Thursday, August 3, 2017

হস্তশিল্প তকমার ঔপনিবেশিক রাজনীতি - আমাদের বক্তব্য

গোটাটা রাজনৈতিক। লোক বা ফোকের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই।
বহরমপুরের এক শোলা কারিগরকে নিয়ে একটি লেখা বন্ধুদের দেওয়ালে দেওয়ালে ঘুরছে।
আমরা এই লেখাটিকে কি ভাবে দেখছি?
...সোমেনদা গতকাল এই লেখাটা দেখেছি। আমরা সংগঠন করি। অসুখী বিলাসে নেই। আমরা মনে করছি একে শিল্প(আর্ট) হিসেবে দেখেই সমস্যা হয়েছে এত দিন। আমরা এগুলিকে গ্রামীন পরম্পরার উৎপাদন হিসেবে দেখতে চাইছি। ঔপনিবেশিক হস্তশিল্প আভিধা মেরে দিয়ে ১৭৫৭র পর এই গ্রামীন পরম্পরার উতপাদকেদের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে দিয়েছিল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র - হয় আমার শর্তে তুমি বাঁচবে জাদুঘরের লোকশিল্পের সামগ্রী হয়ে নয়ত তোমার বাঁচার অধিকার নেই - আজও সেই নীতর বদল তো হয়ি নি - বরং দিন দিন আরও জাঁকিয়ে বসছে। কর্পোরেট জানে বাংলার গ্রামীন উৎপাদন তার থেকে অনেক বেশি পরিমানে উৎপাদন করে। তাই এগুলিকে মৃতপ্রায় বলে লোকশিল্প জাদুঘর তৈরি করা তাঁর রাজনৈতিক পথ। এটা কর্পোরেট আর রাষ্ট্রের হাতে রাজনৈতিক হাতিয়ার - গ্রামীন উতপাদনকে মৃতপ্রায় দেখানোর পথে কয়েকপা হাঁটা।
কিন্ত প্রশ্ন উঠতেই পারে গ্রামীন উতপাদনকে হস্তশিল্প বলা হল কেন? বিদ্যুৎ আর যন্ত্রশক্তিতে গর্বোদ্ধত ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র মনে করছে সামগ্রিকভাবে এই গ্রামীন উতপাদকেদের উৎপাদন রাষ্ট্রিয় শিল্প(ইন্ডাস্ট্রি) উৎপাদনের সংখ্যায় তারতম্য আনে না। সেই তাত্ত্বিকতায় ধোঁয়া দিল চাকুরিজিবী ঔপনিবেশিক ইওরোপমন্য ভদ্রলোকেরা। রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক প্রণোদনায় ভদ্রলোকেরা দায়িত্ব নিল গ্রামে গ্রামে গিয়ে এই ধরণের "শিল্প" খুঁজে আনতে এবং তাকে শহর ভিত্তি করে বাঁচাবার উপায় নির্ধারন করতে। ১৯২০-৩০ সালে কংগ্রেস এ ধরণের "মহান" দায়িত্ব পালন করেছে - সিউড়ি বোল বা সেরপাই সেগুলোর অন্যতম উদাহরণ। এই কারিগরেরাও ইংরেজি বুলিওয়ালা শিক্ষিত ভদ্রলোকেদের সঙ্গে কাথা বার্তা বলে নিশ্চিত হল তারা সংখ্যায় এতই অল্প যে সত্যি তারা বোধহয় রাষ্ট্রীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় নগণ্য।
কিন্তু সামগ্রিকভাবে কি তাই? সারা বাংলার ছোট পরম্পরার উদ্যোগীদের এক করলে উৎপাদনের পরিমান কোথায় দাঁড়ায়, যারা আমাদের লেখা এর আগে পড়েছেন তারা জানেন - তাও বলি এ বাংলার পরম্পরার গ্রামীন উৎপাদনের মোট অঙ্ক অন্তত ১ লক্ষ কোটি টাকা। তাই রাষ্ট্রের কাজ হল প্রত্যেককে আলাদা করে শিল্প তকমা লাগিয়ে দেওয়া যাতে সারা বাংলার গ্রামীন উৎপাদন এক না হতে পারে। পরস্পরের সঙ্গে সমস্যার সমাধানের পথ আদান প্রদান করতে না পারে।
এই যাদববাবু যে এই অর্থনীতির অংশ তাকে কেউ এর আগে বোঝান নি। এদের 'লুপ্তপ্রায়' লোকসংস্কৃতি বা লুপ্তপ্রায় হস্তশিল্প দাগিয়ে দেওয়া ভদ্রলোকিয় গবেষণায় ভদ্রলোক আর এনজিওদের প্রকল্প/চাকরি নিশ্চিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পলাশীর পরে যে বিশ্ব বাজার তারা হারিয়েছিল, দেশজ বাজার তারা হারিয়েছিল, পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপরার যায়গা তারা হারিয়েছিল তা ফিরে আসে নি, তারা যে সামগ্রিক গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থার অংশ সেটাও কেউ বোঝায় নি।
আর বাংলার গ্রামীণ উৎপাদনের চরিত্রটাই হল কারিগরের বংশপরম্পরার বা সামাজিক পরম্পরার বা গুরু পরম্পরার জ্ঞান, তাঁর দক্ষতা, তাঁর প্রযুক্তি, তাঁর বাড়ির পাশের কাঁচামাল, তাঁর নিজস্ব বাজার। তাঁর চরিত্রটাই হল ঘুরে ঘুরে বিক্রি করা, রাস্তার পাশে বিক্রি করা। এটাই আমার জোর। রাস্তার ধারে বসে আমি বিক্রি করতে পারি। সারা দেশ আমার বাজার। আমায় যদি কেউ দোকানে বসিয়ে দেন তাহলে আমি এক জায়গায় বসে গেলাম।
আমরা সাঙ্গঠনিকভাবে এই মানসিকতার বদল আনতে চাইছি। ওয়াপাগ সম্মেলন সেই দিশায় এক পা।
জয় বাংলা!

No comments: