জগদীশ নারায়ণ সরকার
৬। উজিরের দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের সঙ্গে সম্রাটের মধ্যস্থতা
গোলকুণ্ডার লুঠের মাল(জিকাদা, ৩০তম জুলুস) নিয়ে সুলতানের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের যে বিরোধ ঘটে তার ঘটনাপ্রবাহ থেকে পরিষ্কার যে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের হয়ে কাজ করছিলেন। যেভাবে নিজের কাজকর্ম সমর্থন করে আওরঙ্গজেব পাদশাহকে চিঠি লিখছিলেন তাঁর প্রতি অনাস্থার প্রেক্ষিতে এবং মীর জুমলাকে সম্রাটের সঙ্গে মধ্যস্থতা করতে অনুরোধ করছিলেন, তাঁর থেকে পরিষ্কার, সম্রাট আর তাঁর দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের মধ্যে মীর জুমলা মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছেন। সম্রাটের অভিযোগ ছিল গোলকুণ্ডায় কুতুব শাহের থেকে বেশ কিছু দামি রত্ন আওরঙ্গজেব এবং তাঁর পুত্র উপহার স্বরূপ নিয়েছেন তাঁকে না জানিয়ে, এবং সম্রাটের এই ধারণাটি বিরুদ্ধে তিনি মীর জুমলাকে প্রতিবাদ পত্র লেখেন। শায়েস্তা খান এবং মীর নিজে কুতুব শাহের পাঠানো ১ কোটি ১৫ লক্ষ টাকার পেশকাশ নিরীক্ষণ করার পরে স্বয়ং মীর মন্তব্য করেন এই অকিঞ্চিৎকর উপহার সম্রাটের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। মীর জুমলার কাছে খবর ছিল যে সুলতান, আওরঙ্গজেবের উপস্থিতিতে সম্রাটকে উপহার দিতে চান না। সে ঝগড়ার খবর মীর জানতেন। আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে জানান যে সম্রাট গোটা পেশকাশগুলি এই তাড়াতাড়ি নিজের কব্জায় করতে চাইলেন, যে আওরঙ্গজেবের পক্ষে সুলতানদের থেকে সেই পেশকাশ নিয়ে সম্রাটের কাছে পাঠানোর পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। আওরঙ্গজেবের এই বেকায়দা অস্বস্তিতে দুজন সুলতান উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছিলেন, এবং শেষ পর্যন্ত কিভাবে তিনি সেই সমগ্র পেশকাশ, এমনকি তাঁকে আর তাঁর পুত্রকে দেওয়া উপহারটুকু দিল্লিতে সুলতানের দরবারে পাঠিয়েছিলেন, সেই সংবাদ মীর জুমলাকে দিয়েছেন(মীর জুমলা দেখেছেন, সেগুলি ছিল কালো দাগওয়ালা একটি হিরে, একটি চার হাজার টাকাও দাম নয় এমন নীলকান্তমণির আংটি)। তিনি মীর জুমলাকে লেখেন আমার যদি কিছু লুকোনোর থাকত, তাহলে সেগুলি আমি কেন তোমায় দেখাতাম... আর আর আমি মাত্র কয়েকটি হিরে জহরত নিয়ে কি করব যখন আমার সারা জীবন-অলঙ্কারটাই উতসর্গ করে দিয়েছি সম্রাটের পায়ে?
এই বিষয়ে মীর জুমলার উৎসাহ তৈরি করতে আওরঙ্গজেব অভিযোগ করে বলেন যে তাঁর নিজের নগদ সহ যে টাকা সম্রাট নিয়ে নিয়েছেন, তাতে তাঁর নিজের ক্ষতি হয়েছে ২০ লক্ষ টাকা। দক্ষিণী সেনাবাহিনী ৬ মাসের বেতন পায় নি। সেই সুযোগে যদি সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দেয়, তা তাহলে সম্রাট তাকে সাম্রাজ্য রক্ষার যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেটি পালন তো করতে পারবেনই না, এবং মীর জুমলার নিজের রাজ্য কর্ণাটক এবং বিশেষ করে যেখানে আদিল শাহ চেষ্টা করছেন কর্ণাটক দখল নেওয়ার, সেটির সঙ্গে অন্যান্য প্রদেশের শান্তিরক্ষা করা, খুব কঠিন হয়ে যাবে, আর মীর জুমলা নিজে সাম্রাজ্যের বাহিনী এবং দুই সুলতানের মিলিত বাহিনীর আপতিক শক্তি তো জানেনই। আওরঙ্গজেবের মনে হয়েছে গোলকুণ্ডা অভিযান তাঁর এবং তাঁর পুত্রের পক্ষে শুধুমাত্রই অপমান বয়ে এনেছে। তিনি মীর জুমলাকে বললেন এই সমস্ত তথ্য সুযোগ সুবিধে মত সম্রাটের সামনে উপস্থিত করতে। যেহেতু মীর জুমলা নিজে গোলকুণ্ডা বিষয়ে সম্রাট এবং সুবাদার কাবলি খানের খগড়া সম্বন্ধে বিশদে জানেন, ফলে উজির যখন সম্রাটকে তাঁর বক্তব্য পেশ করবেন, তখন সমস্ত দক্ষতা দিয়েই নিশ্চই সেই কাজটি সম্পন্ন করবেন। এর ফলে হয়ত সরাসরি আওরঙ্গজেবের কোন ঐহিক উপকার হবে না, কিন্তু এর মাধ্যমে যদি সম্রাটের মনে যে বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেটি দূর হয়ে যায়, সেইটুকুই তাঁর পাওনা হবে।
৭। আওরঙ্গজেব আর মীর জুমলার মধ্যে বিরোধ
দুই সঙ্গীর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনার জেরে বিরোধ তৈরি হতে থাকে। আওরঙ্গজেব জানতে পেরে উদ্বিগ্ন হয়েছেন, যে মীর জুমলা সম্রাটকে কুতুব শাহের একটি গোপন আহদানার নকল দেখিয়েছেন, যেখানে তিনি নিজের হাতে লিখে বলেছেন যে তিনি মহম্মদ সুলতানকে নিজের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাচ্ছেন।
এর পাশাপাশি মীর জুমলা ক্ষুব্ধ ছিলেন যে আওরঙ্গজেব খাস বা আম দরবার করেন না। অন্যদিকে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে জানিয়েছেন যে তাঁর সম্রাটের ওপর ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, আর যেহেতু মীর জুমলা রাষ্ট্রের বড় বড় বিষয় নিয়ে বড়ই ব্যস্ত, সেহেতু আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত জীবনের এইসব ছোটখাট সমস্যা নিয়ে তাঁর মাথা ঘামাবার সময়ই নেই। প্রকাশ্য সভায় না যাওয়ার উতর হিসেবে তিনি বলেন, সেদিন তাঁর উপবাছিল এবং দেওয়ানি আম বা খাস তখনও তৈরি হয় নি।
একই সঙ্গে আওরঙ্গজেব জানতে পারলেন যে মীর জুমলা ওমাদাতুল মুলক খান জাহান(শায়েস্তা খান)এর সঙ্গে মিলে কোন তুচ্ছ বিষয়ে সম্রাটের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেটা যদি সম্রাটের কোন নিকটাত্মীয় সম্বন্ধে তাঁর কান ভাঙ্গানোর চেষ্টা হওয়া খুব অসম্ভব। বা আওরঙ্গজেবের পাশের সুবা মালওয়া থেকে শায়েস্তা খানের বদলি হয় তাহলে তা তাঁর পক্ষে যাবে না। কিন্তু যখন মীর জুমলা সহৃদয়ভাবে বিষয়গুলি মিটমাটের চেষ্টা করতে গেলেন, সেই চেষ্টা দেখে আওরঙ্গজেব মন্তব্য করলেন, ‘যদিও মীর জুমলা(রুখউসসুলতানত, সাম্রাজ্যের স্তম্ভ)র পক্ষ থেকে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটেছে, সেটি মানবিকভাবে দেখতে হবে। সর্বশক্তিমান তাকে সফল হওয়ার মন্ত্র দান করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের বন্ধুত্ব পালনে সে সদা তৎপর। আমাদের উভয়ের বন্ধুত্ব রক্ষা এবং সেটি বিকাশে এগিয়ে আসতে হবে। খানের উকিলকে আমাদের পক্ষে আনতে হবে, যাতে সে অন্যদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে না পারে।’
এই ঘটনা সাময়িকভাবে দুজনের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল, কিন্তু কর্ণাটক নিয়ে এই ভুলবোঝাবুঝি বাড়ল, কেননা মীর জুমলার মনে হল যে আওরঙ্গজেব তাঁর জাগিরগুলি দেখাশোনা করতে খুব একটা উতসাহী নয়। এই মুহূর্তে আওরঙ্গজেব তাঁর উজিরের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না, এবং মীর জুমলার মনের দ্বিধা দূর করতে তিনি সব ঘটনা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment