জগদীশ নারায়ণ সরকার
বিভাগ ৩
ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির সঙ্গে সম্পর্ক(১৬৫৫ পর্যন্ত)
১। তাঁর নিজের পদের ভারকে কূটনীতির কাজে ব্যবহার
১৬৩৫-৩৬ পর্যন্ত মছলিপত্তনমের প্রশাসক হিসেবে মীর জুমলা ব্রিটিশেরা যে ব্যবসার সুযোগ লাভ করেছে তা উতসাহী হয়ে নজর করতেন। ১৬৩৪ সালের স্বর্ণ ফর্মান অনুযায়ী, কয়েকটি শর্তে গোলকুণ্ডা রাজ্যের সমস্ত কাস্টমস শুল্ক ছাড়ের অনুমতি পেয়েছিল তারা। এই ঘাটতি উসুল করতে মছলিপত্তনমের কৃষকদের পণ্য রপ্তানি করতে বছরে ৮০০ প্যাগোডা (৪০০ ডলার) দিতে হত। তি৮নি জানতেন এই ফর্মানটি অকার্যকর হতে পারে যদি ব্রিটিশদের ৮০০ প্যাগোডার বেশি দেয় শুল্ক হয়। তো স্বর্ণ ফর্মান হাতে নিয়ে বিনা শুল্কে ব্যবসা চালানো কোম্পানি আর তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মীর জুমলা পদক্ষেপ নিতে শুরু করলেন। তিনি ডাচেদের সঙ্গে নিয়ে এই ফর্মান অপব্যবহারের দায়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করলেন গোলকূণ্ডা রাজদরবারের সরইখাহিল আবদুল্লা খান মুজানদারানি এবং দবীর, মুল্লা ওয়ায়িসের আদালতে। তাঁর অভিযোগ ব্রিটিশদের ব্যবসাজাত কর বছরে ৮০০ প্যাগোডার বেশি। অথচ তারা ফার্মানের সুযোগ নিয়ে তা তারা দিচ্ছে না।
১৬৩৭ সালে গোলকুণ্ডার সরইখাহিল হিসেবে তাঁর রাজ্যের এই ক্ষতি পূরণের উদ্যোগ নিয়ে কঠোরভাবে স্বর্ণ ফরমানে নজরদারি চালানোর ব্যবস্থা করলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী বাস্তব এবং যুক্তি সম্মত। কিন্তু তাঁর উদ্যোগে মিশেছিল নিজের স্বার্থ সাধন, সে উদ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষতি করে হলেও। গোলকুণ্ডার আধিকারিকদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ফর্মান নিয়ে দুর্নীতি চালিয়ে গেল ব্রিটিশেরা। এই অবস্থায় দুপক্ষই অনৈতিক এবং অসাধুভাবে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে উদ্যোগী হল। কিন্তু এই অবস্থায় লাভ করলেন সব থেকে বেশি মীর জুমলাই। তাঁর সর্বময় ক্ষমতা বেআইনিভাবে প্রয়োগ করে, মীর জুমলা ব্রিটিশদের হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করলেন, এবং ব্রিটিশেরাও বুঝতে পারল(১৬৩৮, ১৮ মে) যে তিনি সেটি করছেন শুধুই অর্থ লালসায়।
ডেনেরা সরইখাহিল মীর জুমলার বাণিজ্য জাহাজ দখল করে। তাঁর প্রতিশোধ হিসেবে ১৬৪১এর সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর মাস ধরে, মছলিপত্তনমের প্রশাসক সমস্ত ব্রিটিশ জাহাজ বন্দরে ভেড়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। ১৬৪২ সালের জানুয়ারি মাসে তাদের চাহিদা পূরণ হয়ে যাওয়ায় ডেনেরা তাঁর জাহাজ ছেড়ে দিলে মছলিপত্তনমে প্রবেশ করার মীর জুমলার নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। ডাচেরা এ ধরণের অবস্থা ঘটতে পারে ধারনা করেই, সবসময় নিজেদের পণ্য জাহাজঘাটায় তৈরি রাখত এবং ছোট ছোট ছিপে করে সেগুলি নিয়ে গিয়ে জাহাজ ভরত বা পাড়ে তুলত। সেন্ট ফোর্ট জর্জের কুঠিয়ালরা (সেপ্ট ১৬৪২)পরবর্তীকালে এ ধরণের ব্যবস্থা নিতে শুরু করে।
ক্রমে ক্রমে মীর জুমলা রাজ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী হিসেবে পরিগণিত হতে শুরু করলেন, যার বন্ধুত্ব আর সাহায্য যেমন ব্যবসার ক্ষেত্রে সমৃদ্ধির সূচক আবার তাঁর ক্রোধ ঠিক বিপরীত ক্রিয়ারও জন্ম দিতে পারে – ঠিক সেই জন্যই ইওরোপিয় কুঠিয়ালরা তাকে খুসী রাখলে যে রাজনৈতিকভাবে এবং ব্যবসায়িকভাবে ফায়দা হতে পারে তা বুঝতে পারল। ১৬৪২ সালে মীর জুমলা ডাচেদের কুঠির কাজকর্ম বন্ধ করে দেন, তাদের মশলা বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও তারা তাকে ৯জন নাবিক এবং দুটি কামান, এবং গোলকুণ্ডা রাজসভাকে ৮০০০০ রিয়াল দিল তাঁর জাহাজকে পরস্য ব্যবসার জন্য। তাঁর উত্তরে ব্রিটিশেরা তাঁর জাহাজের জন্য বিভিন্ন ধরণের পেশাদার এবং তাঁর পণ্য বিনা শুল্কে বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। মীর জুমলা তাঁর পক্ষ থেকে তাদের বহু সময়ে নানান ধরণের সাহায্য করেছেন, কখনো অর্থ ধার দিয়েছেন, কখনো তাদের সুযোগ সুবিধে প্রত্যয়িত করেছেন, এবং কখনো কখনো তাঁর নিজের জাহাজ ব্যবহার করতে দিয়ে তিনি যে তাদের প্রতি সদয় সেই বার্তা দিতে চেয়েছেন। এইভাবে তিনি তাঁর পদকে নিজের ব্যবসার কাজে লাগিয়েছেন বিদেশিদের থেকে অনেক বেশি সুবিধে নেওয়ার জন্য।
২। ব্রিটিশদের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক
মীর জুমলা কখোনো কখোন ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের থেকে অর্থ ধার করতেন, নিজের ব্যবসার ঘাটতি পূরণ করতে(যেমন হিরের খনির কাজে, ব্যবসার জন্য, জাহাজ তৈরির জন্য ইত্যাদি) এবং তাঁর নিজের জোরদার সেনা বাহিনী তৈরির স্বপ্ন সার্থক করতে। ধার উদ্ধার করা ব্রিটিশদের পক্ষে খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। ১৬৩৮র শুরুর সময় থেকে ব্রিটিশেরা মীর জুমলার থেকে ৩০০০ প্যাগোডা বা ১০৫০০ টাকা পেত। ১৬৩৯ সালের আগস্ট মাসে মছলিপত্তনমের কুঠিয়াল, গোলকুণ্ডার কুঠিয়াল এন্ড্রু কোগানকে বকেয়া উদ্ধার করতে চাপ দেয়। কোগানের বিশ্বাস ছিল নবাবকে এটি আইন মোতাবেক ধার দেওলয়া হয়েছে, যথা সময়েই পাওয়া যাবে। ১৬৪০ সালের নভেম্বরে, মীর জুমলা ধারের বন্ধক স্বরূপ তিনিটি দামি গয়না পেলেন, ২০৯৯ প্যাগোদা ধারের মধ্যে ১৯১৯ প্যাগোডা ধার শুধতে অস্বীকার করলেন।
অন্য দিকে তাঁর সম্পদের ভাণ্ডার ঠিকঠাক থাকলে মীর জুমলা ব্রিটিশদের ধার দিতে কসুর করতেন না। ১৬৪২-৪৩ সালে মীর জুমলার একচেটিয়া কারবারের দরুণ মছলিপত্তনমের ধারের বাজার প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল, তখন ব্রিটিশেরা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা গোলকুণ্ডায় মীর জুমলার দপ্তর থেকে ৪ থেকে ৫ হাজার প্যাগোডা ধার নেবে ১ থেকে ২ শতাংশ সুদে এবং এটি তারা নভেম্বর নাগাদ ফিরিয়ে দেবে। তিনি মাদ্রাজে ব্রিটিশদের, ৯ মার্চ, ১৬৪৬ থেকে, ১০০০০ নতুন প্যাগোডা ধার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, সম্ভবত এটি কর্ণাটক লুঠের সম্পদ। ১৬৪৭ সালের ২৯ জুনের আগে তারা সেটা শোধ করতে পারে নি, কিন্তু তাঁর পরে শোধ দিলে তিনি কিছু সুদ মাফ করে দেন এবং তাদের থেকে ৬৪১ প্যাগোডা দামের কাঁসার বন্দুকের মত কিছু উপহারও পান।
৩। মীর জুমলার সঙ্গে ব্রিটিশদের ঝগড়া
মীর জুমলার সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্ক শুধু উত্তমর্ণ-অধমর্ণের সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল না। মীর জুমলা যেহেতু কর্ণাটক রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসক ছিলেন, সেহেতু ব্রিটিশেরা মনে করত স্থানীয়দের থেকে ধারগুলি উসুল করতে ঝামেলা পোয়াতে হবে। তারা তা উসুল করতে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৬৪০ সালে গোলকুণ্ডা এবং ভিরাভাসরম থেকে দেয় ১০০০০ প্যাগোডা উদ্ধার না হওয়ার দায় চাপায় মীর জুমলার ওপর। মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালেরা তাঁর ওপর পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করতে তাঁর জাহাজ দখল করারও পরিকল্পনা নিয়ে ফেলেছিল।
মীর জুমলার সঙ্গে ওপর ওপর সুন্দর ব্যবহার করলেও তারা মনে মনে মীর জুমলাকে ঘৃণা করত এবং তিনি যে তাদের ওপর সরাসরি চাপ দিয়ে তার কাজ উসুল করে নিতে পারেন, তাও তারা বুঝত। গোলকুণ্ডার কর্মচারীরা ব্রিটিশদের স্থানীয় উতপাদকের কাছ থেকে চুক্তি মত দাদন দেওয়া পণ্য কিনতে বাধা দিত এবং এই দীর্ঘকালীন বিবাদ তিক্ততা এবং প্রায় হাতাহাতিতে গিয়ে থামত। গোলকুণ্ডার কুঠিয়াল এবং মাল্লুভুল শহরের কিছু বিষয় নিয়ে মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালের সঙ্গে মীর জুমলার বিরোধ ঘটে(ফেব্রুয়ারি ১৬৩৮)। ব্রিটিশদের সব অভিয়োগ যে খুব একটা যুক্তিযুক্ত ছিল তা নয়। মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালের অভিযোগ ছিল যে মীর জুমলা শহরের প্রশাসককে(জুলাই ১৬৩৮) কোর্টিন এসোসিয়েশনের ক্যাপ্টেন ওয়েডেল এবং মন্টিনির বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আদতে ব্রিটিশদের দাবি ছিল স্থানীয় প্রশাসন তাদের তটভূমি দখলে বাধা দেওয়ায়, তারা যে কামান দিয়ে সেই প্রশাসনের সদর দপ্তরে হানা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই কামানের গোলা মছলিপত্তনমে আমদানির ওপরে তাদের ছাড় দেওয়া হোক।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment