Sunday, March 5, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২৮ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

নতুন শ্রেণীতে এনাটমি, মেটিরিয়া মেডিকা, মেডিসিন এবং সার্জারি হিন্দুস্তানি এবং উর্দুতে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হল। ১৮৩৯ সালে মাথাপিছু ৫ টাকা বৃত্তিধারী ৫০ জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু হল। শব্যবচ্ছেদ এবং পাঠ্যসূচী ইওরোপিয় নীতি অনুসারী। ক্লিনিক্যাল শিক্ষার জন্য তাদের মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালে নিয়োগ করা হয়৩৮। হাসপাতাল শুরু হয় ১৮৩৮ সালে কলেজ কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনায়, যাতে তাত্ত্বিক বিষয়ের সঙ্গে হাতে কলমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব দিক শেখানো যায়। ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক, জনৈক ম্যাককোষের পদত্যাগে৩৯ পদটি তুলে দিয়ে যে বেতন বাঁচল, তা বরাদ্দ হল হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলি দেখাশোনার জন্য।

মোটামুটি শুরুর সময় থেকেই মিলিটারি বা হিন্দুস্থানি শ্রেণীটি ভারতীয়দের জন্য চিকিৎসা জ্ঞান আহরণের কাজে উন্মুক্ত করে দেওয়া হল চাকরির শর্ত জুড়ে দিয়ে। ঠিক হল প্রবেশাধিকার পাবে ১৫০ জন। যোগ্য দেশিয় ডাক্তার হিসেবে কাজ শুরুর আগে তাদের কলেজের অধাপকেদের সামনে পরীক্ষা দিতে হবে৪০। যে সব ডাক্তার অসামরিক স্থানে কাজ করত, তাদের প্রতি আরও একটি শর্ত ছিল সরকারের চাহিদা ও নির্দেশ অনুযায়ী সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতে হতে পারে। যে সব ছাত্র সেনাবাহিনীতেও কাজ করবেন তাদের জন্যও একই নির্দেশ জারি হল।

মেডিক্যাল কলেজে মিলিটারি শ্রেণীতে দুধরণের বিষয় পড়ানো হত একটি তাত্ত্বিক অন্যটি প্রায়োগিক। প্রথমটি দুবছর এবং তৃতীয়টি শেষ বছরে। তাত্ত্বিক পাঠ্যক্রমে ছিল বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের পরিচয় এবং ব্যবচ্ছেদ ক্রিয়া জ্ঞাপন করিয়ে এনাটমি, মেটিরিয়া মেডিকা এবং প্রাক্টিক্যাল ফার্মেসির শিক্ষা৪১। তাত্ত্বিক পড়াশোনার দ্বিতীয় বছরের শেষে মেডিসিন এবং সার্জারিও পরানো হত। তৃতীয় বছরে হাতে কলমে ড্রেসার, ডিসপেনসার এবং কম্পাউন্ডারির শিক্ষা দেওয়া হত। যেসব হাসপাতালে ভারতীয় ছাত্ররা ভারতীয় শিক্ষকদের থেকে মেডিসিন এবং সার্জারির প্রায়োগিক শিক্ষা নিচ্ছে সেই সব হাসপাতালে এই শিক্ষা দেওয়া হত। হাসপাতালে ময়না তদন্ত ছিল ক্লিনিক্যাল ইন্সট্রাকশনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তৃতীয় বছরের শেষে মিলিটারি শ্রেণীর ভারতীয় ছাত্র ড্রেসার, কম্পাউন্ডার এবং ওষুধ খাওয়ানো এবং সাধারন হাসপাতালের সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করতে পারত। কিন্তু তাদের কাজের কেরিয়ার সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না।

শতাব্দ যত এগোতে থাকে বাংলায় দেশিয় চিকিতসকেদের চাহিদা বিপুল হারে বাড়তে থাকে বিশেষ করে অসামরিক কাজে। আগের বছরের কলেরা মহামারী এই চাহিদাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এই চাহিদা পূরণ করতে রাষ্ট্র মেডিক্যাল কলেজে ১৮৫১ সাল থেকে আরও একটি শ্রেণী খুলতে বাধ্য হয়। দেশিয় মানুষদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষিত ছাত্ররা অধস্তন চিকিৎসা কর্মী হিসেবে কাজ করা শুরু করে।

নতুন শ্রেণীটার নাম হল দেশিয় বা বাঙ্গাল শ্রেণী, দুবছরের শিক্ষানবিশীর প্রশিক্ষণ। ১৮৫৩ সালে ২১ জন ছাত্র নিয়ে শুরু হল এই পাঠ্যক্রম। সফল ছাত্রদের উপাধি হত হাসপাতাল এপ্রেন্টিস বা ভার্নাকুলার লাইসেন্সিয়েটস ইন মেডিক্যাল এবড সার্জারি। এই শ্রেণীতে ভর্তির জন্য বাংলা ভাষা সম্বন্ধে বিশদ জ্ঞান থাকা জরুরি ছিল। এই শ্রেণীর পাঠ্যসূচীর সঙ্গে হিন্দুস্তানি পাঠ্যসূচীর মিল ছিল। তৃতীয় বছরে সফল হয়ে বেরোবার পরে তারা দেশিয় ডাক্তার হিসেবে ডিপ্লোমা কাগজ এবং চাকরি পেতেন বিভিন্ন ডেপুটি-ম্যাজিস্ট্রেটের দাতব্য চিকিৎসালয়ে আর জেল হাসপাতালে। এদের একাংশ টিকাকার হিসেবেও কাজ করেছেন৪৩। সেই সময়ে বাংলা জুড়ে কলেরা যে মহামারীর আকার নেয় তা রুখতে এই পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়। কয়েকজন বাংলা প্রেসিডেন্সির নানান সংস্থা বা হাসপাতাল বা এক্সটেন্ডেড কলোনিয়াল টেরিটরিতে চাকরি করেছেন৪৪।

যদিও চিকিৎসক তৈরির জন্য মেডিক্যাল কলেজে অতিরিক্ত শ্রেণী তৈরি হচ্ছিল যাতে সেনাবাহিনী বা অন্যান্য ক্ষেত্রের চাহিদা পূরণ করা যায়, অন্যদিকে রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী মেডিক্যাল কলেজেও পরিবর্তন আসছিল। ১৮৫৬ সালে কলেজের বিশদ ব্যবস্থাপনা এবং ব্যয়ের দায়িত্ব কলেজ কাউন্সিল এবং সেক্রেটারির হাত থেকে নিয়ে নেওয়া হয়, এ কাজে প্রিন্সিপ্যালকে সাহায্যের জন্য একটা কাউন্সিল অব প্রফেসর তৈরি করা হল, পরে প্রইন্সিপ্যাল ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের ফিজিশিয়ান এবং সার্জনের পদে বৃত হন৪৫।

চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের দখলদারির নতুন ধারার প্রবর্তন ঘটল ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মধ্যে দিয়ে। এই শিক্ষার পাঠ্যসূচী তৈরি এবং পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব গিয়ে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার একটি স্বশাসিত বোর্ডের ওপর যেটি আবার সরাসরি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত।

১৮৫৭ সালের সিপাহী যুদ্ধ(পুনম এখানে মিউটিনি শব্দটা ব্যবহার করেছেন) ভারতের সামাজিক গঠন এবং সরকারি কাজকর্মে বিপুল পরিবর্তন ঘটাল। সিপাহি যুদ্ধের বহু কারণ – ডালহৌসির দেশিয় রাজ্য গিলে খাওয়ার নীতি – যার ফলে বহু দেশিয় সামন্ত রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে, নতুন রাজস্ব নীতি যাতে দেশিয় চাষীদের ওপর বিপুল আর্থিক চাপ তৈরি হয় এবং দেশিয় হস্তশিল্পের উতপাদনের বাজারকে বিদেশিয় কলের উতপাদনে প্রতিস্থাপিত করার ইত্যাদির জন্য সিপাহি যুদ্ধ ঘটে। ১৮৫৮র গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া এক্টএও পরিবর্তন ঘটল। সরকারের আর্থিক আয়ব্যয়ের হিসেব রাখার দায় পড়ল সরকারের ওপর এবং সেই সঙ্গে দেশের নৈতিক এবং জাগতিক উন্নতির কথাও বলা হল।
(চলবে)

No comments: