Sunday, March 5, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২৯ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

১৮৫৮তে রাণি যখন কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার নিজের হাতে নিলেন তখন থেকে সাম্রাজ্যের ভারত সম্বন্ধীয় দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটল। এই সময়ে পশ্চিমি নবজাগরণের(নতুনভাবে তৈরি ব্রিটিশ পেশাদারদের) সুফল ভারতীয়দের কাছে পোঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সাম্রাজ্য। এই পরিবর্তনের বহু সীমাবদ্ধতা ছিল – তখনও ভারতীয় সাম্রাজ্যের মূল লক্ষ্য ছিল আইনের শাসন এবং রাজস্ব আদায়।

নতুন সরকারের নীতি পরিবর্তনের দুটি প্রভাব চিকিৎসা সেবায় পড়ল – মফস্বলে সিভিল সার্ভিসে চাকরি করা ইওরোপিয়দের স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হল ব্রিটেনে শিক্ষিত ব্রিটিশ চিকিতসকেদের ওপর। ১৮৪০ এবং ৫০এর দশকে আইএমএস(১৯৪৭ পর্যন্ত মূলত সেনাবাহিনীর চিকিৎসা সেবা)এ উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসা স্নাতকদের রমরমা ছিল যাদের পশ্চিমি পদ্ধতি এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে তৈরি করা নির্দিষ্ট সুউচ্চ ধারণা ছিল। এরা এই সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করত সেই শতকের ৬০ এবং ৭০ দশকেও। হিউম বলছেন এই প্রজন্মের চিকিতসকেরা পাঞ্জাবে ১৮৬০ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত হেকিমদের দিয়ে টিকাকরণ এবং স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে এক্সটেন্সানের কর্ম প্রকল্প বন্ধ করে দেন।

নব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তারের সঙ্গে প্রশাসনিক বিভাগগুলিরও বিস্তার ঘটল। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের বিস্তারের ফলে পাশ্চাত্যে শিক্ষিত চিকিতসকেদের প্রশাসনিক সেবায় চাহিদা বাড়ল। এই বিস্তারের আগে কোম্পানি আমলে চিকিতসকেরা সাম্রাজ্য জুড়ে কোম্পানির ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে মিশনারিরাও চিকিৎসা সেবা দিতেন, তার পরে শেষের দিকে স্থায়ী সরকারি চিকিৎসা সেবা ক্ষেত্র তৈরি হয়। তবুও ১৯৩০ সাল নাগাদ ভারতে প্রচুর চার্চ হাসপাতালের অস্তিত্ব ছিল।

ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের পাশাপাশি গঙ্গাধর রায় এবং গঙ্গাপ্রদাস সেনের মত প্রখ্যাত ভিষগের হাতে আয়ুর্বেদ চর্চিত হচ্ছিল। এই সময়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে(অন্তত তিনটি প্রজন্ম) কবিরাজির পরম্পরা যে বয়ে চলেছে তার একটা উদাহরণ নিচে দেখতে পাব -

ক। গঙ্গাধর রায়(১৭৮৯-১৮৮৫) ছাত্রবৃন্দ
১। দ্বারকানাথ সেন(প্রথম প্রজন্ম ছাত্র), যোগীন্দ্রনাথ সেন, উমাচভরণ ভট্টাচার্য, রাজেন্দ্র নারায়ণ সেন, কুঞ্জলাল ভিষগরত্ন, জয়পুরের লক্ষ্মীনারায়ণ শর্মা, নাগপুরের গোবর্ধন শর্মা(দ্বিতীয় প্রজন্ম)
২। গয়ানাথ সেন(প্রথম প্রজন্ম ছাত্র), সীতানাথ সেন, রামনাথ সেন, বেনারসের সত্যনারায়ণ শাস্ত্রী এবং ধর্মদাস গুপ্ত এবং ত্র্যম্বক শাস্ত্রী, শ্যামাদাস বাচস্পতি(দ্বিতীয় প্রজন্ম)
৩। হারানচন্দ্র চক্রবর্তী(প্রথম প্রজন্মের ছাত্র), জ্যোতিষচন্দ্র সরস্বতী, রমেশ্চন্দ্র চক্রবর্তী, প্রভাকর চ্যাটার্জী(দ্বিতীয় প্রজন্ম), বিমলানন্দ তর্কতীর্থ, রামচন্দ্র মল্লিক, বিজয়কালী ভট্টাচার্য, নিলিনীরঞ্জন সেন(তৃতীয় প্রজন্মের)

খ। গঙ্গাপদ সেনের(১৮২৪-১৮৯৬) ছাত্র আর তাদের ছাত্রদের ছাত্র
১। নিশিকান্ত সেন, বিজয় রত্ন সেন(প্রথম প্রজন্ম), যামিনীভূষণ রায়, বিরাজচরব গুপ্ত, দুর্গাদাস ভট্ট(দ্বিতীয় প্রজন্মের)
২। রামচন্দ্র বিদ্যাবিনোদ
এই পর্বে অনুবাদের কাজও হয়েছে। বিজয়রত্ন সেন আয়ুর্বেদের পুনর্জাগরণে ভগট্টের অষ্টাঙ্গরদ্ধ অনুবাদ করেন। সে সময় শাসক রাজা বিজয়রত্নকে মহামহোপাধ্যায় উপাধি দান করেন। তিনি দুই চিকিৎসাব্যবস্থার মিলনের পক্ষে ছিলেন। তার এক ছাত্র যামিনীভূষণ রায়ের স্থাপন করা আয়ুর্বেদ কলেজে দুই ধরণের চিকিৎসাবিদ্যা অধিত হত।

খ। ১৮৬০ থেকে ১৯২০
এই পর্বে পেশাদারিত্বের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের অভিমুখেরও পরিবর্তন ঘটে। ভারতে ইংরেজী শিক্ষত শ্রেণী - যাদের অধিকাংশ সফল ব্যবসায়ী, জমিদার এবং নব্য শিল্পপতির - তাদের উদ্ভবে ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশ ঘটে। এই পর্বে দেশজ এবং পশ্চিমি চিকিতসকেদের পেশাদারিত্বের দিকে যাওয়ার উতসাহ দেখা দেয়।

রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চিকিৎসা বিষয়ে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। সেই সময়ের চিকিতসা সংক্রান্ত নীতির একটা দ্বন্দ্ব চলতে থাকে একদিকে চিকিতসকেদের ব্যক্তিগত পসার বাড়ানোর বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হয়, আর অন্যদিকে প্রশ্ন ওঠে কিভাবে রাষ্ট্রের দেওয়া চিকিৎসা সেবা বিপুল জনসংখ্যার কাছে পৌঁছবে। একদিকে রাষ্ট্র সরকারি চাকরিতে দেশিয় চিকিতসকেদের প্রবেশের বিরোধিতা করছে, অন্যদিকে তারা বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়ারও অঙ্গীকার করছে। ১৮৫৭র পরে রাষ্ট্রের ঘাড়ে উন্নয়নের বৃহত্তর জোয়াল পড়লেও এই বিপুল সংখ্যাকে সেবা দেওয়ার মত প্রয়োজনীয় চিকিৎসক তার হাতে ছিল না। ফলে বিপুল সংখ্যায় মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে রাষ্ট্র দেশিয় চিকিৎসার ওপর নির্ভর করতে শুরু করে।
আমাদের হাতে যে সব তথ্য রয়েছে তা নির্ভর করে বলতে পারি পাঞ্জাবে ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৮ পর্যন্ত বৈদ্য আর হেকিমদের লাহোর মেডিক্যাল কলেজে আয়ুর্বেদ এবং য়ুনানির প্রাথমিক বিষয়ে শিক্ষত করে তুলে বিভিন্ন এলাকায় তাদের চিকিতসক হিসেবে কাজে লাগাতে শুরু করে। এই ধরণের টলারেন্সের কারণ হল, স্টেট মেডিক্যাল কলেজগুলি থেকে উপযুক্ত সংখ্যায় চিকিৎসক তৈরি করা যাচ্ছিল না। রাষ্ট্রের সেবা যে সব অঞ্চলে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছে সেই সব এলাকায় দেশিয় চিকিতসকেদের সেবা ব্যবহার করা হল নানান ত্রাণের কাজে। কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজ এবং লাহোরের মেডিক্যাল কলেজের চিকিতসক স্নাতকেরা বিপুলাকার প্রশাসনের সেনাবাহিনী, জেল, রেলে চাকরি পেয়েগেলেন। ১৮৭২ সালের বাংলার জনগননায় ৩৭৬৯জন ফিজিসিয়ান, সার্জেন এবং ডাক্তারের যেমন হদিশ পাওয়া যাচ্ছে, তার তুলনায় দেশিয় চিকিৎসকের সংখ্যা দেখা যাচ্ছে ২৩৭০০।
(চলবে)

No comments: