৬.১ বাংলার তুলনামূলক সুবিধেগুলি
ভারতের অন্যান্য বস্ত্র উৎপাদন শিল্প কেন্দ্রগুলির তুলনায় বাংলার কিছু
তুলনামূলক বিশেষ সুবিধা ছিল এবং সেই সুবিধাগুলি এখানে তুলে দেওয়ার গেল ১)
বিপুলাকার দক্ষতম কারিগর, ২) উতপাদনে অবাককরা কম খরচ, ৩) শস্তা এবং নানান ধরণের
পণ্যপরিবহনের সুযোগ বিশেষ করে নদীজাল এবং শেষমেশ ৪) অসম্ভব বিকশিত কৃষির জন্যে
দৈনন্দিনের পণ্য যেমন চাল, সুতো, রেশম তন্তুও ব্যাপক শস্তায় মিলত। গুজরাট, করমণ্ডল
এবং পাঞ্জাবের মত বস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রের মত বাংলাও সুগঠিত আঞ্চলিক এবং এশিয়
ব্যবসার সুযোগের কেন্দ্রে আর এশিয়ার নানান প্রান্তের উদ্যমী ব্যবসায়ীদের সাহায্য
আর স্থানীয়ভাবে এই ব্যবসা আর উৎপাদন ব্যবস্থা চালাবার জন্যে প্রভূত তুলো আর রেশমের
মত কাঁচামালও উৎপাদন হত। কিন্তু এরই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার ওপরে অন্যান্য
কেন্দ্রের তুলনায় বাংলার নিজস্ব যে সব তুলনামূলক সুবিধের তালিকা দিলাম, সেই জন্যে
বাংলার বস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে শয়ে শয়ে বছর ধরে এবং আমরা যে বিশেষ সময় নিয়ে
আলোচনা করছি, সে সময়ে গুরুত্বপূর্ণতম কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হত।
বস্ত্র উৎপাদন বেশ জটিল ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তি বিশেষ এবং এতে অন্যান্য
কারিগরির মতই বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন প্রচুর কারিগর প্রয়োজন পড়ে। তুলো বা তুঁত গাছ,
সুতো কাটা বা রেশমের গুটি ছাড়ানো, warping, তাঁতে warpকে শক্তভাব বজায় রাখা এবং শেষ পর্যন্ত বোনা এবং কাপড় ধোয়া আর
তার মধ্যের ছোটখাট বিভিন্ন স্তরে যে সব কারিগর প্রয়োজন হয় যেমন চাষী, সুতোকাটনি,
লাটায়ে সুতো গোটানো, তাঁতি, কাপড় ধোয়ার কারিগর এই সবের প্রচুর বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন
কারিগর ছিল বাংলায় যারা এইসব অন্তর্বর্তীকালীন কাজ করে একখানি পরিধেয় তৈরি করত। ঢাকার
প্রখ্যাত মসলিন বা কাশিমবাজারের রেশম-বস্ত্র ছিল বিশ্বের সেরা বস্ত্রগুলির মধ্যে
অগ্রনী এবং যে দক্ষ কারিগরি এই কাজ করত, সেই দক্ষতা জ্ঞান আর প্রজ্ঞা বংশপরম্পরার
চারিয়ে যেত কোন প্রথাগত বিদ্যে ছাড়াই। বাংলার তাঁতিরা যে সাধারণতম প্রযুক্তি আর
হাতিয়ার আর চরমতম দক্ষতা অবলম্বন করে যে সূক্ষ্মতম বস্ত্র তৈরি করত সেই দেখে
বিস্মিত হয়ে ওর্মে লিখলেন, ... the tools which they use are as simple and plain
as they can be imagined to be. The rigid clumsy
fingers of, an European would scarcely
be able to make a piece of canvas with the instruments
which are all that an· Indian employs in making a piece
ofcambric(Orme,
Historical
Fragments, p.
413)।
বাংলায় দক্ষ কারিগর পাওয়ার কোন সমস্যা ছিল না, বরং প্রয়োজনের তুলনায় অনেক
বেশিই ছিল কারণ মনে রাখতে হবে তাঁতশিল্প মূলত গ্রামীন তাঁতি বাড়িভিত্তিক শিল্প, যে
উৎপাদন ব্যবস্থায় তাঁতির সারা পরিবার তাদের দক্ষতা প্রয়োগ করে। সুতোকাটনি বা
রেশমের গুটি থেকে তন্তু বার করার কাজটার প্রায় পুরোটাই মহিলাদের একচেটিয়া
দক্ষতানির্ভর ছিল যারা তাদের বংশপরম্পরার জ্ঞান আর দক্ষতা দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে করে
উঠত। চাষী আর কৃষক বহু সময়েই তাঁতের কাজ করত এবং সময়ে সময়ে প্রয়োজনে এবং অবস্থা
বৈগুণ্যে এক পেশা থেকে অন্য পেশায় অনাযাস দক্ষতায় চলে যেতে পারত। প্রচুর দক্ষ
কারিগরের সঙ্গে খাদ্যপণ্যের প্রাচুর্য কারিগরি, তাঁতের মত জটিলতম উৎপাদন
ব্যবস্থাকে শস্তাতম করে রেখেছিল। একইসঙ্গে দৈনন্দিনের ব্যবহার্য পণ্য শস্তা ছিল
কারণ কৃষিক্ষেত্রে উচ্চতমউতপাদনশীলতা। বাংলা যে সত্যিকারের শস্তার দেশ ছিল এ নিয়ে
তর্ক করার কোন মানে হয় না কারণ তৎকালে প্রভূত বিদেশি মুসাফির আর পর্যবেক্ষকদের লেখায়
এ নিয়ে ভুরি ভুরি তথ্য লেখা হয়েছে(এবিষয়ে মন্তব্যের জন্যে দেখুন S. Chaudhuri, Trade
and Commercial Organization, pp. 4-5, 241-46)।
No comments:
Post a Comment