এ প্রসঙ্গে এও মনে রাখা দরকার তাঁতির রোজগারের শতাংশ নির্ভর করে কি ধরণের কাপড় এবং সেই কাপড় বানাতে কি ধরণের প্রযুক্তু ব্যবহার হচ্ছে তার ওপর। ১৭৫৬ সালে কাশিমবাজারে বিভিন্ন ধরণের তাফেতার উৎপাদন খরচ আমরা ৬.৬ তালিকায় লিখেছি।
এই তালিকা থেকে জানতে পারছি আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ তথ্য, সেটি হল তাঁতির মোট ব্যায়ের শতাংশের তুলনায় রোজগারের পরিমান, কোনও ভাবেই প্রকৃত রোজগারের সঙ্গে তুলনীয় নয় – বিভিন্ন রঙের তাফেতা থেকে তার রোজগার ৯.৬ থেকে ১৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারত, যদিও প্রতি পিসে তার সাম্মানিক (remuneration) একই থাকত ১ টাকা ৪ আনা। এটা চিরসত্য নয় যে মধ্য অষ্টাদশ শতকের তুলনায় অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে কোন তাঁতি রেশমের তাফেতা বুনে কম রোজগার করবে আর একজন তাঁতি মোটা সুতোর গুরা বুনে তুলনামূলকভাবে বেশি রোজগার করবে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, মাসে বা বছরে একজন তাঁতি কোন কাপড় কতগুলো বুনছে এটা জানলে আমরা তার মাসে/বছরের রোজগার কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারি। অষ্টাদশ শতকে এই ধরণের কোন তথ্য আমাদেরে হাতে নেই। ফলে আমরা যে সময় নিয়ে আলোচনা করছি, সেই সময়ে একজন তাঁতির রোজগার কি ছিল এটা আন্দাজ করা খুবই কঠিন।
একইভাবে তাঁত শিল্পের সঙ্গে জুড়ে থাকা অন্যান্য কারিগর কত রোজগার করে, সে হিসেব আমরা শুধুই আন্দাজ করতে পারি মাত্র। এর আগে আমরা দেখেছি সমাজের প্রায় প্রত্যেক স্তর থেকে আসা সুতো কাটনি/কাটনারা যদিও পুরোসময়ে কাজ করতেন না, আংশিক সময়েই তুলো কেটে সুতো বানাতেন, তাঁত শিল্পে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন। আমরা দেখেছি পুর্ণ সময়ের সুতো কাটনি তাঁত শিল্পে এক্কেবারেই অজানা ছিল না, আমরা যে সময়ের কথা আলোচনা করছি, সেই সময়েও। তবুও বলা দরকার চাষী-কৃষক এবং তাঁতি পরিবারে কাটনা ছিল মোটামুটি আংশিক সময়ের মহিলা শ্রম, দক্ষতা নির্ভর কারিগরি। কিন্তু এটাও বলা যাক অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে ভালতম সুতো কাটনারা কিন্তু পূর্ণ সময়ের কারিগর ছিলেন এবং তারা তাদের বাড়ির কাজ সহায়ক (servants) দিয়ে করাতেন(N.K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. I, p. 184)। জন টেলরের হিসেবে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে ঢাকার দক্ষ কাটনারা দৈনিক তিন ঘন্টা কাজ করে মাসে ১২ থেকে ১৪ আনা পর্যন্ত রোজগার করতেন(টেলরের সমীক্ষা থেকে এই অঙ্কটা পাওয়া গিয়েছে, Home, Misc., vol. 456F., ff. 131)। ১৭৯০ সালের এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে দক্ষতম এবং উদ্যমী মহিলারা মাসে ৩টাকাও রোজগার করছেন(Proceedings of the Board of Trade, 2 July to 31 Aug. 1790, quoted in N.K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. I, p. 184)। যতদূর সম্ভব এই মহিলারা পূর্ণ সময় ধরে কাজ করতেন। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে এই ধরণের দক্ষতম কাটনারা তাঁতিদের থেকে অগ্রিম বরাত পেতেন (Fact. Records, Kasimbazar, vol. 16, 23 April 1751; Home Misc., 456 F, f. 153)। এই তথ্য যদি সত্য হয় তাহলে এই ধরণের দক্ষ কাটনি অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে প্রায় এই পরিমান বা হয়ত এর থেকে বেশি অর্থ রোজগার করতেন, যখন বাংলার মসলিন আর দামি ক্যালকোর মত মত সূক্ষ্ম বস্ত্রের চাহিদা আরও অনেক বেশি ছিল।
এখানে বলা দরকার কাটনার রোজগার তার দক্ষতা অনুসারী এবং কি ধরণের সুতো সে কাটছে তার ওপর নির্ভরশীল। আমরা অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে হিসেব করেছি যে, যে সব মহিলা মাঝারি এবং সূক্ষ্ম মসলিনের সুতো কাটতেন সারা সময়ের জন্যে তারা মাসে ২টাকা আর যারা মোটা কাপড়ের সুতো কাটতেন তারা ১২-১৪ আনা রোজগার করতেন(N.K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 'I, p. 184)। এই তথ্য থেকে আমরা অষ্টাদশ শতকের প্রথমের দিকের কাটনাদের রোজগারের অঙ্কটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি, অন্তত অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের রোজগারের তুলনায় বেশ বেশিই হওয়া উচিত। ড্যানিশ সূত্র থেকে ধোবির খরচের হিসেব পাচ্ছি ২০ পিস গুরা ধুয়ে সে ২টাকা রোজগার করত(Ole Felbaeck, 'Cloth Production in Bengal', BPP, vol. XXXVI, p. 132)। কশিদা কারিগর, রিফু কারিগর ইত্যাদিরা মূলত চুক্তি কারিগর হিসেবে কাজ করতেন ফলে এদের রোজগারের হিসেব করা অসাধ্যকর্ম।
No comments:
Post a Comment