জগদীশ নারায়ণ সরকার
২। মীর জুমলার কূটনৈতিক উদ্যম
সুলতানের ক্রোধান্বিত অবস্থা আন্দাজ করে, মূল ঘটনা ঘটার বহু আগে থেকেই মীর জুমলা নিজের সুরক্ষা বলয় তৈরি করার উদ্যম নিলেন। কর্ণাটকে তোলা কোন রাজস্বই তিনি কুতুব শাহকে দিতে অস্বীকার করলেন, কেননা তিনি ‘তাকে আর সুলতান মানেন না, বরং তাঁর চরমতম শত্রু হিসেবে গণ্য করেন’। কুতুব শাহের মনোভাব পরিবর্তন হবে আন্দাজ করেই তিনি তাঁর দূরদৃষ্টি অবলম্বন করে ঠিক করলেন যে তাঁর মাতৃভূমিতে তিনি ফিরে যাবেন এবং ইরাণের সম্রাটের দরবারে তিনি সব কথা বলে তাঁর মন জয় করার চেষ্টা করবেন। ১৬৫৩ সালে তিনি, পারস্যের উজির, খালিফাইসুলতানকে দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ চিঠি পেশ করে বললেন যে তাদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক বন্ধন রয়েছে তা যেন বজায় থাকে এবং তিনি অতীতের মতই আগামী দিনে শাহের সেবার জন্য প্রস্তুত। তাঁর পূর্ব সেবার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি স্বয়ং পারস্যের দ্বিতীয় আব্বাস শাহকে চিঠি লিখে আবেদন করলেন, কর্ণাটকের রাজনৈতিক অবস্থা তাঁর টিকে থাকার যদি জন্য খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নিয়ে পারস্যে চলে যেতে ইচ্ছুক। উত্তরে শাহ জানালেন যে তাঁর সব স্মরণ রয়েছে এবং উপযুক্ত সময় এলে তিনি তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু বাস্তবে ইরাণের শাহ, কুতুব শাহের বিরুদ্ধে মীর জুমলার যাওয়া সমর্থন করলেন না এবং তিনি মনে করলেন যে কুতুব শাহের সঙ্গে মীর জুমলা যেন সমস্ত বিরোধ মিটিয়ে নেন।
মীর জুমলার কাছে শাহের উত্তর অনেক পরে এল এবং এই ভাসা ভাসা উত্তর দেওয়ায় চিঠিটির বক্তব্য তাঁর মনোমত হল না। তাঁর ধারণা হচ্ছিল যে পারস্য থেকে ঠিক সময়ে তাঁর জন্য সাহায্য আসবে না। তিনি কোন ধন্ধে না থেকে তাঁর আশেপাশের পরিবেশ থেকে সুরক্ষা খুঁজতে শুরু করলেন। প্রথমে তাঁর প্রভুর একদা শত্রু রয়ালের বন্ধুত্ব চাইলেন। তিনি মনে করলেন তাঁর ঠিক পাশের শাসকই তাঁর সুরক্ষার সত্যিকারের উৎস হতে পারেন – সেজন্য তিনি যে কোন আক্রমনের হাত থেকে তাকে বাঁচাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমর্থন আদায় করলেন। ইতিমধ্যে কুতুবের বিরোধিতার অবস্থা আন্দাজ করে, বেশ কিছু যোগ্য সুলতানি সেনাপতিকে তিনি নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বিজাপুরের আদিল শাহকে জানালেন যে তিনি তাকে কর্ণাটক উপহার হিসেবে তুলে দিতে চান। আদিল শাহ স্বপ্নেও ভাবেন নি, মালিক অম্বরের মত যোগ্য সেনানায়কের পরে দাক্ষিণাত্য এ ধরণের উপযুক্ত দক্ষ কর্মচারী পাবে।
এই ধরণের কুশলী কূটনৈতিক চালে তিনি সুলতানের হাত থেকে প্রাথমিকভাবে নিজেকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করলেন যাতে নতুন ধরণের একটা স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে তুলতে পারেন। তিনি গোপনে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করলেন। তিনি যদি আগেই উতসাহী হতেন তাহলে হয়ত তাকে সাহায্যের জন্য মুঘলেরা উতসাহী হয়ে উঠতে পারত। আওরঙ্গজেব ভাবলেন মীর জুমলার মত উপযুক্ত মন্ত্রী যদি তাঁর অধীনে চলে আসে, তাহলে এই সম্পদশালী রাজ্যটি দখলের তাঁর সুপ্ত বাসনা বাস্তবে রূপ পেতে পারে। ওয়ান্ডিওয়াস দখলের সময়েই তিনি মীর জুমলাকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, পাশে পেতে। মীর জুমলা এই বার্তা অবলম্বন করে আওরঙ্গজেবের দূতকে জানালেন ‘যোগাযোগ, বন্ধুত্ব এবং ভালবাসার সমস্ত দরজা খোলা থাকবে’।
সুলতান এবং উজিরের লড়াইএর অবস্থা অনুধাবন করে আওরঙ্গজেব গোলকুণ্ডায় মুঘল হাজিব মুইজ্জুলমুলকের ভাই আব্দুল লতিফকে বাস্তব অবস্থা অবস্থা বুঝতে গোপনে চিঠি লিখলেন। মীর জুমলা তাঁর এতদিনের রক্ষণাত্মক অবস্থার মোড়ক ভেঙ্গে, সাম্প্রতিক শত্রুদের বিরুদ্ধে কূটনৈতিভাবে আক্রমণাত্ম হওয়ার পরিকল্পনার ছক তৈরি করলেন। আদিল শাহের হাতে নিদারুণ হার, এবং গাণ্ডিকোটা উপহারের ফলে লুটোনো সম্মান উদ্ধারের হাতিয়ার হল চরম কূটনৈতিক চাল। বিজাপুরী সেনানায়ক খান মহম্মদকে জিঞ্জির হয়ে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়া, মহীশূরের সঙ্গে চক্রান্ত করা এবং রয়ালের সঙ্গে যেচে বন্ধুত্ব এই সবই তাঁর কূটনৈতিক চাল হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। তবে তাঁর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পদক্ষেপটি হল রয়ালের হয়ে আওরঙ্গজেবের মার্ফত গোপনে মুঘল শক্তির সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা খোলার কাজ। যাহুর লিখছেন, ‘ভেল্লোর দূর্গে শ্রীরঙ্গ ঝামেলা তৈরি করলেন, এবং তিনি মীর জুমলার সঙ্গে চিঠি আদানপ্রদান করে ঠিক করলেন যে তিনি এবং তাঁর উকিল মার্ফত মুঘলদের --- পেশকাশ দেবেন। এই বিষয়ের সমস্ত দায় সামলানোর ভার মীর জুমলা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। তিনি রাজার হয়ে মুঘলদের সমস্ত রকম প্ররোচনা দিতে শুরু করলেন।’ ১৬৫৩ সালে মীর জুমলার মন্ত্রণায় রয়াল, গোপনে তাঁর ব্রাহ্মণ দূত শ্রীনিবাসকে আওরঙ্গজেবের হয়ে পাদশাহের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে পাঠালেন এই সমঝোতায় যে তিনি শুধু যে ইসলাম গ্রহণ করবেন তাই নয়, বছরে ৫০ লক্ষ হুণ, ২০০টি হাতি এবং কিছু দামি অলঙ্কার উপঢৌকন হিসেবে দেবেন, তাঁর বদলে তিনি সুলতানের থেকে সুরক্ষা দাবি করেন।
এই পদক্ষেপে মীর জুমলা যে তাঁর দুর্দিনে শুধু রয়ালের আনুগত্য অর্জন করলেন তাই নয়, তিনি আদিল শাহ এবং তাঁর নিজের সুলতান কুতুব শাহের বিরুদ্ধেও কূটনৈতিকভাবে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন। মীর জুমলার মধ্যস্থতার দৌত্য আওরঙ্গজেবের কাছে দাক্ষিণাত্যে নতুন সম্ভাবনা দ্বার উন্মুক্ত করে দিল। রয়ালের ইসলামে রূপান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব যেমন আওরঙ্গজেবকে সাহায্য করল দক্ষিণে আরও বড় করে ইসলামের ছত্র বিস্তারের কাজে তেমনি কর্ণাটকের যুদ্ধের লুঠতরাজের পরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দুই সুলতানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার কাজ করল যাতে তারা তাকে এত দিন না দেওয়া পেশকাশ ঠিকঠাক পরিমানে দেন। মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে রয়ালের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মানে, শুধু যে ইসলামের বিস্তার তাই নয়, বিপুল সম্পদ অর্জনের পথ খোলা। এ ছাড়াও নিজের দিকে মীর জুমলাকে টেনে আনার সুযোগও তৈরি হল।
আওরঙ্গজেব তাঁর হাজিবকে মীর জুমলার – যিনি বরাবরই মুঘল সাম্রাজ্যের সভায় আনুগত্য দেখিয়েছেন, সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য দায়িত্ব দিলেন, এবং নির্দেশ দিলেন প্রয়োজনে বদান্যতা প্রদর্শন করতে, যাতে মীর জুমলা সাম্রাজ্যের সেনা বাহিনীর অংশ হয়ে ওঠেন। এর সঙ্গে তিনি মীর জুমলার সম্পদ এবং তাঁর বাহিনীর বিষয়ে সমীক্ষাপত্র পেশ করতে নির্দেশ দিলেন। তিনি চেষ্টা চালালেন যাতে পাদশাহ নিজে মীর জুমলাকে নিজের দিকে আনার জন্য উতসাহী হন। কেননা পাদশাহের হাত বাঁধা ১৬৩৬ সালের আহদ(চুক্তি) অনুযায়ী, যে চুক্তিবলে তাঁর পক্ষে সুলতানের কোন আধিকারিককে সাম্রাজ্যের কাজে(ফুসলে) নেওয়ার সুযোগ ছিল না। দারাও মীর জুমলাকে মুঘল বাহিনীতে নেওয়ার বিরোধী মত প্রকাশ করে। আওরঙ্গজেবের যুক্তি ছিল মীর জুমলা গোপনে বহুবার তাঁর আবেদন পেশ করেছেন যাতে তাকে সাম্রাজ্যের অংশ করে নেওয়া হয় এবং তিনি তাঁর প্রাণ দিয়ে সাম্রাজ্যের সেবা করবেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর আগেও যতদূর সম্ভব মীর জুমলার দূত ঈমান ওয়ার্দি বেগ সম্রাটের কাছে একই আবেদন পেশ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মীর জুমলার সাম্রাজ্যের প্রতি আত্মনিবেদনে সন্তুষ্ট হয়ে সম্রাট তাকে সান্ত্বনা দিয়ে আওরঙ্গজেবকে নির্দেশ দিলেন যে তাঁর জন্য যা কিছু করার দরকার, করতে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত সরাসরি পাদশাহ মীর জুমলাকে সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতে নেওয়ার কোন প্রতিশ্রুতি দেননি। সম্রাটের বার্তা পেয়ে তৎক্ষণাৎ আওরঙ্গজেব মীর জুমলার সাহায্য এবং সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী মুঘল বাহিনী পাঠিয়ে দেন এবং নিশ্চিত করেন কোনভাবেই যেন সুলতান তাকে মুঘল পক্ষে যোগ দিতে বাধা সৃষ্টি না করতে পারেন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment