দাদনি অগ্রিম
ব্যবস্থা কিন্তু ষোড়শ সপ্তদশ শতকের ইওরোপিয় verlaggsystem ব্যবস্থার থেকে
বেশ আলাদা। ইওরোপের পুটিং আউট ব্যবস্থায় কারিগরকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল দেওয়া হত এবং
তাদের শ্রমের অগ্রিম হিসেবে হাতে নগদ অর্থ দেওয়া হত। বাংলার দাদন ব্যবস্থার প্রায়
সব কটা উদাহরণে আমরা দেখেছি তাঁতিদের অগ্রিম দাদন দেওয়া হয়েছে। কাঁচামাল অগ্রিম
হিসেবে দেওয়া হয়েছে, এমন উদাহরণ খুবই ব্যতিক্রমী এবং হাতেগোণা, নেই বললেই চলে।
টেলরের ঢাকাস্থিত কারখানার উদাহরণে দেখেছি রাজকীয় কারখানাতেও তাঁতিরা সুতো নিজেরা
নিয়ে আসতেন। কিন্তু ইওরোপে উৎপাদনের প্রায় প্রত্যেক স্তরে যে পণ্য উতপাদিত হত তার
মালিকানা সম্পূর্ণভাবে পুঁজিবিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীর। কিন্তু বাংলায় উৎপাদন
ব্যবস্থায় কারিগর বা উতপাদকের পণ্যের ওপর মালিকানা আর অধিকার স্বাধীনতা অনেক বেশি
ছিল। যতক্ষণনা কারিগর তার পণ্য ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দিচ্ছেন প্রথাগতভাবে পণ্যের
মালিকানা কারিগরের, যেহেতু উৎপাদনের কাঁচামাল তিনিই জোগাড় করেন। যদিও পণ্যের দাম
নির্ধারণ করার শেষ কথা কারিগর ছিলেন না। এছাড়াও যে ব্যবসায়ী বা মধ্যস্থ কারিগরকে
অগ্রিম দিতেন তিনি সর্বপ্রথম সেই পণ্যের দাবিদার ছিলেন। তবে কারিগর যদি ধারে ডুবে
থাকে তাহলে কারিগরের এই দুর্বলতাকে কাজ লাগাতে পারে মধ্য্যস্থ/ব্যবসায়ী। তবে ম্যাক্সওয়েবারের
লব্জতে তাঁতি কখোনোই শ্রমিকে(wage-earner) পরিণত হয় না( Max Weber, General
Economic History, pp.
99-101)(দক্ষিণ
ভারতের তাঁতি আর ইওরোপিয় তাঁতির তুলনামূলক রোজগার বিশ্লেষণ করেছেন প্রসন্নন
পার্থসারথী জর্জিও রিয়োলো আর তীর্থঙ্কর রায় সম্পাদিত হাউ ইন্ডিয়া ক্লোদ দ্য
ওয়ার্লড – দ্য ওয়ার্ল্ড অব সাউথ এশিয়ান টেক্সটাইলস ১৫০০-১৮৫০ বইতে তার প্রবন্ধে)।
উপনিবেশপূর্ব সময়ে তার উতপাদনের নানান যন্ত্রপাতি যেমন তাঁত, তার উৎপাদনের
কাঁচামাল সুতো নিজেই জোগাড় করতেন, এবং তাত্ত্বিকভাবে তিনি তার উতপাদিত পণ্যের
মালিক ছিলেন। যারা বলছেন this was
no more than an
illusion of ownership, এই যুক্তিটা সম্পূর্ণ সত্য নয়( A.I. Chicherov, Economic
Development. pp.
167',
175)। দাদনি ব্যবস্থার অর্থের হস্তান্তর আদতে অনেকটা কারিগরের উতপাদনকে বিক্রির
ব্যবস্থা করা, যে ব্যবস্থায় কারিগর তার অনেকটা স্বাধীনতা বজায় রাকজতে পারত। আমরা
খুব বেশি হলে বলতে পারি ব্যবসায়ীর পুঁজি কিছুটা হলেও কারিগরের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম
করত, তার উৎপাদন কর্মের ওপর নয়(At most,
the system promoted the control of
merchant capital over the producer , and not the process of production itself)। ১৭৫৭র
পরে বাংলার তাঁতিরা কোম্পানির শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হল এবং কোম্পানির শ্রমিক বনে
গেল এবং যে উৎপাদন হত, তার ওপর তাঁতির আর বিন্দুমাত্রও নিয়ন্ত্রণ থাকল না(N.K. Sinha, Economic
History of Bengal, vol. I, pp. 157-60; Hameeaa Hossain, Company
}Veavers, pp.
108-39;
D.B. Mitra, Cotton Weavers, pp. 79-87.)।
উৎপাদন ব্যবস্থার একক
সময়ের সাথে সাথে বাংলার
পরম্পরার উৎপাদন ব্যবস্থা মোটামুটি একই থেকে গিয়েছে এই আশ্বাসন খুবই সন্দেহ জাগায়,
যদিও উৎপাদন সঙ্গঠনের খুব বেশি পরতিবর্তন সাধিত হয় নি( K.N-. Chaudhuri, Trading
World, p.
260,
·262)। পরম্পরার উৎপাদন ব্যবস্থার মৌল একক কিন্তু তাঁতি আজও আছেন, যিনি
স্বনির্ভরভাবে তার পরিবার নিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থার এককে কায়েম হয়ে থাকেন। যে বাড়িতে
তিনি এবং তার পরিবার থাকেন সেটি এবং যে তাঁতে তিনি কাপড় বোনেন সেটিও তার নিজস্ব।
পরিবার যেহেতু তার সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, তার বাড়িটিই একটি কারখানা
বিশেষ। মধ্য অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এই পরম্পরার ব্যবস্থা কায়েম ছিল। ওর্মে যখন লিখছেন
বাংলায় এমন কোন গ্রাম পাওয়া যেত না যে গ্রামে পুরুষ, মহিলা বা শিশু তাঁত বোনার
সঙ্গে যুক্ত ছিল না, সেটা সত্যিইই একসময় সত্যি ছিল( Orme, Historical
Fragments, p. 409)। পরিবারের মধ্যে শ্রম বিভাজন ছিল – তাঁতি তাঁত বুনতেন,
তাঁতির স্ত্রী সুতোকাটা ইত্যাদি কাজ করতেন, বাকি কাজ শিশু সন্তানেরা সারত(এবং
বয়স্কদের কাজে সহায়তা করতে করতে কাজ শিখত - অনুবাদক)। এছাড়াও স্থানীয় সাপ্তাহিক
হাট থেকে তাঁতিরা অনেক সময় সুতো কিনে আনতেন তার কাজ এবং জীবনযাপনের খরচের উদ্বৃত্ত
পয়সা দিয়ে। উনবিংশ শতকের প্রথম পাদে তাঁতির তাঁতের চারচালা তৈরি, তাঁত এবং
অন্যান্য উপাদানের স্থায়ী খরচ ছিল ২০ টাকার আশেপাশে( Buchanan
Hamilton, Dinajpur, p. 246 quoted in Hameeda Hoss;iin,
Company Weavers, p. 61)। খুবই সহজ প্রযুক্তি এবং ন্যুনতম স্থির আর চলতি বিনিয়োগের
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটা উৎপাদন এককের চরিত্র ছিল minimal contentration of labour and
capital।
No comments:
Post a Comment