পুনম বালা
বহুকাল ধরে ভারতের দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা বিদেশি নতুন চিকিৎসাব্যবস্থাকে পাশাপাশি নিয়ে চলেছে। যেমন ইসলামের আগ্রাসনে এ দেশে য়ুনানি চিকিৎসাবিদ্যা ভারতে আসে এবং আয়ুর্বেদের সঙ্গে সে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে থাকে এবং য়ুনানি কিছুটা আয়ুর্বেদকে আত্তীকরণ করে নেয়। ভারতে পশ্চিমি চিকিতসাবিদ্যার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। বহু বছর অস্বস্তিকরভাবে পাশাপাশি কোন দ্বন্দ্ব ছাড়াই বসবাস করে গিয়েছে এই দুই চিকিৎসাবিদ্যা। এই পাশাপাশি চলায় ভেদ এল উনবিংশ শতকের শেষের দিকে, যখন লেসলির ভাষায় সর্বগুণান্বিত(ইকলেকটিক) চিকিৎসাবিদ্যা থেকে সংখ্যায় বাড়তে থাকা হাতুড়েদের বার করে দেওয়ার চাপ আসতে শুরু করল শিক্ষিত চিকিতসকেদের থেকে। ভারতের ‘যোগ্যতাসম্পন্ন’ চিকিৎসকেরা এই ধরণের ‘হাতুড়ে’ চিকিতসকেদের চিকিৎসা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি জানাল। অন্যভাষায় বললে, তারা পেশায় পেশাদারি নিয়ন্ত্রণের বিস্তৃতি বাড়াবার পক্ষে দাঁড়ালেন। দেশিয় চিকিৎসকেরা এই দাবিকে দেখলেন তাদের পেশার ওপর আঘাত হিসেবে। দুটি ব্যবস্থার চিকিতসকেরাই তাদের পেশায় চিকিতসকেদের অবাধ প্রবেশের বিরুদ্ধে ছিলেন। নতুন করে দুটি ব্যবস্থার মিটমাটের উদ্যমও নেওয়া হয়েছিল।
১৯২০ সাল নাগাদ ভারতে চিকিতসা ক্ষেত্রে পশ্চিমি মডেল নির্ভর হয়ে পেশাদারিত্ব রূপ পেতে থাকে। রাষ্ট্র চিকিতসকেদের ধর্মপিতা(স্পনসর) বা পৃষ্ঠপোষক হওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তা বাস্তবে রূপ পায় নি। ভারতে যখন ভারতীয় চিকিৎসকেরা তাদের পেশাকে পেশাদারিত্বে রূপান্তরিত করতে চাইলেন, তখন পশ্চিমি চিকিতকেরা দেখলেন তারা চিকিতসায় অলিগোপলি ব্যবস্থার শিকার হয়েছেন। ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা শিক্ষা এবং তার প্রবেশিকা পরীক্ষা, বা নতুন ধরণের চিকিৎসা শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি, বিস্তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র অধিকারী হল সরকার। জেফরির ভাষায় এটি অপেশাদারিত্বের চূড়ান্ত, যেখানে পশ্চিমি চিকৎসকেরা তাদের স্বাধীনতা, সরকারি-বেসরকারি চাকরির সুযোগ হারিয়ে রাজনৈতিক হস্ত্যক্ষেপে ভালনারেবল হয়ে পড়লেন, যদিও তাদের ক্ষমতা এবং সামাজিক সম্মান কিছুটা হলেও বজায় রইল১৯।
যে নীতি আর ব্যবস্থায় ব্রিটেনে চিকিতসকেদের পেশাদারিত্বের বিকাশ ঘটেছে, ঠিক সেই নীতিতেই ভারতে ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটল। ব্রিটেনে পেশাদারিত্বের বিকাশ ঘটেছে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং একচেটিয়া ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বৈধতায়। ভারতীয় অবস্থায় চিকিতসকেদের নিয়ন্ত্রণ বিফল হল কেননা ভারতে তাদের প্রতিযোগিতায় ফেলার মত প্রতিদ্বন্দ্বী চিকিৎসাব্যবস্থার চিকিৎসকেরা ছিলেন বহু পরিমানে। ফলে সামাজিকভাবে সব চিকিৎসকের চিকিৎসা করার সামগ্রিক বা আংশিক নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের পক্ষে প্রয়োগ করা সম্ভব হল না।
কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য সংগঠনেতে আইএমএস(ব্রিটেনের চিকিতসক আধিকারিকদের সংগঠন)এর স্তরের অধস্তন চাকরিতে চিকিতসকেদের চাকরি পাওয়ার অধিকার নিজেদের হাতে রেখেছিল। এই চাকরিগুলিতে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের জন্য পেশাদারদের ওপরে নৈতিক কিছু শর্ত আরেপ করতে থাকে, যাকে হাতিয়ার করে ভারত উপনিবেশ চিকিতসকেদের চিকিৎসাকে নিয়ন্ত্রণ করার দিকে এগোতে থাকে। এই কাজে সহায়ক হলেন ব্রিটেন থেকে ভারত সাম্রাজ্যে কাজ করতে আসা আমলারা। জনসন বলছেন, (ভারতে)ব্রিটিশ পেশাদারদের সঙ্গে উপনিবেশে চিকিৎসা শিক্ষার সুযোগ খুঁজে পেশাদার হতে চাওয়া কিছু মানুষ জুটে গেলেন২০।
ব্রিটেনে যে ধরণের চিকিৎসক নিয়োগ নীতি এবং বিধান ঠিক হয়েছিল ভারত উপনিবেশ ঠিক সেই ধরণের নীতিমালা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করতে লাগল। দক্ষতার মাপকাঠি হল নথিভুক্তকরণ। দুর্ভাগ্যক্রমে ব্রিটেনে যেভাবে চিকিতসকেদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণা সফল হয়েছে, ভারতে সেটি ঘটল না। ব্রিটেনে ব্যক্তিগত পসার নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ঠিক উলটো কাণ্ড ঘটল ভারতে - চিকিৎসকেরা সরকারি চাকর হলেন।
পরের আলোচনায় আমি দেখাতে চেষ্টা করব, ঔপনিবেশিক উনবিংশ এবং বিংশ শতকের ভারতে চিকিতসকেদের পেশাদারিত্বের দিকে নিয়ে যাবার রাষ্ট্রীয় উদ্যম বিফল হয়েছিল দুটি কারণে, প্রাথমিকভাবে বহু ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু ছিল সেই সময় এবং একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক সরকারের চরিত্রও বদল ঘটছিল দ্রুত।
ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের চরিত্র এবং চিকিৎসা নীতি পরিবর্তনের ইতিহাসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় -
ক। ১৮৬০এর আগের সময়
খ। ১৮৬০ থেকে ১৯২০
গ। ১৯২০ থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত
ক। অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ কাছারির(কোর্ট) সঙ্গে ভারতের অন্যান্য এলাকার নীতির কোন পার্থক্য ছিল না। তাদের কাছারিতে নিজেদের দেশের চিকিৎসকই ছিলেন না, বরং কিছু ব্রিটিশ চিকিৎসক নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতের লক্ষ্যে মুঘল রাজদরবারে চাকরি গ্রহন করেন২১। ব্রিটিশ রাষ্ট্র ছিল ব্যবসায়িক, প্রশাসনিক এবং সামরিক বাহিনীর সমাবেশ মাত্র২২।
এনএমআইএর বিলয় এবং পশ্চিমি পদ্ধতিতে চিকিৎসাবিদ্যা পড়ানোর উদ্দেশ্যে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের গোড়াপত্তনে পরস্পরের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এগোনোর যে চেষ্টা এর আগে চলছিল দুই চিকিৎসা ব্যবস্থার, সেটির শেকড় উপড়ে পড়ল। ১৪ থেকে ২০ বছর বয়স্ক ৫০ জন ছাত্র নিয়ে কলেজের যাত্রা শুরু। ছাত্রদের ভাগ করা জল জলপানির অঙ্কের তারতম্যে। ইংরেজির সঙ্গে বাংলা এবং হিন্দুস্তানি ভাষায় দখল, শিক্ষা অর্জনের আবশ্যিক দক্ষতা হিসেবে গণ্য করা হত। ৫০ জনের মধ্যে অধিকাংশ হিন্দু কলেজের ছাত্র(যদিও সংখ্যা জানা যায় না), যাদের উন্মুক্ত(মানে পশ্চিম প্রভাবিত) পাঠ্যক্রমে চিকিতসা একতা বিষয় ছিল।
১ জুন ১৮৩৫ সালে প্রথম বক্তৃতা ছিল অস্থিবিদ্যা। এটি সপ্তাহে তিনবার ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পড়ানো হয়েছিল। শারীরবিদ্যা সেই বছরেই পড়ানো শুরু হয়। হিন্দুদের স্পর্শকাতরতার কথা চিন্তা করে শব ব্যবচ্ছেদ করা হত না।
১৮৩৬ সালে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে চারজন যুবা শবব্যবচ্ছেদ করার সিদ্ধান্তে২৬। কলেজের প্রায় সব অধ্যাপকের উপস্থিতিতে তারা সূক্ষ্ম, সঠিক এবং নির্দেশিতভাবে মৃতদেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্যবচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment