জগদীশ নারায়ণ সরকার
এই ঘটনায় দুইজন প্রধান চক্রান্তকারী, প্রথমজন দাক্ষিণাত্যের উচ্চাকাঙ্ক্ষী মুঘল সুবাদার অন্যজন প্রত্যাঘাত করতে চাওয়া গোলকুণ্ডার পারসিক উজির। এই দুজনে মিলে ব্যক্তিগত দূত মহম্মদ আরফকে দিয়ে ইঙ্গিতে পাঠানো উভয় পক্ষেরে মৌখিক আলাপ এবং গোপন চিঠি চাপাটি মার্ফত গোলকুণ্ডা দখলের অবস্থা তৈরি করেছিলেন। মীর জুমলার আন্তরিকতা এবং বিশ্বাসের প্রতি দাদ দিয়ে তাকে আওরঙ্গজেব লিখলেন, দুমুখোটি(কুতুব শা) উচিত শাস্তি পাবে... তাকে আমি সঠিক সময়ে তোমার সঠিক পরামর্শ নিয়ে সমূলে উচ্ছেদ করব। মীর জুমলাকে বলা হল কুতুব শাহের সরইলস্কর এবং অন্যান্য সেনাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ভড়কাতে, কেননা তাদের সঙ্গে জোট বাঁধা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হবে। এবং মীর জুমলা যখন কর্ণাটক ছাড়বেন, তখন যেন তিনি রয়ালকে তাঁর পক্ষে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। ছোট করে আররঙ্গজেব লিখলেন, ‘যে কোন মূল্যে শত্রুর থেকে তোমার সব ক’টি পদক্ষেপ গোপন রাখ। বিভিন্ন অঞ্চলে যা সব ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে তা সংগ্রহ কর। তোমার যে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার ২/৩ মাস আগে থেকে আমায় সতর্ক কোরো এবং খুব বেশি দেরি কোর না।’ তিনি আরও লিখলেন, ‘আমি চাই লোকে দেখুক আমি তোমায় কতটা বিশ্বাস এবং পক্ষপাত করছি আর তারা ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে মরুক।’ মীর তাঁর পক্ষ থেকে আওরঙ্গজেবকে জানালেন যে তিনি যেন গোলকুণ্ডা আক্রমণ করেন, সেখানকার প্রধান অমাত্য বা দবীর তাঁর আত্মীয় এবং আক্রমণকারী সেনাকে দৈনিক ৫০০০০ টাকা ভর্তুকি দিতে প্রস্তুত।
চক্রান্তীদের যে পরিকল্পনা তৈরি হল তা এইঃ
১) কুতুব শাহকে মীর জুমলার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে, সে যদি অমান্য করে,
২) মহম্মদ সুলতান হায়দ্রাবাদে গিয়ে বন্দীদের শক্তি প্রয়োগ করে মুক্ত করবে, প্রয়োজনে মীর জুমলার জন্য অপেক্ষা করবে সেখানে,
৩) যদি আদিল শাহ, কুতুব শাহকে আমিনকে ছাড়ানোর বিরোধিতা করতে (সামরিক )সাহায্য করতে আসে তাহলে ব্যক্তিগতভাবে আওরঙ্গজেব সেখানে যাবেন,
৪) মীর জুমলা কর্ণাটকে তাঁর সব বাকি কাজ শেষ করে ফেলবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তাঁর বিশ্বস্ত প্রশাসকেদের বাকি কাজের দায়িত্ব দিয়ে তিনি গোলকুণ্ডার দিকে তাঁর সাঁজোয়া সেনাসহ কাজ উদ্ধারে(আসল মকসদ), গোলকুণ্ডা দখল করতে রওনা হবেন।
গোলকুণ্ডা দখলে মীর জুমলা এবং আওরঙ্গজেব শাঁড়াশি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন – মীর জুমলা দক্ষিণ থেকে এবং আওরঙ্গজেব উত্তর থেকে। তিনি মীর জুমলাকে লিখলেন, ‘আমার মনে হয় তাঁর রাজধানী ছিনিয়ে নেওয়ার এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।’ সত্যকারের আওরঙ্গজেব যেভাবে পাদশাহকে লিখেছিলেন, সুসজ্জিত হয়ে রণনিপুন পদাতিক, বিপুল হস্তি বাহিনী এবং সাঁজোয়া গোলান্দাজ সেনা নিয়ে মীর জুমলা যদি কর্ণাটক গোলকুণ্ডা থেকে আক্রমণ করেন, সেটা বোধহয় হবে সোনালি সুযোগ, যা আর দ্বিতীয়বার আয়োজিত করা যাবে না। আর এই পরিকল্পনার সাফল্য নির্ভর করছিল দুই বাহিনীর দু দিক থেকে মুহুর্মুহু দ্বিধা হীন আক্রমন করার ওপর, এবং সেই জন্য বার বার আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে বলেছেন যে, সময় এবং অবস্থার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে এবং কোন রকম দেরি ছাড়া এগিয়ে যেতে আর তাঁর সমস্ত পদক্ষেপ আওরঙ্গজেবকে জানাতে এমন কি কবে - কোন তারিখে তিনি হায়দ্রাবাদের পৌঁছতে পারবেন তাও অগ্রিমভাবে জানাতে।
পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার দায় গিয়ে পড়ল আওরঙ্গজেবের ওপর। ১৬৫৫ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি, সমস্ত নীতি ও আনুগত্য বর্হিভূত হয়ে মহম্মদ আমিনকে গ্রেফতারের দায়ে দায়ি করে কুতুব শাহকে একটি নিশান পাঠিয়ে তাঁকে এবং তাঁর পরিবারবর্গকে মুক্ত করার, বাজেয়াপ্ত সম্পদ তাঁর দূত মীর আবদুল কাশেমের (সাজোঁয়া বাহিনীর পরিদর্শক) এবং নিশান বাহক সঈদ আলির হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি সাবধান করে বললেন, এই আদেশ আমান্য করলেই শাহজাদা মহম্মদ গোলকুণ্ডা আক্রমন করতে বাধ্য হবেন। কুতুব শাহ, আদিল শাহের সঙ্গে চুক্তির বলে, মদ্যপান জনিত কারণে এবং প্রবল আত্মঅভিমানে সম্রাটের ৩ ডিসেম্বরের ফর্মান এবং আওরঙ্গজেবের ২০ ডিসেম্বরের নিশান অগ্রাহ্য করলেন। এছাড়াও তিনি নিজের দুর্বুদ্ধিতায় হায়দারাবাদ এবং ইন্দৌরের সীমান্তে গন্ডগোল লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব ২৬ ডিসেম্বর মহম্মদ সুলতানকে পাঠালেন গোলকুণ্ডার উদ্দেশ্যে এবং তেলেঙ্গানার উপপ্রশাসক হাদিদাদ খাঁকে নান্দেরে ১০০০০ পদাতিক নিয়ে তাঁর সঙ্গে জমায়েত হতে নির্দেশ দিলেন। মীর ফজলুল্লার সন্তান আসাদুল্লাকে চান্দার জমিদারের উদ্দেশ্যে ৫০০ ঘোড়সওয়ার নিয়ে পাঠিয়ে তাঁর সঙ্গে সীমান্তে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং মীর জুমলা যদি সেই পথে আসেন তাহলে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে রাজধানীতে যেতে বললেন। আদিল শাহ যদি কোন গন্ডগোল না করেন, তা হলে আওরঙ্গজেবের অঙ্ক হল এই ঘটনাটা খুব সহজেই মিটিয়ে নেওয়ার। কিন্তু এদিকে সরাসরি জানাগেল আদিল শাহ, কুতুব শাহকে সাহায্য করার জন্য তোড়জোড় করা শুরু করেছেন, ফলে আওরঙ্গজেব সম্রাটের কাছ থেকে নির্দেশ চাইলেন যাতে তিনি তাঁর গোলকুণ্ডা অভিযানের পরিকল্পনা অবিলম্বে মঞ্জুর করেন এই যুক্তিতে যে কুতুব শাহ সম্রাটের নির্দেশ সত্ত্বেও আমিনকে চাড়ে নি।
এ দিকে মহম্মদ আমিনের গ্রেফতারির খবর পেয়ে শাহজাহান কুতুব শাহকে একটি জরুরি চিঠি লিখে আমিনকে ২/৩ দিনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ২৯ ডিসেম্বর সম্রাট আওরঙ্গজেবকে জানান যে তাঁর বিশ্বাস কুতুব শাহ আমিনকে ছেড়ে দেবে, কিন্তু তিনি তার পুত্রকে বলেন সব ধরণের সিদ্ধান্তের পথ খোলা রাখতে এবং আওরঙ্গজেবকে শান্ত করতে তিনি বলেন যদি দেখা যায় গোলকুণ্ডা তাঁর নির্দেশ অমান্য করছে তাহলেই কেবল মাত্র তিনি যেন আক্রমণের পথ ধরেন। কুতুব শাহ মীর জুমলাকে যে কোন মূল্যে ধরতে চাইলেন। এদিকে মালওয়ার প্রশাসক শায়েস্তা খাঁকে তাঁর মনসবদারদের নিয়ে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। দুটো চিঠিই আওরঙ্গজেবের হাতে পৌঁছল ৭ জানুয়ারি, ১৬৫৬। তিনি তুলির আঁচড়ে গোলকুণ্ডা ধ্বংস করতে উদ্যোগী হলেন। শাহজাহানের ২৪ তারিখের বন্দী মুক্তির চিঠি কুতুব শাহের হাতে পড়ার জন্য অপেক্ষা না করেই ৩ ডিসেম্বরের সম্রাটের চিঠি অমান্য করায় শাহেনশাহের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে ফলে তাঁর আর গোলকুণ্ডা আক্রমণ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই বলে কুতুব শাকে জানালেন। মীর জুমলাকে বললেন, সুলতান যদি নিজের হাতে বন্দীদের মুক্ত না করে, আওরঙ্গজেব নিজে গিয়ে বন্দীদের মুক্ত করাবেন। তিনি নিজের অভিযান বন্ধ করে তাঁর পুত্রকে হায়দারাবাদের দিকে কুচ, এবং যদি তারা বন্দী থাকেন তাহলে তাদের অবিলম্বে মুক্ত করার নির্দেশ দিলেন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment