{এটা কয়েকটা কিস্তির ধারাবাহিক - এবারে সাততম ও শেষ কিস্তি। Somnath Roy, Rouhin Banerjee চেয়েছিলেন এই ধরণের লেখা। এবং যারা মনে করছেন এই উৎপাদন ব্যবস্থা সম্বন্ধে জানা দরকার তাদের জন্য।
বনেদিয়ানার ঢঙেই বলি, এটা তাত্ত্বিক তাথ্যিক লেখা হবে। সবার জন্য নয়। সুখপাঠ্য তো নয়ই। দাবিটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক। বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার ছাপ অনপনেয়ভাবেই পড়েছে। যাদের এই রাজনৈতিক বক্তব্য অস্বস্তির এবং এই বিশাল লেখাটি ঝামেলাদার মনে হবে স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যেতে পারেন।
এর আগে কয়েকবার এই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম - কিন্তু সাঁটে। এবারে বিশদে প্রেক্ষাপট এবং তার ঐতিহাসিক ভূমিকা তৈরি করে দেওয়া গেল।}
এর আগে কয়েকবার এই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম - কিন্তু সাঁটে। এবারে বিশদে প্রেক্ষাপট এবং তার ঐতিহাসিক ভূমিকা তৈরি করে দেওয়া গেল।}
---
শেষ কথা
আমরা যাকে হস্তশিল্প বা হ্যান্ডিক্র্যাফট বলছি সেই বলাটা কতটা সামাজিক, বাস্তবসম্মত সেটা ভাবা দরকার। এ বিষয়ে উইভার্স আর্টিজান এন্ড পারফর্মিং আর্টিস্টস গিল্ডের(ওয়াপাগ) একজন হয়ে কিছু কথা বলার অনুমতি চাইছি।
আমরা যাকে হস্তশিল্প বা হ্যান্ডিক্র্যাফট বলছি সেই বলাটা কতটা সামাজিক, বাস্তবসম্মত সেটা ভাবা দরকার। এ বিষয়ে উইভার্স আর্টিজান এন্ড পারফর্মিং আর্টিস্টস গিল্ডের(ওয়াপাগ) একজন হয়ে কিছু কথা বলার অনুমতি চাইছি।
১৮০০ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৭০টি শিল্প দ্রব্য(সোরা, লোহা পিণ্ড, দস্তা, জং ছাড়া ইস্পাত মণ্ড ইত্যাদি) আর ১০০টির বেশি কৃষি দ্রব্য(কাপড়, নীল, আফিম, চাল, নুন, মোম, সুপুরি, তামাক, ভোজ্যতেল, অন্যান্য বনজ দ্রব্য, পান, কাঠ, হাতি ইত্যাদি) প্রায় একচেটিয়া রপ্তানি করত বৃহত বাংলা - আজকের পোকায় কাটা বাংলা নয়, সে ছিল পূর্বের মায়ানমারের প্রান্ত থেকে পশ্চিমে উত্তরপ্রদেশের প্রান্ত, উত্তরে তিব্বতের সীমা থেকে দক্ষিণে ওডিসা পর্যন্ত অঞ্চল - কিন্তু এর পশ্চাদভূমি আরও বড় ছিল - পশ্চিমে রাজস্থান পর্যন্ত আর দক্ষিণ পশ্চিমে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত - তো ভারতে, এশিয়, আফ্রিকার বাজারে কয়েক হাজার বছর ধরে এই জিনিসগুলি সরবরাহ করেছে গ্রামের ছোট উতপাদকেরা, যাদের আমরা হস্তশিল্পী বলে আসছি উপনিবেশের অনুসরণে।
ঔপনিবেশিক বা বড় পুঁজির অর্থনীতিবিদেরা মনে করত, এবং আজও করে, গ্রামীন এই উতপাদকেরা প্রান্তিক, এরা উতপাদন না করলেও অর্থনীতির ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। এরা জাদুঘরের সামগ্রী, এরা যদি না বাঁচে তাহলেও খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। এই অর্থনীতি মৃত। এদের রাষ্ট্রীয় সহায়তার বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
এই ভাবনার বেলুনটির গ্যাস নির্গত হতে শুরু হয়েছিল বহু কাল – কিন্তু তাকে শেষ ধাক্কাটা দিয়ে গিয়েছে গিয়েছে ২০০৮-১১ সালের ইওরোপিয় বিষ। আমরা আজও মনে রাখি না যে বৈশ্য শূদ্র মুসলমান এবং অন্যান্য-গ্রামের বংশ পরম্পরার ছোট উদ্যোগীরা এখনও ভারতের অর্থনীতির ৮০%র অংশিদার, এখনও তারা বড় পুঁজির ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার বাইরে, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলে ২০০৮ সালের ইওরোপ আমেরিকার অর্থনীতির মন্থনে উদ্ভুত বিষ তাঁদের পেড়ে ফেলতে পারে নি। বরং গ্রামীন উতপাদকেদের স্থিতিশীল অর্থনীতি ভারতীয় অর্থনীতিকে বাঁচতে সাহায্য করেছিল। অথচ নাম কিনেছিল, ভেঙ্গে পড়তে পড়তে বেঁচে ওঠা রাষ্ট্রীয় বড় পুঁজির অর্থনীতি, পিঠ চাপড়ানি পেয়েছিল ব্যাংক ব্যবস্থার অর্থনীতির মৌলিক চলকগুলির (বেসিক ফান্ডামেন্টালস) ভিত্তিগুলি।
আমরা এখনও মনে করি, সেটাই বাস্তব, গ্রামের আর্থব্যবস্থার জোরে টিকে রয়েছে ভারতের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা - ব্যাংক ব্যবস্থা খুব বেশি হলে ১৫-১৭ শতাংশ মানুষকে জড়িয়ে নিয়েছে নিজের ব্যবস্থায় - উচ্চমধ্যবিত্তের বাইরে কত শতাংশ মধ্যবিত্তের জীবনের কতটা ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে তা কিন্তু গবেষণাযোগ্য; তার বাইরে রয়েছে বিশাল বিপুল গ্রামীন অর্থনীতি, যার পরিমাপ আমরা এঁকেছি আগেই - ১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি, ফলে এই অঙ্কে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কঙ্কালসার চেহারাটা উলঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়, বড় পুঁজির বাহ্বস্ফোটকে প্রকাশ্যে এনে ফেলে।
এবং সেই গ্রাম্য আর্থব্যবস্থার মূল ভারসাম্য বজায় রাখছে কৃষক আর গ্রামের শূদ্র বৈশ্য মুসলমান এবং অন্যান্য সমাজের বংশপরম্পরার উদ্যমীরা।
যদি আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে স্থিতিশীল বাংলা চাই, তাহলে শহরের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের অর্থিনীতির সবলীকরণ করার দিকে এগোতে হবে, শহরের অর্থ গ্রামে পৌঁছে দিতে হবে, গ্রামের অর্থনীতিকে আঘাত না করে তাকে জোরদার করতে হবে - যে কাজটা আজ বাংলা শুরু করেছে - আর আমরা করতে যাচ্ছি।
একটা প্রশ্ন উঠবে, যদি গ্রামীন অর্থনীতি এতই সবল হয়, তা হলে আমাদের এই অর্থিনীতিকে নতুন করে সবল করার দরকার কি?
আমাদের সহজ উত্তর, আমাদের জন্য, ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়ানো বিশ্বকে বাঁচাবার জন্য। আজ প্রমাণিত এই দুষণের রাজা, লুঠের সম্রাট শিল্পবিপ্লবীয় উতপাদন ব্যবস্থা বিশ্বকে ধ্বংস করার মুখোমুখি করে ফেলেছে - সেটা অনেকে বুঝলেও অন্তত ভদ্র মধ্যবিত্তর কিস্যু করার নেই - তারা এই লুঠেরা খুনি অত্যাচারী বড় পুঁজির উতপাদন বিতরণ ব্যবস্থার চালকের আসনে। দিনের পর দিন এই উতপাদন বিতরণ ব্যবস্থা বিশ্বকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। আমরা এই গ্রাম্য অর্থনীতির মৌলিক তত্ত্বগুলি আলোচনা করার মাধ্যমে, এই অর্থনীতিকে জোরদার করার মাধ্যমে, ধ্বংস হতে বসা মধ্যবিত্ত, এই অর্থনীতি আর সর্বোপরি এই বিশ্বকে বাঁচাতে চেষ্টা অন্তত করতে পারি।
উইভার্স আর্টিজান এন্ড পারফরমিং আর্টিস্টস গিল্ডের(ওয়াপাগ) পক্ষ থেকে বন্ধুদের বিনীত নিবেদন, যাদের জোরে আজকের ভারত/ইন্ডিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের হস্তশিল্পী না বলে গ্রামভিত্তিক ছোট পরম্পরার উতপাদক বলা চালু করি। অন্তত এই নবতম ভাষ্যটা চালু করার আমরা ভগীরথ হওয়ার সম্মান অর্জন করি।
(শেষ)
(শেষ)
No comments:
Post a Comment