পুনম বালা
বিংশ শতকের শুরুর দিকে ঘটনাক্রমের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটতে থাকে। চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক বিবাদ শুরু হয়। জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনে বিজ্ঞানের পুনর্জাগরণের ধারণার সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নবজাগরণের ধারণাটি জুড়ে গেল। ১৯১২ এবং ১৯১৯এর মধ্যে মেডিক্যাল রেজিস্ট্রেশন এক্ট চালু হওয়ায় বিরুদ্ধাচরণ করলেন দেশিয় চিকিৎসক গোষ্ঠী। এই সময়ে পশ্চিমি চিকিতসাবিদদের সঙ্গে দেশিয় চিকিতসকেদের বিবাদ প্রকাশ্যে এসে পড়ে। ১৯১৪ সালের বেঙ্গল মেডিক্যাল এক্ট বাংলায় একটি মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং চিকিতসকেদের নথিভূক্ত করার কাজ করে। এই ধরণের আইন বম্বে এবং মাদ্রাজে চালু হয়। দেশিয় চিকিৎসার ওপরে এই আইনটির প্রভাব এই ঘটনা ক্রমের প্রভাবে দেখা যেতে পারে-
পশ্চিমি চিকিৎসায় শিক্ষত মাদ্রাজের কৃষ্ণ স্বামী আইয়ার এবং পি পি বৈদ্যর নাম প্রাদেশিক নথিকরণের খাতা থেকে হঠিয়ে দেওয়া হয় ১৯১৫ সালে দেশিয় চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে। ড আইয়ারকে বলা হয় তিনি যদি নিজেকে ট্রিপলিকেনের কালাভালা কুন্নুম চেট্টিয়ার ফ্রি ডিস্পেনসারির প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে না নেন, তাহলে চিকিৎসক হিসেবে সরকারি নথি থেকে তার নাম কাটা যাবে। বম্বের একই হুমকি দেওয়া হয় ড বৈদ্যকে। তিনি তার পিতার পিতার স্মৃতিতে চলা একটি আয়ুর্বেদিক পোপট প্রভুরাম কলেজে যুক্ত ছিলেন।
আন্দোলনকারীরা এবং সংবাদপত্র এবং দেশিয় চিকিৎসকেরা কাউন্সিলের এই নীতিকে নিন্দা করেন। দৈনিক ভাষ্কর মিত্র লিখল মাদ্রাজ কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্ত প্রতিহিংসাপরায়ন এবং অসন্তোষজনক। সঞ্জীবনী এবং হিতবাদী বলল এই ঘটনা আতঙ্ককর এবং দেশিয় চিকিৎসা পদ্ধতির পক্ষে অপমানজনক।
চিকিৎসা বিদ্যালয়গুলি স্বীকৃতির মাধ্যমে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পশ্চিমি চিকিৎসা বিদ্যাকে স্বীকৃতি দিয়ে পশ্চিমি পদ্ধতিতে শিক্ষিত চিকিতসকেদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করতে শুরু করল। বাংলার প্রাদেশিক সরকার ১৯০৬ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুলকে স্বীকৃতি দিয়ে বলল সেই বিদ্যালয় থেকে কৃতকার্য হয়ে শংসাপত্র নিয়ে বেরোনো ছাত্ররা নথিভুক্ত হবে। ১৯১৬ সালের ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল(বোগাস ডিগ্রি) এক্টএর প্রভাবে এই ধরণের বেসরকারি বিদ্যালয়ে ছাত্রদের ভর্তি হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এই আইন অনুযায়ী ১৮৯৭-৯৮ সালে শুরু হওয়া বেলিগাছিয়ার কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স এন্ড সারজনসএর মত প্রত্যেকটি বেসরকারি কলেজের ডিপ্লোমা দেওয়া নিষিদ্ধ করে দিল। আইএমএসএর এক আধিকারিক রায় কালিদাস চন্দ্র বোসের তথ্য অনুযায়ী সে সময়ে কলকাতায় এরকম চারটি শিক্ষা কেন্দ্র ছিল, যারা সারা দেশের জন্য বিপুল সংখ্যক বোসের দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী হাতুড়ে(বোগাস) ডাক্তার তৈরি করত।
