পুনম বালা
১৯৩৩ সালে চিকিতসার ডিগ্রি জারি, মানদণ্ড নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল কাউন্সিল তৈরির বিল এল। গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া এক্ট প্রতিপালিত হওয়ার পরে সেই ডিগ্রিগুলি আবার নতুন করে স্বীকৃত হল। ভারত এবং ব্রিটেনে এই ডিগ্রিগুলি পারস্পরিকভাবে মান্যতা পাবে সেটাও স্থির হল।
পশ্চিমি চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রশাসকেরা পুরোনো চিকিৎসা শিক্ষার বদল এনে বাংলায় এবং ভারতের অন্যান্য এলাকায় শিক্ষা ব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজার কাজ যখন করছেন, তখন দেশিয় চিকিৎসার সঙ্গে যুক্তরা নিজেদের স্বাধিকার বুঝে নিতে চাইলেন। বিংশ শতকের শুরুতে স্বদেশি আন্দোলনে এই চাহিদার পালে হাওয়া লাগে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় রোগীরা পশ্চিমি চিকিতসকেদের কাছে না গিয়ে দেশিয় চিকিতসকেদের কাছে যান, তার জন্য আন্দোলনকারীরা দেশ জুড়ে আবেদন করলেন। ১৯১২ এবং ১৯১৪ সালের মেডিক্যাল রেজিস্ট্রেশন এক্টএ জাতীয়তাবাদীদের রোষ বাড়িয়ে দেয় এবং জাতীয়তাবাদীরা সরকারের ওপর প্রভূত চাপ তৈরি করে। যদিও এই আইনে দেশিয় চিকিতসকেদের নথিভূক্ত করা হয় নি এবং বলা হয়েছিল, শুধু মাত্র সরকারি নথিভুক্ত চিকিতসকেরাই সরকারি চাকরি এবং সরকারি কেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসা করার জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে।
ভারতের ইতিহাসে আয়ুর্বেদ জাগরণের আন্দোলন বড় ভূমিকা পালন করেছে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় সেএই আন্দোলন শিক্ষা কেন্দ্র খোলার জন্য দেশ জুড়ে আন্দোলন তৈরি করে। সরকার নিয়ন্ত্রণ নিরপেক্ষ সংস্থা তৈরি হল আয়ুর্বেদ এবং য়ুনানির চিকিতসকেদের জন্য – একদিকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন বৈদ্যদের এবং হেকিমদের নথিকরণের কাজ করতে থাকে, অন্যদিকে বাংলার মহামেডান লিটারারি সোসাইটি এবং ন্যাশলান মহামেডান এসোসিয়েসন হেকিমদের নথিকরণ করার কাজে এগিয়ে আসে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই কাজ সরকারের ওপর যথেষ্ট চাপ তৈরি করে৮৮।
বিংশ শতের শুরু থেকেই সারা দেশে দেশিয় এবং পশ্চিমি চিকিৎসা শিক্ষার একটা সমান্তরাল শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হতে থাকে। এই আন্দোলন আরও জোরদার রূপ পায় ১৯০৭ সালে দেশিয় চিকিতসকেদের উদ্যমে অল ইন্ডিয়া আয়ুর্বেদিক কংগ্রেস নামক একটি সংগঠন তৈরি হওয়ায়।
আয়ুর্বেদ পুনর্জাগরণের আন্দোলনের মূলস্বরগুলি ছিল, সরকারি স্তরে রাজনৈতিক সাম্য, স্বীকৃতি এবং সমর্থন। ব্রাস এই আন্দোলনকে এইভাবে দেখছেন, একটি শিক্ষা বিষয়ক গোষ্ঠী, যাদের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক পদ্ধতিতে স্বীকৃতি এবং পেশাদারিত্ব আদায়।৮৯
কিন্তু আয়ুর্বেদ আন্দোলন পেশাদারিত্ব অর্জনের রাজনৈতিক সমাধানে উস্থাপিত হওয়ার পদ্ধতিটাই তৈরি করে উঠতে পারল না। এই দুর্বার আন্দোলনেও পশ্চিমি চিকিৎসা ব্যবস্থার স্পর্ধিত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকার পরিকাঠামোই তৈরি হল না ভারতে। শিক্ষার অভিন্ন পাঠ্যক্রম বা চিকিতসার পেশাদারি মাপদণ্ড তৈরিও করা গেল না। আয়ুর্বেদ নবজাগরণ আন্দোলনের এই ব্যার্থতার কয়েকটি কারণ ব্রাস তুলে ধরেছতসারদেশিয় চিকিৎসার নবজাগরণের পদ্ধতি নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে মৌলিক বিভেদ ছিল। কেউ কেউ শুদ্ধ আয়ুর্বেদের প্রচার চাইছিলেন, আবার পশ্চিমি চিকিতসা পদ্ধতির সঙ্গে আয়ুর্বেদের ধারনাকে জুড়ে, আয়ুর্বেদের বিকাশের তত্ত্বের মানুষও কম ছিলেন না। শুদ্ধতাবাদীদের বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য ছিল যে, ভারতের সেই সময়ের গণস্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় যে শূন্যতা রয়েছে, সেটি একা শুদ্ধ আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসায় সমাধান করা যাবে না, এর সঙ্গে পশ্চিমি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে জুড়ে নিতে হবে। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছি এমনকি পশ্চিমি চিকিৎসা ব্যবস্থা মহামারীর সময় দেশিয় ব্যবস্থাকে সঙ্গে নিতে পিছপা হয় নি। পাঠ্যক্রমের মৌল বিষয় নিয়ে মতভেদ থাকায় পেশাদারিত্বে উপনীত হওয়ায় চেষ্টা, চেষ্টাই থেকেই গেল।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment