Monday, August 21, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা ৫ শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার সমাজের উদ্যোগী(ওয়াপাগ)দের দাবি- এমএসএমই নয় আলাদা পারম্পরিক বিশ্ববাংলা মন্ত্রক চাই

{এটা কয়েকটা কিস্তির ধারাবাহিক - এবারে পঞ্চম কিস্তি। Somnath Roy, Rouhin Banerjee চেয়েছিলেন এই ধরণের লেখা। এবং যারা মনে করছেন এই উৎপাদন ব্যবস্থা সম্বন্ধে জানা দরকার তাদের জন্য।
বনেদিয়ানার ঢঙেই বলি, এটা তাত্ত্বিক তাথ্যিক লেখা হবে। সবার জন্য নয়। সুখপাঠ্য তো নয়ই। দাবিটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক। বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার ছাপ অনপনেয়ভাবেই পড়েছে। যাদের এই রাজনৈতিক বক্তব্য অস্বস্তির এবং এই বিশাল লেখাটি ঝামেলাদার মনে হবে স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যেতে পারেন।
এর আগে কয়েকবার এই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম - কিন্তু সাঁটে। এবারে বিশদে প্রেক্ষাপট এবং তার ঐতিহাসিক ভূমিকা তৈরি করে দেওয়া গেল।}
---
বিতর্কে ঢোকার আগে, আগেই যেটা বলেছি, সেটা নতুন করে বলে নেওয়া দরকার, এমএসএমই উদ্যোগীরা আমাদের ভাই। সেই উদ্যোগীদের সঙ্গে পরম্পরার গ্রামীন উদ্যোগের কোন বিরোধ নেই। কিন্তু দুটি উদ্যম আলাদা। তাদের মধ্যে শুধু উৎপাদন করা ছাড়া কোন কিছুতেই যে মিল নেই তা আমরা এবারে দেখাব।
ধারণা
• বাংলার বিপুল বৈশ্য শূদ্র মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার গ্রামীন উদ্যোগীদের সংগঠনের দাবি গ্রামীন পরম্পরারা ছোট উদ্যোগীদের মন্ত্রক তৈরি করা দরকার –নাম হোক পারম্পরিক বিশ্ববাংলা মন্ত্রক। এই পরম্পরার গ্রাম শিল্পের জোরেই ১৭৭০এর আগে বিশ্বে বাংলার কৃষিজ-বনজ দ্রব্য – নীল, আফিম, চাল, পান, সুপারি, মশলা, সুগন্ধি, মধু, চিনি, মোম, পাট, কাঠ, হাতি, গুড় ইত্যাদি; শিল্পজ পণ্য নুন, সোরা, লোহা, ইস্পাত, দস্তা, বস্ত্র(রেশম, সূতি), হাতির দাঁতের কাজ, পাথরের কাজ, কাঠের কাজ, চিত্র শিল্প, পাথ খোদাই, মোষের শিঙের কাজ, আসবাব, দামি পাথর ইত্যাদি একচেটিয়া বিশ্ব বাজারে একচেটিয়া বিক্রি হত।
• বাংলার বিশ্বে পরিচয় ছিল এই পণ্যগুলিতেই। সারা বিশ্ব বাংলাতে আসত এই পণ্যগুলি কেনার জন্য দুশ কুড়ি তিরিশ বছর আগে। পলাশির পরের অবর্ননীয় লুঠ, ছিয়াত্তরের গণহত্যা আর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পর্যন্ত বাংলার বৈশ্য শূদ্র মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার সমাজের উদ্যোক্তারাই বাঙলাকে উদ্বৃত্ত অর্থনীতি তৈরি করেছিল।
• পলাশীর এবং ভারত স্বাধীনতার পর পরিকল্পনা করে এই উদ্যমটিকে হতোদ্যম করে দেওয়া হয়েছে – যাতে বড়পুঁজির উতপাদনের বাড়বাড়ন্ত হয়। আজ বঙ্গ সরকার যখন নতুনভাবে উন্নয়নের পথ নজর করে এগোচ্ছে, তখন এই দিকে নজর দিয়ে নতুন মন্ত্রকটির নাম দেওয়া হোক পারম্পরিক বিশ্ববাংলা মন্ত্রক।
• তাতে গ্রামীন পরম্পরার উদ্যমীদের জন্য নতুন ধরণের নীতি নেওয়া যাবে, গ্রামের বেকার সমস্যার সমাধান হবে, রাজ্যের সম্পদ রাজ্যে থাকবে, শহরের টাকা গ্রামে যাবে, গ্রামের মানুষেরা আরও স্বচ্ছল হবেন – গ্রামের মানুষের হাতে টাকা এলে রাজ্যের রোজগার বাড়বে। মনে রাখতে হবে, এমএসএমই আর গ্রামীন পরম্পরার ছোট উদ্যোগের শর্ত আলাদা, তাদের ভাবনা আলাদা, কাজের দর্শন আলাদা।
এসএমএসই ক্ষেত্রের বাস্তবতা
ক। ন্যুনতম বিনিয়োগের শর্ত - সেবা ক্ষেত্রে ১০ লক্ষ টাকা, উতপাদনে ২৫ লক্ষ টাকা
খ। বিনিয়োগ খোঁজার সমস্যা - সাধারণত উদ্যোগীর নিজের বিনিয়োগে সাধারণত ব্যবসা শুরু করতে পারে না। ফলে প্রধানতম বিচার্য সেই ব্যবসা ব্যঙ্ক ঋণের উপয়োগী (ব্যাঙ্কেবল) কি না – সে বিনিয়োগ কোথায় পাবে এবং তা প্রক্রিয়া করে উৎপাদন তৈরি করবে। আদতে বড় পুঁজির ওপর নির্ভরশীল ছোট উদ্যমের বাঁচা মরা কিন্তু বড় পুঁজির আবহেই নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণত ব্যাঙ্ক যেহেতু বড় পুঁজিরই উদ্যম, সেহেতু বড় পুঁজির অনুসারী আদতে বড় পুঁজির ইচ্ছে অনিচ্ছের(কেউ কেউ বলেন অর্থনৈতিক আর ব্যবস্থাপনার তত্ত্ব – আদতে তা ইচ্ছেই – যাকে ব্যবস্থাপক আর অর্থনীতিবিদেরা তত্ত্বে রূপান্তরিত করেছেন) ওপরে নির্ভরশীল। আদতে তার অস্তিত্বের ওপর বড় পুঁজির অদৃশ্য হাত সবসময় ক্রিয়া করে। সে বিন্দুমাত্র স্বনির্ভর নয়।
গ। কাঁচামালের জন্য উদ্যমীকে নির্ভর করতে হয় বড় পুঁজির উতপাদনের বা ক্রিয়ার ওপর। কাঁচামালও সাধারণত তাকে জোগাড় করতে হত কিছু দিন পূর্বে রাষ্ট্রের দয়ায়(যারা আদতে পুঁজি নিয়ন্ত্রিত) আজ বড় পুঁজির দয়ায়।
ঘ। প্রযুক্তি তার নিজস্ব নয়। তাকে সেটা মূলত বড় পুঁজি জাত। সেটা তাকে কিনতে হয়। তার পিছনে প্রচুর সময় অর্থ পরিশ্রম ব্যয় হয়। আর নতুন প্রযুক্তি এলে তাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার বিনিয়োগ, শ্রমশক্তি তার জন্য ব্যয় করার পরিকল্পনা করতে হয়।
ঙ। ব্যবসার দক্ষতা সাধারণত উদ্যমীর থাকে না। তাকে হয় সেটা গাঁটের কড়ি ফেলে অর্জন করতে হয়, না হয় ভাড়া নিতে হয় কর্মীরূপে।
চ। গত দুদশকে কলকাতার আশেপাশের বড় পুঁজির শিল্পের আবনতির সঙ্গে অনুসারী শিল্পের হ্রাসের মধ্যে একটা তাত্ত্বিক সাজুজ্য রয়েছে – হাতে গোণা ব্যতিক্রম ছাড়া, এমএসএমই উদ্যম বড় পুঁজি শিল্পের অনুসারী। ফলে এলাকায় বড় পুঁজির শিল্পের উচ্চাবচতার সঙ্গে তাঁর ভাগ্য জড়িয়ে রয়েছে।
ছ। আর যদি যে স্বাধীন উতপাদক হয় – তাহলে তার উৎপন্নের বাজার খুঁজতে হয় নিজেকেই, লড়াই করতে হয় বাজারে থাকা বড় প্রতিযোগীর সঙ্গে, বাজারের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে থাকে না।
জ। তাকে যন্ত্র চালাতে সরাসরি নির্ভর করতে হয় বিদ্যুতের ওপর। তার দাম, তা পাওয়া, তার গুণমান সব নির্ভর করে বড় পুঁজির ইচ্ছের ওপর।
(পঞ্চম কিস্তি শেষ)

No comments: