জগদীশ নারায়ণ সরকার
৬। মীর জুমলার পুত্রের এবং সম্পত্তির মুক্তি
৭ জানুয়ারি নান্দেরে শাহজাদা মহম্মদের সসৈন্যে উপস্থিত হওয়ার সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও মহম্মদ আমীনকে মুক্তি দেননি গোলকুণ্ডার সুলতান। ২৪ তারিখের সম্রাটের কঠোর শব্দে লেখা ফার্মান এবং শাহজাদার হায়দ্রাবাদের দুই স্তর আগে পৌছোনোর সংবাদে হঠাতই যেন ঘুমের ঘোর থেকে জেগে উঠলেন তিনি। মহম্মদ আমীনকে এবং তাঁর পরিবারকে গোলকুণ্ডার মুঘল হাজিব, আব্দুল লতিফ এবং আওরঙ্গজেবের দূত আবদুল কাশেম আর সঈদ আলির হাতে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে নিয়াজ বেগ আর আজিজ বেগ মার্ফত সম্রাটকে মুক্তিদানের দেরির জন্য কৈফিয়ত দিয়ে পাঠালেন। ২১ জানুয়ারি, হায়দ্রাবাদ থেকে ২১ কোস দূরে মহম্মদ আমিন তাঁর ‘সাহায্যকারী’ শাহজাহার সঙ্গে দেখা করলেন, তিনি আমীনকে বললেন রণনৈতিকভাবে সঠিক সময় না আসা পর্যন্ত যেন তিনি মীর জুমলার জন্য অপেক্ষা করেন। যেহেতু কুতুব শাহ তাঁর পরিবারের সম্পত্তি হস্তান্তর করে নি, সেই অজুহাতে শাহজাহা সেনা নিয়ে হায়দারাবাদের দিকে এগিয়েই চললেন। ২২ জানুয়ারি এই সংবাদে সুলতান তড়িঘড়ি নিরাপদে আশ্রয় নিলেন তাঁর মহম্মদনগরের(গোলকুণ্ডার) প্রাসাদে। হায়দ্রাবাদের ৫ মাইল দূরে হুসেন শাহ হ্রদের পাশে উপস্থিত হয়ে শাহজাদা পরিখা খোঁড়ার এবং গোলকুণ্ডা দুর্গের সামনে মাইন পোঁতার নির্দেশ দিলেন। যদিও সেনাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল শহরের সাধারণ মানুষের ক্ষতি না করার, কিন্তু ২৪ তারিখে হায়দ্রাবাজ জুড়ে লুঠতরাজ চলল। বিজাপুরি সেনাপতি আফজল খাঁ হায়দ্রাবাদের ৪০ মাইল জুড়ে সেনা মোতায়েন করেছিলেন, তাই আর দেরি করা বিপজ্জনক হয়ে যাবে চিন্তা করে নান্দের থেকে অভিযান শুরু করে ১৮ জানুয়ারি গোলকুণ্ডায় পৌছলেন আওরঙ্গজেব। তিনি অপেক্ষা করছিলেন মীর জুমলার আগমনের জন্য। তাঁর মতলব, যদি সম্রাট শাহজাহান অনুমতি দেন তাহলে গোলকুণ্ডা দখল করবেন, না হলে মীর জুমলার দখল করা সম্পত্তি এখন যেটি গোলকুণ্ডা রাষ্ট্রের দখলে সেটি উদ্ধার করবেন এবং পরিশোধ না করা পেশকাশও উদ্ধার করবেন এবং কুতুব শাহের থেকে উজ্জ্বল কোন উপহার বাগাবেন। হতবুদ্ধি, কিংকর্তব্যবিমূঢতার ভোগা কুতুব শাহ এখন আওরঙ্গজেবকে যে কোন প্রকারে শান্ত করতে তীব্রউতসুক হয়ে মীর ফরাসের তত্ত্বাবধানে সোনায় মোড়া হাতি, ঘোড়া, চারটি পুঁটলি হিরেজহরতসহ গয়না পাঠালেন, এবং তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব