Monday, March 6, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৩১ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

বহু কবিরাজ বাংলার বাইরে হরিদ্বার, বেনারস এবং অন্যান্য শহরগুলিতে চিকিৎসা কেন্দ্র খুললেন। এই চিকিৎসকেরা দেশজ চিকিৎসাকে পুনর্জন্ম দেওয়ার ভগীরথ হলেন। কবিরাজ গঙ্গাধর রায়ের সমসাময়িক, পরম্পরার শ্রীখণ্ড বিদ্যালয়ের কবিরাজ চন্দ্রকিশোর সেন শস্তায় ওষুধ বিক্রির জন্য কলকাতায় একটি কেন্দ্র শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে এই কেন্দ্রটির সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে তিনি কলুটোলায় একটি ওষুধ তৈরির কারখানা খুললেন। আয়ুর্বেদের বৈজ্ঞানিক চরিত্র উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে তিনি শস্তায় প্রচুর পুস্তক রচনা করেন। এই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে উঠে এন এম সেন এন্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা নাম দিয়ে গঙ্গাধর রায় আরও বড় আকারে ওষুধ তৈরির কোম্পানি শুরু করেন। অন্যান্যরাও আয়ুর্বেদিয় ওষুধ বাণিজ্যিকরণের কাজে লেগে পড়েন। ১৯০১ সালের ঢাকার শক্তি ঔষধালয়ের অসামান্য সাফল্যের পর সাধনা ঔষধালয় এবং কল্পতরু আয়ুর্বেদিক ওয়ার্ক্সও বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়।

বাংলার দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থার ইতিহাসে বোঝা যাচ্ছিল ১৮৮০ সালেও দেশজ চিকিতসার কোম্পানিগুলি জোরদার ব্যবসা করছে। এর পাশাপাশি পশ্চিমি চিকিতসকেদেরও বাড়বাড়ন্ত হয়। শেষের দিকে ১৮৮৬ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুলে পশ্চিমি চিকিতসাবিদ্যার পাঠ দেওয়া শুরু করে। এইটি প্রথম ভারতীয়দের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি বিদ্যালয়। ১৯০৫ সালে বিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে তীব্র বিরোধ দেখা দেয়। এরা কারা এবং কি জন্য বিরোধ সে তথ্য আজ আর জানা যায় না। শুধু জানা যায় যে ব্যবস্থাপকেদের মধ্যে কয়েকজন আলাদা হয়ে গিয়ে ১৯০৭ সালে পৃথক একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সে সময় কলকাতায় তিনিটি বেসরকারি পশ্চিমি চিকিৎসা পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়ার বিদ্যালয় ছিল। এদের মধ্যে কিছু ছিল পয়সা ফেলে ডিপ্লোমা দেওয়ার কারবারি। এই ডিপ্লোমার সঙ্গে চিকিৎসার পাঠ্যসূচী অধ্যনের কোন যোগ ছিল না। এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমি চিকিৎসকেদের সংগঠন ক্যালকাটা মেডিক্যাল সোসাইটি কলকাতায় চিকিতসকেদের নথিকরণের প্রস্তাব দেয়। সরকার এই প্রস্তাব গ্রহন করতে অস্বীকার করে কেননা তারা জানত তাদের পক্ষে বৈদ্য আর হেকিমদের বিরুদ্ধতা সহ্য করা সম্ভব হবে না।

উনবিংশ শতকের শেষে চিকিৎসা প্রশাসনে দেশজ চিকিতসাবিদ্যার প্রতি বিরুদ্ধতা প্রকাশ্যে এসে গেল। আইএমএসএর চিকিতসকেরা তাদের চিকিতসাবিদ্যাকে একমাত্র বৈজ্ঞানিকভাবে বৈধরূপে দাবি করা শুরু করলেন। বাড়তে থাকা স্বীকৃত পশ্চিমি চিকিতসক স্নাতক জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ায় দেশজ চিকিতসকেদের ধারনা হল তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে গেল। ব্যবসায়িক এবং কৃষির সমৃদ্ধিতে দুই ধরণের চিকিতসকেদের হাতে সম্পদ জড়ো হতে শুরু করে।৬৬

ব্রিটিশ ভারতে দেশজ আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসাব্যবস্থার সমর্থক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি উনবিংশ শতকের শেষের সিকে য়ুনানিতেও জোয়ার লাগল। প্রখ্যাত য়ুনানি চিকিৎসক হেকিম আজমল খান(১৮৬৩-১৯২৮) য়ুনানি চিকিৎসা শিক্ষার এবং তার পাঠ্যক্রমের বিধিবদ্ধভাবে সংঘবদ্ধ করেন। হেকিম আজমল খানের মূল অবদান হল, য়ুনানি চিকিৎসা(যা অন্যভাবে য়ুনানি-টিব নামে পরিচিত) মুসলমান রাজনৈতিক অস্মিতার অন্যতম চিহ্নরূপে প্রতিষ্ঠা করা৬৮।

আবারও য়ুনানি চিকিতসাবিদ্যার পুনর্জাগরণের মডেল হল পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা। বাড়িতে বসে ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসা এবং শিক্ষার উদ্যমের বাইরে গিয়ে নির্দিষ্ট কর্মী এবং মাস মাইনে ভিত্তি করে বিধিবদ্ধ বিদ্যালয় স্থাপন করার চেষ্টা হল। য়ুনানি চিকিৎসা ব্যবস্থার সংস্কার অনেকটা আয়ুর্বেদিয় ব্যবস্থা সংস্কারের মত আন্দোলনের রূপ নিল। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় এইটি চরম রূপ গ্রহন করে।

দেশিয় চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর চরম আঘাত এল পশ্চিমি পদ্ধতিতে শিক্ষিত ব্রিটিশ এবং ভারতীয় চিকিৎসকেরা প্রাদেশিক ভিত্তিতে চিকিতসকেদের নথিকরণের দাবি জানালেন যাতে কোন আইনি বিবাদে, পেশাদারদের রোগ সারিয়ে তুলতে এবং অন্যান্য আইনি ঝঞ্ঝাটে দেশিয় চিকিৎসকেদের শংসাপত্রের আইনি বৈধতা না থাকে। ৬৮

১৯০৭ সালে চিকিতসকেদের পেশাদারিত্বের বিষয়টা নতুন করে উঠে এল সরকারের পক্ষে একমাত্র পশ্চিমি পদ্ধতিতে চিকিতসকেদের নথিবদ্ধ এবং স্বীকার করার উদ্যমের মধ্যে দিয়ে। সরকারি প্রস্তাবগুলি ছিল এই রকম –
ক। যাতে সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে প্রয়োজনে গুণমানযুক্ত যথেষ্ট চিকিৎসক পাওয়া যায়
খ। খুলে দেওয়ার অর্থ হল, বাংলা প্রাদেশিক সরকারের এই বিরাট প্রেসিডেন্সির প্রচুর হাসপাতালে বিশাল সংখ্যক হাউস ফিজিসিয়ান এবং হাউস সার্জেন দরকার হয়, প্রত্যেক বছর সব থেকে মেধাবি ছাত্রদের সেই সুযোগ দেওয়া হবে,
গ। ব্যক্তিগতভাবে চিকিতসকেদের নিজেদের উতসাহে শিক্ষাকেন্দ্রকে উৎসাহ না দিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি চিকিৎসা শিক্ষা কেন্দ্র স্বীকৃত বিদ্যালয়গুলিকেই স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। কলকাতা এবং বম্বেতে এই ধরণের পদক্ষেপ করা হয়েছে। ইত্যাদি...

শুধু পশ্চিমি পদ্ধতিতে শিক্ষিত চিকিতসকেদের জন্য নথিবদ্ধ করণের প্রক্রিয়া ধাক্কা খেল। এই বিষয়ে সরকারকে প্রচুর ঝামেলা সামলাতে হল, বিশেষ করে দেশের অধিকাংশ মানুষই দেশিয় চিকিতসকেদের চিকিৎসার সমর্থক। চিকিতসকেদের নথিকরণের প্রক্রিয়ায় বিরুদ্ধতা বাড়তে থাকল। সরকার সিদ্ধান্ত নিল, যতদিননা পশ্চিমি পদ্ধতিতে চিকিতকেরা গবেষণা এবং প্রভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠছেন, ততদিন নথিকরণের প্রক্রিয়া থমকে থাকবে। স্বাধীন চিকিতসকেদের পসার বাড়াতে প্রাদেশিক সরকার নিজস্ব নীতি গ্রহন করল। বাংলা সরকার লিখল, যখন কোন চিকিৎসক সরকারি সেবায় নিযুক্ত হন তখন তার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয় এবং সরকারের হয়ে কাজ করার দায় এবং সময় তার বহু সময় নিয়ে নেয়; ফলে প্রাথমিকভাবে সেই চিকিৎসক সরকারি চাকর তার পরে স্বাধীন চিকিতসক।৭২

ভারতে স্বাধীন চিকিৎসক তৈরি করা সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়ালে সে শুধু যে স্বাধীন চিকিতসকেদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল তাই নয়, সরকারি সেবার নীতিতে পরিবর্তন আনতে উদ্যমী হল। কিন্তু সরকারি সেবায় সংস্কারের পথে হাঁটা বিফল হল।
(চলবে)

No comments: