{এটা কয়েকটা কিস্তির ধারাবাহিক - এবারে ছয় নম্বর কিস্তি। Somnath Roy, Rouhin Banerjee চেয়েছিলেন এই ধরণের লেখা। এবং যারা মনে করছেন এই উৎপাদন ব্যবস্থা সম্বন্ধে জানা দরকার তাদের জন্য।
বনেদিয়ানার ঢঙেই বলি, এটা তাত্ত্বিক তাথ্যিক লেখা হবে। সবার জন্য নয়। সুখপাঠ্য তো নয়ই। দাবিটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক। বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার ছাপ অনপনেয়ভাবেই পড়েছে। যাদের এই রাজনৈতিক বক্তব্য অস্বস্তির এবং এই বিশাল লেখাটি ঝামেলাদার মনে হবে স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যেতে পারেন।
এর আগে কয়েকবার এই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম - কিন্তু সাঁটে। এবারে বিশদে প্রেক্ষাপট এবং তার ঐতিহাসিক ভূমিকা তৈরি করে দেওয়া গেল।}
এর আগে কয়েকবার এই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম - কিন্তু সাঁটে। এবারে বিশদে প্রেক্ষাপট এবং তার ঐতিহাসিক ভূমিকা তৈরি করে দেওয়া গেল।}
---
কিন্তু এর তুলনায় বাংলার পরম্পরার গ্রামীণ ছোট উদ্যোগীদের নিজস্ব জোরের জায়গাটি দেখি -
কিন্তু এর তুলনায় বাংলার পরম্পরার গ্রামীণ ছোট উদ্যোগীদের নিজস্ব জোরের জায়গাটি দেখি -
১। বৈশ্য শূদ্র মুসলমান এবং অন্যান্য গ্রামীন পরম্পরার উদ্যমীদের বিনিয়োগের পুঁজি খুব বড় সমস্যা নয় – সে তার জীবনে ১০ লক্ষ টাকা হয়ত রোজগারই করে না - অথচ সে তার নিজের কারখানার মালিক – সেটা তৈরি করতে সে ব্যাঙ্ক বা সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকে না। ফলে তাঁর উদ্যম পুঁজি নির্ভর নয় – ব্যাঙ্কের দরজা সে হয়ত তাঁর জীবনে একবারও মাড়ায় না, ফলে চাইলেও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা মার্ফত বড় পুঁজি তাকে দখল করতে পারে না। সে স্বাধীন। সে নিজের সমাজের সঙ্গে যুক্ত। তাকে রাষ্ট্র পুঁজি কেউই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে না।
২। কাঁচামাল সমস্যা নয়। শাঁখ, ধাতু আর তাঁতের সুতো(আমরা বাংলায় গ্রামে তুলো চাষ করেছি – ক্রমশঃ তাহলে সুতোর ওপরে তাঁতিদের নিয়ন্ত্রণ এসে যাবে। তাকে আর মিলের খারাপ সুতোর ওপরে নির্ভর করতে হবে না, এমন কী রঞ্জক পদার্থর জন্য মিলের ওপরেও নির্ভর করতে হবে না) ছাড়া কাঁচামাল সাধারণত উদ্যোগী তার গ্রামের আশেপাশ থেকেই সংগ্রহ করে।
৩। তাকে দক্ষতা সংগ্রহের জন্য আলাদা করে পাঠ নিতে হয় না। পরম্পরার ছোট উদ্যোগীদের মূল কাঠামো হল তার বংশপরম্পরায়/সামাজিকভাবে বয়ে যাওয়া সামাজিক দক্ষতা, যে দক্ষতা সে চারিয়ে দিয়ে যায় তার উত্তরপ্রজন্মের কাছে বা তার সমাজে।
৪। তার জোর বংশপরম্পরার বাপ-দাদার বা সামাজিক জ্ঞান। তার জ্ঞান সে হয় তার পরিবারের লোককে বা তার কর্মচারীকে দিয়ে যায় – ফলে সমাজে নিত্যনুতন দক্ষতা আর জ্ঞানে নতুন নতুন উদ্যোগী তৈরি হয়। এবং সেটা তাকে কিনতে হয় না।
৫। প্রযুক্তির জন্যও তাকে কাউকে পয়সা দিতে হয় না, যন্ত্র সারাই করতে তাকে এমন কিছুই খরচ করতে হয় না বা যন্ত্র খারাপ হলে দক্ষ যন্ত্রবিদের জন্য তাকে হাপিত্যেস করে বসে থাকতে হয় না – সে সারাইয়ের দক্ষতা তার নিজের না হয় গ্রামেই না হয় আশেপাশেই থাকে – নতুন প্রযুক্তি এলে পুরোনোকে ফেলে দিয়ে, তা সংগ্রহ করতে দৌড়োদৌড়ি করতে হয় না। নতুন প্রযুক্তি জোগাড় এবং কেনার জন্য বিনিয়োগ আর তা চালাবার জন্য শ্রমিক খুঁজতে হয় না। তার জোর বংশ পরম্পরার নিজস্ব সামাজিক প্রযুক্তি – এখনও জং না পড়া লোহা তৈরি করেন ডোকরা কামার – বড় রোলিংমিল নয়; আজও ভাল সুতো, শাড়ি, জামাকাপড় তৈরি হয় তাঁতে – কাপড় মিলে নয়; আজও সূক্ষ্ম শাঁখে কাজ হয় হাতে, যন্ত্রে নয়।
৬। আর বাজার সাধারণত তার নিজের, হাতের কাছের হাট, বাজার বা গঞ্জ, না হলে কাছের শহর।
৭। ছোট উতপাদকেদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার নিজস্ব উতপাদনের ইতিহাস, নিজস্ব প্রযুক্তির গর্ব, আর ঐতিহ্য যা বাংলার জ্ঞানচর্চা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে – একদা বাঙ্গালার বিশ্বপরিচিতির সঙ্গে জড়িয়ে।
৮। আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা এই উদ্যমে গ্রামের বা স্থানীয় শ্রমশক্তির নিয়োজন হয়। গ্রামের শ্রমিক আরও বেশি কাজ পায়। তাদের কাজ খুঁজতে গ্রামের বাইরে আর যেতে হয় না। আর বিনিয়োগের হারের তুলনায় গ্রামীন ছোট উদ্যোগে অনেক বেশি মানুষ নিয়োজিত হন, তাতে বেকার সমস্যার সমাধান হয়।
৯। আর যেহেতু তার উদ্যম বিদ্যুৎ নির্ভর নয় - নিরপেক্ষ, রাসায়নিক নির্ভর নয় মূলত প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে তাকে উৎপাদন করতে হয় তাই তাকে বড় পুঁজির উতপাদনের সঙ্গে লড়াই করতে হয় না, তার উৎপাদন অনেক বেশি দামে শহুরে বাজারে বিকোয় – তার রোজগার, রাজ্যের রোজগার আর গ্রামের স্বনির্ভরতা বাড়ে। গান্ধীজীর গ্রামস্বরাজের স্বপ্ন সাকার হয়।
১০। এরা কেউ রাজ্যসরকার বা কেন্দ্র সরকারের ভর্তুকি বা বিনিয়োগ পেতে উতসাহী নয়। ফলে এই উদ্যোগী তৈরি করতে সরকারের বিন্দুমাত্র অর্থ ব্যয় হয় না; বরং সরকারের সঙ্গে গ্রামে বসে উৎপাদন করা উদ্যোগী গ্রামন্নয়নের কাযে অংশিদার হয়। তাকে আর উতপাদনের জন্য শহরে আসতে হয় না।
১১। জ্ঞান প্রযুক্তির প্রজ্ঞা নিজের পরিবারে বা সমাজে থাকে তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে যায়। তাই দেশকে জ্ঞান আর প্রযুক্তি কেনার জন্য গাঁটের কড়ি বিনিয়োগ করে বড় পুঁজিকে উৎসাহিত করতে হয় না।
ফলে তাকে আলাদা করে যদি গ্রামীণ ছোট উতপাদকেদের উতসাহিত করা যায়, তাহলে যেমন গ্রামের টাকা গ্রামে থাকে, রাজ্যের টাকা রাজ্যে থাকে, তেমনি দক্ষ শ্রমিক রাজ্য ছেড়ে বিদেশে রোজগারের জন্য পাড়ি দেয় না।
ফলে এই মানুষদের উদ্যম কোনভাবেই এমএসএমই দপ্তরের অধীন হতে পারে না। যে দপ্তর ন্যুনতম দশ লাখ টাকা বিনিয়োগ করাকে তাঁর আধীনে থাকার উদ্যমীর চরিত্রভাবে, সেই এমএসএমই দপ্তরের অধীন গ্রাম পরম্পরার জ্ঞান, দক্ষতা, নিজের বাজার আর প্রযুক্তি নির্ভর উদ্যমীরা হতে পারে না। গ্রাম উদ্যমীরা স্বাধীন, তাঁরা পুঁজি নির্ভর নয়। তারাই ভারত – তাঁর ইন্ডিয়া নয়। তারাই গ্রাম ভারতের প্রতিনিধি। বাংলা, ভারতের গর্বের প্রতিনিধি। তাঁরা হস্ত শিল্পী নয়, তাঁরা গ্রাম উদ্যমী।
(ছয় নম্বর কিস্তি শেষ))
(ছয় নম্বর কিস্তি শেষ))
No comments:
Post a Comment