সেই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। সুলতানের দূত মোল্লা আব্বাস সাইহানদ, এমন কি দারা এবং জাহানারা মার্ফতও শাহজাহানের কাছে রাহতের আবেদন করলেন। আওরঙ্গজেবের ধারণা হল সম্রাট তাঁর আবেদন মেনে নেবেন এবং প্রকারন্তরে সুলতানকে কর্ণাটক দখলের অনুমতিও দিয়ে দেবেন – অথচ এই বিস্তৃত, সম্পদশালী, চোখে দেখা যায় না এমন সম্পদে ভরপুর, দূর্গ এবং ধনীদের অধ্যুষিত অঞ্চলটি মীর জুমলা স্থানীয় জমিদারদের থেকে জয় করেছিলেন। কোন কারণে সম্রাট তাকে মাফ করে দিলে আওরঙ্গজেবের পায়ের তলার মাটি সরে যাবে। মীর জুমলার আসার গুরুত্বটাই হারিয়ে যাবে। তাঁর আশংকা হল, এই সাজিয়েগুজিয়ে তোলা ঘটনাপ্রবাহটি হাতের বাইরে চলে যাবে। তাই তিনি পাদশাহের কাছে প্রার্থনা করে জানালেন, যতক্ষণনা মীর জুমলার সন্তান সেখানে পৌঁছচ্ছে, ততক্ষণ যেন পাদশাহ কুতুব শাহের কোন প্রার্থনারই উত্তর না দেন, বিশেষ করে কুতুব শাহের দূত রাজধানীতে পৌছনোর আগেই মীর জুমলা হায়দ্রাবাদের পৌঁছে যাবেন।
হায়দ্রাবাদের লুঠতরাজের সময় মীর জুমলার পুত্রকে শাহজাদা মহম্মদ সুলতান দায়িত্ব দিয়েছিলেন, কুতুব শাহের সম্পত্তি এবং আসবাবপত্র রক্ষার। কুতুব শাহের দূত হাকিম নিজামুদ্দিন আহমদকে মুঘল শিবিরে নজরদারিতে রাখা হল, এই অভিযোগে যে সুলতান মীর জুমলার সম্পত্তি হস্তান্তর করতে দেরি করেছেন। শেষ পর্যন্ত ২৯ জানুয়ারি ১৬৫৬ কুতুব শাহ মীর জুমলার ১১টি হাতি, ৬০টা ঘোড়া এবং অন্যান্য জব্দ করা সম্পত্তি মহম্মদ সুলতানের নজরদারিতে ফিরিয়ে দিলেন।
৭। আওরঙ্গজেবের শিবিরে মীর জুমলার আগমন
গোলকুণ্ডা ঘেরাও করে রাখার মাসগুলি ধরে আওরঙ্গজেব মীর জুমলার আগমনের প্রতীক্ষা করছিলেন। একের পর এক গোপনীত বার্তা পাঠিয়ে তাকে বলা হচ্ছিল এই সোনালি সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে চলেছে, তাই যততাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি যেন এসে আওরঙ্গজেবের শিবিরে যোগ দেন। কিন্তু মীর জুমলা নিজের ঘর না গুছিয়ে অর্থাৎ বিজিত কর্ণাটকের প্রশাসন না সামলে এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব সম্পদ না গুছিয়ে আসতে পারছিলেন না। খ্বাজা আরিফ মহম্মদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মীর জুমলাকে কর্ণাটক থেকে রওনা করিয়ে দেওয়ার – কিন্তু তিনি বিফল হলেন। ১৬৫৬ সালে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে জানালেন তার দেরির কারণ, এবং অনুরোধ করলেন তাঁর বক্তব্য যেন সম্রাটকে জানানো হয়। ১০ জানুয়ারি তিনি মীর জুমলাকে একবার তাঁর ভবিষ্যিত পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন অর্থাৎ ১৮ তারিখে মহম্মদ সুলতান হায়দ্রাবাদ পৌঁছবে এবং যতদূর সম্ভব তিনি পৌঁছবেন ২০ তারিখে। তিনি লিখলেন, ‘আমার সমস্ত চেষ্টা হবে যেভাবে কুতুবুউলমুলক মহম্মদ আমীনকে গোলকুণ্ডায় গ্রেফতার করেছে, আমি ঠিক সেইভাবেই তাকে গ্রেফতার করব। তুমি দূর্গ এবং নিজের সম্পত্তি আগলানোর ব্যবস্থা করছ ভাল কথা, কিন্তু সব কিছু ফেলে রেখে এবং সময়ের দিকে নজর রেখে যত তাড়াতাড়ি হায়দ্রাবাদে পৌছনোর চেষ্টা কর’। কুতুব শাহ তাঁর পুত্রকে মুক্তি দিলেও আওরঙ্গজেব তাঁর পরিকল্পনা থেকে সরতে রাজি ছিলেন না, এবং বললেন খুব শীঘ্র এসে এই বিশদ পরিকল্পনাটি রূপায়িত কর, এবং মহম্মদ মুমিনকে তাকে আনতে পাঠালেন। মীর জুমলাকে আবার লিখলেন, ‘এই ঘটনার শেষ ফলের প্রতি উদাসীন থেকো না, এবং এক মুহূর্তও অপব্যয় কর না।’ তাঁর অনুরোধে তিনি ১১ ফেব্রুয়ারি ২০০০ ঘোড়সওয়ার বাহিত হয়ে আবার আবদুল লতিফকে পাঠালেন মীর জুমলাকে আনতে। কিন্তু মীর জুমলার পথে দেরি ঘটল তাঁর সাঁজোয়া বাহিনীর শ্লথ গতির জন্য। দিনের পর দিন যায় মীর জুমলা আর আসেন না। দিন যায় আওরঙ্গজেব জিততে থাকেন ততবেশি কুতুব শাহ শাহেনশাহর প্রতি করে মার্জনা ও শান্তি ভিক্ষা করতে থাকেন এবং এই বার্তা আওরঙ্গজেবের কাছে আসতে থাকে নিয়মিত। জেতার মুহূর্তে যখন তাঁর আশা ফলবতী হতে চলেছে অথচ মীর জুমলা পৌছচ্ছেন না, তখন হতোদ্যম হয়ে এবং প্রায় হতাশায় ডুবে পড়ে সুবাদার তাঁর সাথীকে মার্চ মাসে লিখলেন, ‘আমি তাকে(সুলতান) নগ্ন করে দিতে পারি, আমার বিশ্বাস তুমি রাস্তায় আছ... কুতুব শাহ এখন ক্ষমা ভিক্ষা করছে... তাঁর জামাই মীর আহমদকে আমার কাছে পাঠিয়েছে এই বলে যে আমার জন্য তাঁর মা অপেক্ষা করছেন, যেন আমার পুত্র তাঁর কন্যাকে বিবাহ করে... কিন্তু আমি তাকে শান্তিতে থাকতে দেব না... আমার উচ্চাশার আকাশ্চুম্বী, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।’
অবশেষে আওরঙ্গজেবের অপেক্ষার অন্তহীন অপেক্ষার সময় শেষ হল। ৮ মার্চ মীর জুমলা কৃষ্ণা পার হয়ে ১৮ মার্চ তাঁর শিবিরে উপস্থিত হলেন। সেটি হাসান সাগর হ্রদের ৮ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। তাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সাম্রাজ্যের ফার্মান আর খিলাত নিয়ে খ্বাজা আরিফ কৃষ্ণার তীরে পৌঁছলেন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment