জগদীশ নারায়ণ সরকার
৩।নতুন ব্যবস্থায় মীর জুমলার মনোভাব
কর্ণাটকে তাঁর বিজয়ের ফল ধরে রাখতে মীর জুমলা বদ্ধ পরিকর, এখন সেটি মুঘল সাম্রাজ্যের অধীন, তাঁর জায়গির রূপে পরিগণিত। আমর আগেই দেখেছি, কর্ণাটকে নিজের প্রশাসনিক পকড় আরও গভীর করতে, এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সম্পদ একত্রিত করতে, আওরঙ্গজেবের গোলকুণ্ডা দখলের ডাকে তিনি কত দেরি করে এসেছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের উজিরের পদে যোগ দেওয়ার পরেও কর্ণাটকের নানান বিষয়ে তিনি গভীর মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু বাস্তবিকভাবে কর্ণাটকের ঘটমান বর্তমান থেকে বহু দূরে ছিলেন তিনি, অথচ তাঁর পুরোনো শত্রুরা নিজেদের কূটনীতি আর পরস্পরের মধ্যে জোট করে দাঁত-নখ শানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল কর্ণাটক দখলে, ফলে সরাসরিভাবে কর্ণাটক দেখভালে, তাঁর ঈর্ষান্বিত জোটবাঁধা শত্রুদের থেকে কর্ণাটক বাঁচাতে তাঁকে সরাসরিভাবে নির্ভর করতে হচ্ছিল আওরঙ্গজেব আর কিছু বিশ্বস্ত কর্মচারীর ওপর। কর্ণাটক যেহেতু এখন মুঘল অঞ্চল, তাঁর মনে হল সেটি মুঘল সেনাবাহিনীর সুরক্ষায় থাকবে। কাবিল শাহের স্তোকবাক্যে তাঁর ধারণা হয়েছিল আওরঙ্গজেবও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। মীর বারবার আওরঙ্গজেবকে তাঁর জায়গির কিভাবে সামলাতে হবে সে বিষয়ে বিশদ নির্দেশনামা পাঠাচ্ছিলেন। বিশেষ করে ডাকচৌকি নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন এবং আওরঙ্গজেবের হাজিবকে নির্দেশ দেন এগুলি নতুন করে গড়ে তোলার। আওরঙ্গজেব তাঁর বন্ধুর অনুরোধে সাড়া দিচ্ছিলেন, যদিও কিছু কিছু তাঁর ইচ্ছের বাইরে হছিল, তবুও তাঁকে চিন্তা করতে বারণ করেন। কিন্তু কুতুব শাহের দখলদারি মনোভাব বাড়তে থাকায় মীর জুমলার চিন্তা বাড়ল বই কমল না; ফলে তাঁর মনে হল আওরঙ্গজেব তাঁর নির্দেশ মানছেন না এবং জায়গির নিয়ে তার উৎসাহ কম।
৪। মীর জুমলার সন্দেহ দূর করার উদ্যম নিলেন আওরঙ্গজেব
ফলে আওরঙ্গজেবকে মীর জুমলার সন্দেহ দূর করতে গা ঘামাতে হয়েছিল। যখন তাঁর পিতা সম্বন্ধে আওরঙ্গজেব খুব কড়া মন্তব্য এবং চড়া মনোভাব প্রকাশ করতেন, সেখানে কর্ণাটক বিষয়ে তাঁর পিতার সিদ্ধান্তে তিনি নরম সুর প্রকাশ করায়, কর্ণাটক বিষয়ে তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে মীর জুমলার সন্দেহ জাগে। মীর জুমলাকে আশ্বস্ত করার ভাষাটিও একই নরম সমঝোতার ধরণের বলে মনে করলেন। তিনি তাঁর শত্রুদের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গ, পরশ্রীকাতরতা এবং মিথ্যাচারের অভিযোগ আনলেন, বললেন শয়তনি পরিকল্পকদের পরিকল্পনায় কর্ণাটকের কি হাল হয়েছে তা বর্ণনা করলেন এবং বিষয়টা শান্ত রাখতে তাঁকে কোন কোন পদক্ষেপ করতে হয়েছে তাও তিনি বললেন। তাঁর বন্ধুকে উদ্বিগ্নতা থেকে উদ্ধার করতে তিনি গোয়েন্দা সমীক্ষা, আমলা আর অন্যান্য শুভচিন্তকদের দেওয়া অভিযোগপত্র এবং সম্রাটকে পাঠানো তাঁর আবেদনপত্র মীরজুমলাকে লেখা চিঠিতে জুড়ে দিলেন। ১৬৫৬ সালের আগস্ট মাসে উজিরকে তাঁর পদক্ষেপে আস্থা পেশ করতে বলে লিখলেন, ‘সাম্রাজ্যিক সমস্ত কাজে চিন্তামুক্তভাবে জুড়ে থাক, ভেবোনা আমি তোমার ভাল চাই না। (কবিতা) তুমি সকলের হৃদয়ে রয়েছ। কেউ তোমার সমকক্ষ নয়।’
এ ছাড়াও অরেক চিঠিতে তিনি লিখছেন, সম্রাটের তাঁর ওপর অবিশ্বাসে নানান কাজে তাঁর হাত বাঁধা থাকা সত্ত্বেও তিনি কিভাবে সদা সতর্কভাবে, সুচারুরূপে কর্ণাটকে সেনার পরিমান বাড়ানো এবং কিলাদার এবং সীমান্তে থাকা সেনানায়কদের দায়-দায়িত্ব পালন এবং সদা সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন। বারবার তিনি উজিরকে বলেছেন তিনি কোনভাবেই তাঁর জায়গিরের ব্যবস্থাপনায় ঢিলে দিচ্ছেন না এবং তাঁর শত্রুদের আক্রমণকে তিনি কোঁনভাবেই ছোট করে দেখছেন না, যতটুকু পদক্ষেপ করার করছেন।
৫। মীর জুমলার কর্ণাটক বাঁচানোয় আওরঙ্গজেবের পদক্ষেপ সমূহ
বাস্তবে, মীর জুমলার অনুপস্থিতিতে যে দুর্যোগের পরিবেশ তৈরি হয়েছে কর্ণাটকে তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার কাজ করেছেন বন্ধু আওরঙ্গজেব। গোলকুণ্ডায় মুঘল হাজিব কাবাদ বেগকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তিনি হায়দ্রাবাদ এবং সিদ্ধাঔতের মধ্যের ডাকচৌকি স্থাপন করেন। দেওয়ান মুর্শিদকুলি খানকে প্রবীন আমলা মহম্মদ তাহিরকে নির্দেশ দিলেন তুহুলদারদের আওতায় থাকা গোমস্তাদের বকেয়া কাজগুলি সম্পাদনে সচেতন করে দেওয়ার। তিনি আগ্রাসী সুতলানকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন যে কোনভাবেই যেন বর্তমান স্থিতাবস্থা ভাঙ্গা না হয় এবং মীর জুমলা দিল্লি না পৌছলে কোন প্রশাসনিক রদবদল এবং ডাকচৌকির ওপর হামলাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। সম্রাটের ফরমান ছাড়া সুলতানের কর্ণাটক দখল করা শুধু হঠকারী হবে তাই নয় অপরিণামদর্শীও হবে বলে হুঁশিয়ারি দিলেন। যদি মীর জুমলা তাঁর বিরুদ্ধে সম্রাটের কানে অভিযোগ তোলেন, তাহলে কিন্তু কর্ণাটকে আগুণ জ্বলতে পারে। তিনি সুলতানকে বললেন কর্ণাট সীমান্ত থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়ে সম্রাটের নির্দেশের অপেক্ষা করুণ। বারংবার আওরঙ্গজেবের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও দারার উস্কানিতে সুলতান ডাকচৌকির ওপর হামলা বন্ধ করলেন না এবং সীমান্ত থেকে আবদুল জব্বারকে সরিয়েও নিলেন না। তখন আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে এই কথাগুলি জানিয়ে তাঁর গভীর চিন্তা প্রকাশ করলেন। মীর জুমলা এই বিষয় নিয়ে সরাসরি সম্রাটের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেই নির্দেশক্রমে আওরঙ্গজেব সুলতানকে জানালেন, কয়েকজনকেমাত্র মহালগুলির প্রশাসনে রেখে তিনি যেন আবদুল জব্বারকে সীমান্ত থেকে তুলে নেন এবং ইসমাইল বেগের নেতৃত্বে বাহিনী পাঠিয়ে ডাকচৌকিগুলি সারানোর ব্যবস্থা করেন। মীর জুমলা সম্রাটের কাছে জোর আর্জি পেশ করেন যে মহম্মদ শরিফকে হায়দ্রাবাদের পাঠিয়ে ডাকচৌকিগুলি সারাবার ব্যবস্থা করা হোক এবং আওরঙ্গজেবকে অনুরোধ করলেন তাঁর দূত মার্ফত সুলতানকে এবিষয়ে চিঠি পাঠাতে। নিজের লেখা চিঠি এবং মহম্মদ শরিফ মার্ফত(আগস্ট ১৬৫৬) আওরঙ্গজেব সুলতানকে হুঁশিয়ারি দিলেন যাতে তিনি সম্রাটের ফরমান অবজ্ঞা না করেন। উদ্বিগ্ন মীর জুমলা কাবাদ বেগকে ডাকচৌকি সারানোর কাজে দেরি হওয়ায় দোষী ঠাওরালেন। এই এবং নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্দেশ অমান্য করা অযত্ন, অদক্ষ এবং দীর্ঘসূত্রী মনোভাবের জন্য তাঁকে দায়ি করলেন। মীর জুমলার অনুরোধে তিনি কাবাদ এবং তাঁর হিন্দু বন্ধুদের শাস্তির ব্যবস্থা করলেন যাতে এই উদাহরণে সংশ্লিষ্টদের চৈতন্য হয়। তাঁকে হাজিবের পদ থেকে সরিয়ে আহমদ বেগকে নিয়োগ করা হল এই মনোভাবে যে তিনি নির্দেশ সঠিকভাবে পালন করবেন এবং ঘটনাবলী আর সুলতানের মনোভাব আর চাহিদা সম্বন্ধে সম্রাটকে সঠিক এবং তথ্যসন্ধানী সমীক্ষা পাঠাবেন। ১৬৫৬র শেষের দিকে আওরঙ্গজেব নির্দেশনামা জারি করে বললেন যে খানের(মুয়াজ্জম খান, মীর জুমলা) নামে হায়দ্রাবাদ থেকে কর্ণাটকের মধ্যে যে ক’টি ডাকচৌকি রয়েছে সেগুলি ঠিকঠাক চালাতে এবং তাঁর সুরক্ষা দান করতে সরাসরি সাম্রাজ্যের সেবায় অন্তর্ভূক্ত হল (সরকারইজাহানমদার) এবং কুতুব খানকে এ বিষয়ে সাবধান থাকতে বললেন।
কাম্বামের ব্যাপারটা আওরঙ্গজেব সমাধান করতে গেলে নিজের জামাই মার্ফত আওরঙ্গজেবকে সুলতান অনুরোধ পাঠিয়ে বলেন সেখানে যেন তিনি ইসমাইল বেগকে না পাঠান। শাহজাদা এই চিঠিটা আওরঙ্গজেবকে পাঠিয়ে দিলেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুরকে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়ে রাখলেন ‘তাঁর শয়তানি অযত্নের ফল তিনি পাচ্ছেন এবং তাঁর ফলে কর্ণাটকে যদি কোন হানি ঘটে বা গোলযোগ শুরু হয়, তাহলে তাঁর ফল ভোগ করবে আপনার উত্তরাধিকারী(তাজালউল কাওয়াঈদ উইলিয়ত মাউরুসি)’।
আওরঙ্গজেব, সুলতানের হিন্দু বিদ্রোহে উসকানির বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, ‘এই বিদ্রোহের কি কারণ আমি বুঝতে পারছি না, যার ফল শুধুই ক্ষতি এবং তুমি আর তোমার জমিদারেরা এই অব্যবস্থা থেকে কোন লাভ পাবে? জমিদারদের সতর্ক করতে চিঠি লেখ, তোমার আধিকারিকদের তুলে নাও নাহলে... তুমি লজ্জায় নিজের দাঁতে নিজের আঙুলই কাটবে।’ যখন শুনলেন যে কর্ণাটকের ভার মীর জুমলার হাতে দেওয়া হয়েছে, তিনি হাজি শফি মার্ফত প্রত্যেককে, বিশেষ করে জমিদারদের, কর্ণাটকে থাকা তাদের সেনাপতিদের, সেখানকার মুঘল আধিকারকদের(কাজি মহম্মদ হাশিম, কৃষ্ণা এবং খ্বাজা মহম্মদ আরিফ কাবাদ বেগ হাজিব) এবং কুতুব শাহকে চিঠি লিখলেন। বিশেষ করে রয়ালকে লেখা চিঠিতে ভয় এবং আশার(বিম ও উমিদ) কথা বললেন। কাজি মহম্মদ হাশিম, কৃষ্ণা এবং অন্যান্যদের নেতৃত্বে একটি মুঘল বাহিনী সিদ্ধাঔতে গিয়ে আবদুল জাব্বারকে পরাজিত করল। কিছু দিনের জন্য হতাশায় এবং ক্ষতিতে সুলতান নিজেকে সংযত রাখলেন। ডাকচৌকি আগের মত কাজ করতে লাগল।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment