পুনম বালা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এবং ১৯১৯ সালের সংস্কারে আয়ুর্বেদের পুনর্জাগরণের মূল আন্দোলনটি দাঁড়িয়েছিল জাতিয়তাবাদী ধারার আন্দোলনের সাফল্যের ওপরে। পুনায় নতুন আয়ুর্বেদ কলেজের শুরুর সময়ের রাজনৈতিক ঘটনায় আমরা বুঝতে পারি যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যে কিভাবে পুনর্জাগরণ আন্দলন একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। বলা দরকার আয়ুর্বেদ কলেজগুলিতেও ছাত্র আন্দোলন লেগেই থাকত। অসহযোগ এবং আইনঅমান্য আন্দোলন ছাত্রদের ডাক দিল সব সরকারি বিদ্যালয় এবং বিদেশি পণ্য বর্জন করতে। এর উত্তরে ছাত্ররা সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বর্জন করে। পুনায় রাজনৈতিক নেতারা লোকমান্য তিলক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে সেখানে অন্যতম বিষয় হিসেবে আয়ুর্বেদের পাঠ্যক্রম শুরু করলেন। ১৯৩২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি কেড়ে নেওয়া হল এবং ১৯৩০-৩৪ সালের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে ছাত্রদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এর উত্তরে জাতীয়তাবাদীরা ১৯৩৩ সালে পুনায় আরও একটি আয়ুর্বেদ কলেজের গোড়াপত্তন করেন, যা স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রীয় মান্যতা পায়।
১৯২১ সালে বাংলায় অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গৌড়িয় সর্ববিদ্যায়তন একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ুর্বেদ পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এর পাশাপাশি আয়ুর্বেদিয় চিকিতসকেদের উতসাহে বেশ কিছু আরও কলেজ স্থাপিত হয়। প্রখ্যাত আয়ুর্বেদাচার্য কবিরাজ শ্যামাদাস এই কাজে প্রভূত সাহায্য করেন। ১৯২২ সালে কাশিমবাজারের মহারাজার অনুপ্রেরনায় এবং সাহায্যে গোবিন্দ সুন্দরী আয়ুর্বেদ কলেজ স্থাপন করেন কবিরাজ রমেশচন্দ্র মল্লিক, ১৯৩২ সালে বিশ্বনাথ আয়ুর্বেদিয় কলেজ স্থাপিত হয় যার উদ্দেশ্য ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আয়ুর্বেদের পুনর্জাগরণ এবং প্রায় সব বিষয়ে ছাত্রদের প্রশিক্ষিত করা।
প্রত্যেকটি শিক্ষাকেন্দ্রে আয়ুর্বেদের পাশাপাশি পশ্চিমি চিকিৎসা বিদ্যাও পড়ানো হয়েছে।
১৯১৬ সালের বাংলায় সংবাদপত্রের দাবি ছিল সরকারের উচিত দেশিয় পদ্ধতির চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উতসাহিত করা... এদেশের সরকারের দায় হল আয়ুর্বেদ এবং য়ুনানির পুনর্জাগরণ ঘটিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে আধুনিক নীতি অনুসরণ করে গবেষণায় উৎসাহ দানকরা এবং রোগীদের সারিয়ে তোলার দায় গ্রহন করা।
১৯১৭ সালে প্রথমবার মাদ্রাজ প্রাদেশিক সরকার আয়ুর্বেদ নিয়ে উৎসাহ দেখিয়ে ড কোমানকে দায়িত্ব দিলেন রাজ্যের দেশিয় চিকিৎসা বিষয়ে সমীক্ষা চালাতে।৯৩ স্টেইনথাল বলছেন আয়ুর্বেদের পুনর্জাগরণীদের আন্দোলনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে মাদ্রাজ সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়।
বাড়তে থাকা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চাপে প্রাদেশিক সরকারগুলি দেশিয় চিকিৎসা বিদ্যা পুনর্জাগরণের বিষয়ে কিছু কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে। ১৯১৯এর সংস্কারের পরে যেহেতু বহু ক্ষমতা, বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিষয়টি, প্রাদেশিক মন্ত্রীদের হাতে চলে আসে, এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপও বাড়তে থাকে। দেশিয় চিকিৎসার অবস্থা সমীক্ষা করতে বেশ কয়েকটি প্রাদেশিক সরকার কমিটি তৈরি করে।
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দেশিয় পেশাদারদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল প্রাদেশিক মেডিক্যাল দপ্তরের ওপর; তবে ক্ষেত্র বিশেষে নীতি পালটে যায়। প্রত্যেক প্রদেশে একটি করে আয়ুর্বেদিক কংগ্রেস তৈরি করা হয়, যে সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল প্রাদেশিক সরকারের কাছে দেশজ চিকিতসকেদের দাবিদাওয়াগুলি পেশ করা। ১৯৩১এ বাংলা প্রদেশে চিকিৎসকেরা(মেডিক্যাল মেন) আয়ুর্বেদ চিকিতসায়, শিক্ষাদানের প্রমিতিকরণ এবং স্বীকৃত আয়ুর্বেদিক কলেজগুলিতে পরীক্ষা নিয়ে সার্টিফিকেট এবং ডিপ্লোমা দেওয়ার জন্য জেনারেল কাউন্সিল এবং স্টেট ফ্যাকাল্টি তৈরি করে। হয়ত য়ুনানি চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্যও নিশ্চই এ ধরণের একটি সংগঠন তৈরি হয়েছিল, কিন্তু তার বাস্তবে বেঁচে থাকার কোন নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাদেশিক সরকারগুলি দেশিয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় এগিয়ে আসবে এমন একটা আশা দেখা গেল। ১৯৩৬ সালে এমসিআই তৈরি হলেও জাতীয়তাবাদীদের দাবি এবং প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেটি থেকে দেশিয় চিকিতসকেদের বাদ দেওয়া হল। এই সময় থেকে পশ্চিমি চিকিৎসকেদের সঙ্গে দেশিয় চিকিতসকেদের দূরত্ব যোজন প্রমান হয়ে গেল – স্পষ্ট বলা হল যদি পশ্চিমি চিকিৎসকেরা অতিন্দ্রিয়, পৌরানিক, আধা-ধার্মিক গল্পগাছার ঘোমোটাওয়ালা এই চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে জুড়ে থাকেন, তাহলে তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কেড়ে নেওয়া হবে৯৬।
সামগ্রিকভাবে ঔপনিবেশিক সরকার ১৯০০ সাল থেকে দেশে বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিতসকদের এবং পাঠ্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ জারি করতে থাকে। এই ধরণের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার উত্তরে দেশিয় এবং পশ্চিমি চিকিৎসকেরা নিজেদের সঙ্গঠিত করে সরকারের কাছে আরও স্বীকৃতি দাবি করলেন৯৭।
সিদ্ধান্ত
আমি মত প্রকাশ করেছিলাম যে ব্রিটিশ ভারতে বাংলা সরকার চিকিৎসা বিদ্যা প্রসারে পৃষ্ঠপোষণা করেছিল। এই কাজে আমরা দেখলাম বিভিন্ন চিকিৎসা গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় নীতিকে পরাজিত করে পেশাদারি স্বীকৃতি লাভ করার চেষ্টা করেছিল। এর থেকে প্রমানিত হল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকাশ ঘটলেও পেশাদারিত্বের বিকাশ নাও ঘটতে পারে। বাংলা প্রদেশ এই ধরণের ব্যার্থতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
আমাদের দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হল যে ভারতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিকিতসকেদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণার উদ্যম ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধ পরবর্তী সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থানে বিবাদের পরিবেশ তৈরি হয় ফলে আমাদের দেশে পেশাদারি মনোপলি অবস্থার বদলে পেশাদারি অলিগোপলি অবস্থা তৈরি হল। স্বাধীনতার সময়ে ভারতে চার ধরণের চিকিৎসক গোষ্ঠী ছিল, যারা তাদের গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকদের স্বার্থ পূরণ করার চেষ্টা করত। এরা হল
১) মেডিক্যাল কলেজগুলির ছাত্র যারা ধনী অভিজাত এবং সেনাবাহিনীর সেবা করত।
২) মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্ররা ব্রিটিশ টেরিটরির সেবা করত
৩) মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্ররা দেশিয় জনগনের সেবা করত।
৪) এর বাইরে ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়া দেশিয় চিকিৎসকেরা যারা দেশের সাধারণ মানুষের সেবা করত।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment