তাকাভি নামক ঋণ দেওয়া হত। কৃষক কারিগরের ওপর যে কোন রকম অত্যাচার শক্ত হাতে দমন করা হত নবাব/পাদশার নির্দেশে। মুর্শিদকুলির দরবারে জমিদারেরা ভয়ে থাকতেন যদি তার এলাকায় প্রজাদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ আসে।অভিযোগ তৎক্ষণাৎ বিচার করে প্রমান হলে জমিদারদের বৈকুণ্ঠ দেখানোর ব্যবস্থা থাকত।
তো ক্ষমতায় আসার এক দশক পেরোনোর পরেই বাংলা-বিহারে বিপুল গণহত্যা নামিয়ে আনে কোম্পানি সরকার। মানুষের দুখ লাঞ্ছনা দুরছাই করে সেই বছরইগুলিতেই সব থেকে বেশি রাজস্ব আদায় করে। ব্যবসা দখল, কৃষক কারিগর উচ্ছেদ, এলাকায় এলাকায় শাসন কাঠামোর অবলুপ্তি ঘটতে থাকে। ভদ্রবিত্তরা লুঠ-অত্যাচারের শরিক হয়ে দেশিয় জ্ঞান তুলে দিতে থাকে ব্রিটিশদের, যাতে তাদের লুঠকর্মটা সঠিকভাবে সমাধা হয়।
এই সামগ্রিক গোলোযোগের অবস্থা চাপা দিতে উপনিবেশ আর তার বন্ধুরা ব্রিটিশ সুশাসনের ঢাক পেটানোর সঙ্গে পলাশীপূর্ব অসত্য অরাজক অবস্থার কথা কম্বুকণ্ঠে বলতে থাকে। আড়াই শতকের মিথ্যা ছড়ানোর এই ঔপনিবেশিক প্রচারে অনেকের সঙ্গে দুই প্রকৃত শাসক সিরাজ আর আওরঙ্গজেবের গায়ে যথেষ্ট কালি ছেটানোর কাজ করেন প্রখ্যাত প্রথিতযশারা। ব্রিটিশপূর্ব সময়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না এবং ধর্মীয় ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে মুসলমান শাসকেরা(নানান লব্জের মধ্যে শাসকদের জাত বিচারের লব্জটাও উপনিবেশের দান, যদিও পশ্চিমিরা নিজেদের খ্রিষ্ট শাসক কোনও দিনই বলে নি) হিন্দুদের ওপর অমেয় অত্যাচার করেছে, বেশ কয়েক হাজার মন্দির ধ্বংস করেছে ইত্যাদি রটনা রটিয়েছে যতটা সম্ভব।
আওরঙ্গজেবের কথিত ধর্মান্ধতা এবং তার সময়ের নানান বিষয়ের পাদশার তথাকথিত অপারগতা নিয়ে যদুনাথ সরকারের অসাধারণ কিছু পথভাঙ্গা কাজের(যেমন মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন) মধ্যে দগদগে ঘায়ের মত দাঁড়িয়ে আছে আওরঙ্গজেব সম্বন্ধে অমেয় অনৃত তথ্য। বঙ্গ-পাঞ্জাব ভাগের বহু আগে থেকেই এই আরোপিত ইতিহাস স্বচ্ছল, পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিপুল প্রভাব ফেলেছে। এর ধাক্কা আজও গোটা উপমহাদেশীয় দেশগুলি সামলাতে সামলাতে নাজেহাল।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, নিখিলনাথ রায়, ইত্যাদিরা আরোপিত ইতিহাসের কুয়াশা সরিয়ে সত্যের যে লড়াই লড়েছিলেন, সে কাজ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন রিচার্ড ঈটন এবং খুব সম্প্রতি অড্রে ট্রুস্কে এবং সুশীল চৌধুরী মশাই। ট্রুস্কে অসামান্য দক্ষতায় যেভাবে ঘৃণিত আওরঙ্গজেবের দোষ গুণ এবং তার সময়ের রাজনৈতিক ভাবনায় প্রণোদিত পাদশা হিসেবে মানবিক বিচার করেছেন, সে প্রচেষ্টা দুর্লভ। সাম্প্রতিককালে রাজীব কিনরা রাইটিং সেলফ রাইটিং এম্পায়ার বইতে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত তিনজন গুরুত্বপূর্ণ পাদশার সঙ্গে কাজ করা মুন্সি চন্দর ভান ব্রাহ্মণের জীবন এবং সেই সঙ্গে মুঘল শুলইকুল(সবার জন্যে শান্তি) নীতি নিয়ে বিশদে অসাধারণ আলোচনা করেছেন।
যুবা প্রকাশক আত্মজা পাবলিশার্সএর Arunava, অড্রের এই বইটার অনুবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অসম্ভব ব্যতিক্রমী। আবেগতাড়িত হয়ে বইটা অনুবাদ করেছিলাম এই আশায়, যে ভদ্ররা এতদিন মিথ্যেগুলিকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন, তাদের রাজত্ব অন্তত এই বাংলায় গিয়েছে এবং যে সপম্প্রীতির পরিবেশ এই রাজ্যে গড়ে উঠেছে, তাতে এই বই প্রকাশ একমাত্র বাংলাতেই ঘটতে পারে। তবুও মনে আশংকা ছিল, যে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সূত্র অবলম্বন করে একদল যেভাবে বিদ্বেষের প্রদাহ সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে, সেই পরিবেশে কোন প্রকাশক এই অনুবাদটি প্রকাশ করতে উৎসাহী আদৌ হবেন কি না। আশংকা মিথ্যে প্রমান করে অকুতোভয় অরুণাভ এই বইটা প্রকাশ করতে যে সব ঝামেলা সামলেছে, তা অনন্য সাধারণ উদাহরণ হয়ে থাকবে বাংলা প্রকাশনা জগতে।
আওরঙ্গজেবের মিথ-মিথ্যে ভাঙ্গার এই উপনিবেশবিরোধী প্রচেষ্টায় বন্ধুরা স্বাগত।
No comments:
Post a Comment