১৯১৬ সালে বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার আগে তার বিধিনিষেধগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কেউ কেউ৯ বিলে পশ্চিমি চিকিৎসার নিয়ন্ত্রণের ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই আইনে আয়ুর্বেদ, য়ুনানি, হোমিওপ্যাথিকেও যুক্ত করার জোরালো দাবি তুললেন। এমন কি উপনিবেশিক সরকারের মধ্যেও বিলের উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বিমত ছিল। সেখানে কেউ কেউ চিকিৎসার স্তরকে উচ্চে তুলতে পশ্চিমি চিকিৎসার সঙ্গে দেশিয় চিকিৎসা পদ্ধতির মিলন ঘটাতে চাইত আবার অন্যেরা দুটি পদ্ধতির স্বাতন্ত্রের পক্ষে ছিল।
১৯১৮-১৯ সালে মন্তেগু(সেক্রেটারি অব স্টেট) এবং চেমসফোর্ড(ভাইসরয়) উপনিবেশিক ভারতের রাষ্ট্র চরিত্রে এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত নীতিতে পরিবর্তন আনেন। প্রশাসনিক সংস্কারে সৃষ্টি হল দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ নীতি - স্থানীয় সরকারের হাতে কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলে দেওয়া হল এবং তার মাথায় রইল কেন্দ্রিয় সরকার। তারা বিষয়গুলি দুভাগে ভাগ করলেন - ট্রানসফার্ড এবং রিজার্ভড ক্ষেত্র। ট্রানসফার্ড ক্ষেত্রটির কয়েকটি বিষয় যেমন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং তাদের মনোনীত মন্ত্রীদের হাতে থাকবে। অন্যদিকে রিজার্ভড ক্ষেত্রটিতে রইল অর্থ, রাজস্ব, পুলিশ এবং অন্যান্য কিছু যা নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রিয় সরকার। যুদ্ধর সময়ে প্রশাসনিক সেবায় ভারতীয়দের ভুমিকা বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে চিকিৎসা জুড়ে গেল ট্রানসফার্ড বিষয়ে – চিকিৎসা সেবাতেও প্রচুর ভারতীয় প্রবেশ করতে লাগল। ১৯১২ সালের রয়্যাল কমিশন অব ইন্ডিয়ায় উপনিবেশের পূর্ত বিভাগে আরও বেশি ভারতীয়কে নেওয়ার সুপারিশ করে।৮১
গ। ১৯২০ থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত
মন্তেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার স্থিতি পেলে ভারতীয় মন্ত্রীরা পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগ পেলেন। দ্রুত ভারতীয়করণ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ এবং বিস্তারে মন্ত্রীদের হাতে বেশি বেশি ক্ষমতা আসায় যে পরিবর্তনটি ঘটল, তার ছোঁয়া লাগল চিকিৎসা ব্যবস্থায়। দেশজ মন্ত্রীরা হয়ত পশ্চিমি চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে দেশিয় চিকিতসা শিক্ষা ব্যবস্থা জুড়ে দিতে পারেন এই ভয়ে রেগুলেশন অব মেডিক্যাল স্টান্ডার্ড নিজেদের হাতে রাখল সরকার। চিকিৎসা শিক্ষার প্রমিতকরণের কাজে জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিল বা জিএমসির নিয়ন্ত্রণ থাকায় শিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে অত্যধিক ছাত্র প্রবেশে বাধা ঘটল। ব্রিটেনের ১৮৮৬ সালের মেডিক্যাল এক্টএ মেডিসিন এবং সার্জারিতে দাই এবং সার্জারিতে পরীক্ষার সুপারিশ ছিল। এর ফলে পাঠ্যের সময় বাড়ল এবং পরীক্ষা বিধি আরও কঠোর হল। ১৮৯২ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া ডিগ্রি জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিল স্বীকার করল।
প্রাথমিকভাবে জিএমসি ব্রিটেনের মত ভারত উপ্নিবেশে চিকিৎসা শিক্ষা কেন্দ্রগুলি পরিদর্শনের কাজ খুব একটা উৎসাহ দেখায় নি; তারা যে ছোট খাট পরিবর্তন প্রস্তাব করত সেগুলি সহজেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রূপায়ন করতে পারত। কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘ দিন চলল না। বাংলায় শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে চলার তথ্যের সুযোগ নিয়ে ১৯০৭ সালে জিএমসি দাইদের স্তর উন্নীত করতে তাদের শিক্ষার প্রস্তাব দিল।
ভারতীয় হাসপাতালগুলিতে জিএমসির পরিদর্শনের প্রতিবেদনে দাইদের প্রশিক্ষণের অভাবকে চিহ্নিত করা হল। কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জিএমসি প্রশাসকদের বিরোধ বাধল।
১৯২২ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া চিকিৎসা ডিগ্রির ওপরে কোন রকম নিষেধাজ্ঞা জিএমসি জারি করে নি। ১৯২৪ সালে আর এ নিডহ্যামের পরিদর্শন-সমীক্ষা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া কোন ডিগ্রিকে বাতিল না করার সিদ্ধান্ত নেয় জিএমসি। ইন্সপেক্টর জেনারেল অব মেডিক্যাল এডুকেশন, নিডহ্যামকে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ডিগ্রির যোগ্যতা অর্জনের শেষতম পরীক্ষাটি বিষয়ে মন্তব্য করতে বলা হয়। ১৯২২ এবং ১৯২৩এর দাইদের পরীক্ষা নিডহ্যামএর আনুকূল্য অর্জন করে নি। ১৯২৪এর পরীক্ষাতেও একই ঘটনা ঘটলে নিডহ্যাম লিখলেন, গর্ভপাত(লেবার) বিষয়ে ছাত্রদের যথেষ্ট শিক্ষায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ৮৪
১৯২৪ সালের নিডহ্যামের সমীক্ষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝড় তুলল। বিশ্ববিদ্যালয় নিডহ্যামকে তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষণ করতে দিতে অস্বীকার করে এই যুক্তিতে যে তারা ছাত্রদের মেডিসিন, সার্জারি এবং মিডওয়াইফারিতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিচ্ছে এবং তাদের ছাত্রদের অর্জিত দক্ষতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সন্তুষ্ট। ১৯২৪এর পর থেকে জিএমসি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা সংক্রান্ত ডিগ্রিকে মান্যতা দিতে অস্বীকার করে। ১৯২৭ সালের জুলাইতে জিএমসি নতুন করে এই বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া করে এবং ইন্সপেক্টর জেনারেল অব মেডিক্যাল কোয়ালিফিকেশনসকে নির্দেশ দেয় নতুন করে সমগ্র বিষয়টি নিরীক্ষণ এবং সমীক্ষা করতে। এর এক বছর পরে জিএমসি ভারতে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া তৈরির প্রস্তাব দেয়। কেন্দ্রিয় সরকার এমসিআই তৈরির প্রস্তাব নিয়ে খুব স্বচ্ছন্দ ছিল না, এবং প্রাদেশিক সরকারগুলি কেন্দ্রকে জানাল যে এই প্রস্তাবে কেন্দ্রিয় কাউন্সিল প্রাদেশিক স্বাধীনতার ওপর অবাঞ্ছিত আঘাত হানছে। প্রাদেশিক স্বাস্থ্য মন্ত্রীদের একটি সম্মেলনে এই দৃষ্টিভঙ্গী উঠে এল৮৫। এই বিতর্কে জিএমসি ১৯৩০ সাল থেকে ভারতীয় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা শিক্ষা সংক্রান্ত ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষমতা বাতিল করে এই যুক্তিতে যে, হাতে একটা ডিগ্রি থাকা মানেই চিকিৎসকের চিকিৎসার ন্যুনতম জ্ঞান থাকার প্রমানপত্র নয়।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment