পুনম বালা
১৮৬৪ সালে সরকারি নতুন এক নির্দেশে বাংলা শ্রেণীকে দুভাগে ভাগ করা হল – নেটিভ এপোথেকারি এবং দ্য ভার্নাকুলার লাইসেন্সিয়েট – যার ফলে বাজারে স্বাধীন চিকিতসকেদের সংখ্যা একটু বাড়ল। প্রথম শিক্ষাটিতে সরকারি চাকরি করানোর জন্য ছাত্র ভর্তি করানো হল, আর দ্বিতীয়টিতে সাধারণ মেডিসিন এবং সার্জারিতে শিক্ষা দেওয়ার জন্য যাতে দেশের গরীবদের জন্য চিকিতসকেদের সংখ্যা বাড়ানো যায়৫৩।
দ্য ভার্নাকুলার লাইসেন্সিয়েট শ্রেণীদের প্রথম দল পাঠ শুরু করে ১৮৬৬-৬৭ সালের শিক্ষাবর্ষে যেখানে মহিলা, শিশু, দাই এবং মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সও পড়ানো হত। ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীতে উত্তোরণ ঘটল যখন চিকিৎসা পাঠের শ্রেণীগুলিকে শিক্ষা দেওয়ার আলাদা আলাদা বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করে নির্দিষ্ট নীতি আর আইনের আওতায় নিয়ে আসা হল। ১৮৭৩ সালে বাংলা ভাষার নেটিভ এপোথেকারি এবং দ্য ভার্নাকুলার লাইসেন্সিয়েট শ্রেণীকে নতুন বিদ্যালয়ে পাঠানো হল ফলে সেখানে বহু ছাত্র ভর্তি হতে পারল। এই বিদ্যালয়ের নাম হল শিয়ালদা মেডিক্যাল স্কুল বা ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুল। শুরুতেই ৮৩২জন ছাত্র নিয়ে তার যাত্রা শুরু করল এই বিদ্যালয়। একই বছরে হিন্দুস্তানি শ্রেণীকে টেম্পল মেডিক্যাল স্কুলে পরিণত করা হল। জেলা সুপারিনটেন্ডেন্টের তত্ত্বাবধানে চলা এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল সেই সব ছাত্রদের শিক্ষিত করা হবে যারা গ্রামে চিকিৎসা করতে উতসাহী। এরা হেকিম আর বৈদ্যদের স্থান গ্রহণ করবে এবং তাদের মাধ্যমে সমাজে ইওরোপিয় চিকিতসাবিদ্যার সুফল পৌছে যাবে৫৫। এই প্রস্তাবটি নেওয়া হয়েছিল ১৮৭৯ সালের এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের বৈঠকে।
নতুন দুটি বিদ্যালয় স্থাপনে চিকিৎসা বিদ্যালয়(স্কুল) এবং মহাবিদ্যালয়ের(কলেজ) মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে দিল। স্কুলগুলির কাজ হল ডিপ্লোমা এবং সার্টিফিকেট দিয়ে প্রচুর অধস্তন চিকিৎসক তৈরি করে বিভিন্ন সরকারি সেবায় শূন্যস্থান পূরণ করা এবং দ্বিতীয়টির উদ্দেশ্য হল নির্দিষ্ট সময়াবধির পাঠ্যক্রম অনুসরণ করিয়ে ডিগ্রি দেওয়া।
রাষ্ট্র দেশিয় চিকিতসক নিয়োগ করেছে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত। তার পরে ছাত্রদের বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের শর্ত আরোপ করেছে। এই বিধিনিষেধের উদ্দেশ্য হয়ত ছিল সেনাবাহিনীর জন্য যথেষ্ট সংখ্যক চিকিৎসক নিয়োগ করা। বাংলা শ্রেণীর চিকিৎসকেরা সরকারি চাকরির বদলে প্রেসিডেন্সির গরীব শ্রেণীর মানুষদের সেবা দিতেন।
১৮৫৭ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি পাওয়ার পরে সিনেটের অনুমোদনক্রমে প্র্যাক্টিক্যাল কেমিস্ট্রি আলাদা পাঠ্য হিসেবে বা সাধারণ বক্তৃতা দেওয়ার চল শুরু হলেও বহুকাল পর্যন্ত চিকিৎসাবিদ্যা পড়া বা চিকিৎসা করার জন্য রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা এবং প্রাণীবিদ্যা অধ্যয়ন জরুরি শর্ত ছিল না। এই বিদ্যাগুলির পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ১৯০১-০২ সালে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বাইরে থেকে আসা বিশেষজ্ঞ দল তৈরি হল। চিকিৎসক হিসেবে ডিগ্রি পাওয়ার জন্য কোন বিদ্যালয় থেকে ন্যুনতম দুবছরের অবধিতে এনাটমি এবং ফিজিওলজি অধ্যয়ন এবং কোন স্বীকৃত হাসপাতাল থেকে মেডিসিন এবং সার্জারিতে প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা জরুরি ছিল। বাড়তে থাকা এনাটমি এবং সার্জারি বিদ্যার বিকাশের ফলে এই দুই বিদ্যা গুরুত্ব পেতে থাকে।
প্রেসিডেন্সির নানান এলাকার চিকিৎসা বিদ্যালয়ের চিকিতসাশিক্ষার গুণমান বাড়ানোর জন্য নতুন করে উদ্যম নেওয়া হল। ১৮৯৬ সালে চিকিতসাবিদ্যার পাঠটি তিন বছর থেকে বাড়িয়ে চার বছর এবং ১৯০৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষার স্তর বাড়িয়ে ম্যাট্রিকুলেশন করা হল। এরপর বিদ্যালয়গুলিকে দেশিয় থেকে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করা হয়। এক দশক পর রাষ্ট্র বাংলায় স্টেট মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি স্থাপন করে বিদ্যালয়গুলি থেকে সফল ছাত্রদের বেঙ্গল কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রেজিস্ট্রেশনে পঞ্জীকরণ করার কাজ শুরু করবে। চিকিতসাবিদ্যার বিদ্যালয়গুলি থেকে বেরিয়ে আসা সফল ছাত্র সাব-এসিস্ট্যান্ট সার্জন পদে সরকারি সেবায় প্রবেশ করত।
রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে চিকিৎসা নীতি অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়ায় ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসা পাঠ্যক্রম সরকারের পক্ষে স্বীকৃতি দেওয়া সহজ হয়ে যায়। ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি এক্টএ চিকিৎসা বিদ্যার পাঠ্যক্রম রদবদল ঘটানোর ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে ১৯০৪ সালে সরকার এই পদক্ষেপ গ্রহন করে। লর্ড কার্জন ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি এক্টকে ফিরে দেখতে চেয়ে বললেন সরকার শুধু যে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যম নিতে পারে তাই নয়, সে যা কিছু অদলবদল করা, কোন কিছু যোগ বিয়োগ করার, এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহন করা যে কোন কিছু পরিবর্তনও করতে পারে।
সরকার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করল আবার সেটির প্রশাসন এবং পাঠ্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পদক্ষেপও নিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা পাঞ্জাব, মাদ্রাজ এবং লাহোরের চিকিৎসা কলেজগুলিতেও এই ধরণের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হল। বিংশ শতকের আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রক ছিল না, ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত চিকিৎসা পঠনপাঠন নিয়ন্ত্রণ করত ডায়রেক্টরেট অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন দপ্তর।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment