জগদীশ নারায়ণ সরকার
৪। মীর জুমলার বৈদেশিক বাণিজ্য
দৈনন্দিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ডুবে থেকেও মীর জুমলা তাঁর অমিত সম্পদ, তাঁর সমৃদ্ধি, তাঁর ক্ষমতার উৎস - বৈদেশিক বাণিজ্যের দিকে নজর দিতে ভুলে যান নি। প্রাথমিকভাবে খুব ছোট্ট করে শুরু করেছিলেন তাঁর ব্যবসা। ১৬৫০এর শেষের দিকে সেই দেশিয় এবং বৈদেশিক ব্যবসা বিপুল কলেবর লাভ করে। ১৬৫১সালের জানুয়ারির হিসেবে তাঁর ব্যবসায় কাজ লাগত ৪০০-৫০০ উট, ৪০০০ ঘোড়া এবং ৩০০টি হাতি আর ১০,০০০ যাঁড়। এই ব্যবসা-বাহিনী তাঁর পণ্য গোলকুণ্ডা এবং বিজাপুরে এমনকি মুঘল সাম্রাজ্যে পৌঁছে দিতে সাহায্য করত। প্রায় প্রত্যেক(ব্যবসায়িক) যায়গায় তাঁর নিজস্ব দালাল এবং নিজস্ব ব্যবসায়ী বসানো ছিল। এছাড়াও তিনি বাণিজ্য করতেন ১) বর্মা – আরাকান, পেগু, টেনাসেরিম(মারগুই দ্বীপপুঞ্জ), ২) আচে, পেরুক, মাকাসসার এবং মালদ্বীপ, ৩) পারস্য এবং আরব, ৪) বাঙলার সঙে। তাঁর সামুদ্রিক বাণিজ্যের জাহাজ ছিল ১০টি, এবং ক্রমশঃ তার সংখ্যা তিনি বাড়াতে থাকেন, পূর্ব উপকূলের নর্সাপুরে তাঁর বিপুলাকায় জাহাজগুলি তৈরি হত। ১৬৩৮ সালের জুলাই মাসে ৮০০ টনের একটি বিশাল জাহাজ (জাঙ্ক) তৈরি করেন পারস্য বা মোকায় পণ্য রপ্তানি করার জন্য এবং তাঁর কারখানার চিঠিচাপাটিতে এই জাহাজটির নাম উল্লিখিত ছিল সর-ই-খাহিলের ‘বিশাল’ জাহাজ হিসেবে।
যেহেতু তাঁর ধারণা ছিল বিজয়নগরের নাবিকেরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে জন্য তিনি তাঁর জাহাজে ব্রিটিশ আর ডাচ নাবিক নিযুক্ত করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল, রজার এডামস(১৬৪২), রিচার্ড ওয়ালউইন(১৬৪৭), জন গাইটন(১৬৪৬), টমাস বোস্টক(১৬৫০)। কিছু মুসলমান নাবিকও ছিল – মুবারক টুকিল জাহাজের নেতৃত্বে ছিল মুহম্মদ বেগ পেগু যেতেন, ছিল নাখুদা নুরা, যেতেন আচে, নাখুদা মুল্লা হাসান যেতেন গম্ব্রুন।
সামুদ্রিক সওদাগরি ক্রমশ বাড়তে থাকা সত্ত্বেও সব থেকে বড় দুর্বলতা ছিল, সমুদ্র সেনাবাহিনীর অভাব এবং নির্ভর করতে হত ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির ছাড়পত্রের ওপর। ১৬৫১ সালে মীর জুমলা এবং গোলকুণ্ডার সুলতান পর্তুগিজদের থেকে সামুদ্রিক ছাড়পত্র নেওয়া বন্ধ করে দিলেও মাদ্রাজ ঘেরাওয়ের সময়ে(১৬৫৭, সেপ্ট – ১৬৫৯ এপ্রিল), মীর জুমলা নিজের সমুদ্রগামী জাহাজের জন্য ছাড়পত্র চাইলে ব্রিটিশেরা তা দিতে অস্বীকার করে।
মীর জুমলা বার্মার সঙ্গে বড় করে ব্যবসা করতে চাইতেন। বার্মাতে ছিল সারাবিশ্বের চাহিদাবন্ত সব থেকে ভাল চুণি আর নীলকান্তমণি। বার্মার গালা(গামল্যাক)র গুণমান ভারতের তুলনায় উচ্চশ্রেণীর ছিল। মারটাবান জার, সোনা, তামা, টিন, কুইকসিলভার, গানজা(কাঁসা) এবং বেনজয়েন(লাবান?) এখানে পাওয়া যেত। গোলকুণ্ডার মন্ত্রী থাকার সময় তিনি হাসান খানকে পেগু পাঠিয়েছিলেন শ্বেত হাতির দেশের রাজার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য। পরের দিকে তিনি বার্মার রাজাকে অনুরোধ করেন, গোলকুণ্ডার নাবিক, মুহম্মদ বেগ এবং তাঁর নিজের জাহাজকে পেগুতে বাৎসরিক ব্যবসার সুযোগ দিতে। মীর জুমলা অনেক সময় ব্রিটিশ ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী(১৬৪৭ সালে রিচার্ড কোগান)দের পেগুতে তাঁর হয়ে ব্যবসা করার জন্য নিযুক্ত করতেন, যা ব্রিটিশদের ব্যবসার থেকে অনেক বেশি লাভজনক ছিল। মীর জুমলার নিজস্ব অতিকায় জাহাজ মছলিপত্তনম থেকে নিয়মিত পেগুতে যেত এবং তাঁর কর্মচারী এবং দালালেরা অনেকসময় ডাচেদের জাহাজে(১৬৫৩) যাতায়াত করে পেগুর সঙে ব্যবসায়িক সম্বন্ধ বজায় রাখত। ১৬৫১ সালে পেগু চিনা আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে গেলে মীর জুমলা আর ডাচেদের বিপুলভাবে ব্যবসা মার খায়। ১৬৫৩ সালে পেগুর রাজা অচেনা(বিদেশি?)দের টিন আর হাতির দাঁত বিক্রি বন্ধ এবং কাঁসা রপ্তানি ব্যবসা কতিপয় ব্যবসায়িদের দখলে দিয়ে দেন।
আরাকান হাতির জন্য বিখ্যাত ছিল। মীর জুমলা আরাকান রাজ, ধর্মরাজকে অনুরোধ করেন তাঁর কর্মচারীদের আবাধে ব্যবসার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তাঁর বিশেষ অনুরোধে রাজা, শাহজাহানের চর সন্দেহে কারাগারে বন্দী সাত ইরাকিকে ছেড়ে দেন। এছাড়াও দীর্ঘদিন আরাকানের কারাগারে কিছু মুঘল বন্দীকে ছেড়ে দেওয়ারও এবং আরাকানকে মুক্ত বাণিজ্যের নীতি লাগু করতে অনুরোধ করেন। তাঁর যুক্তি তা হলেই আরাকান বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠতে পারে। মীর জুমলা পূর্ব উপকূলে পাঠানো সে দেশের চারটি হাতি কেনেন এবং তাঁর সঙ্গে রাজার পাঠানো একটি অতরিক্ত হাতিও উপহার পান।
পূর্ব উপকূলের ক্যালিকোর বদলে মীর জুমলা ইস্ট ইন্ডিজের মশলা, দাস, মাকাসসারের চাল, পেরুকের টিন এবং মালদ্বীপের কড়ি সংগ্রহ করতেন।
তাঁর বাণিজ্যের শৃংখলে পারস্য খুব বড় অংশ ছিল। প্রত্যেক বছর বিভিন্ন আকারের জাহাজে তিনি বিপুল পরিমানে পণ্য ভারতের পূর্ব উপকূল থেকে পারস্যের পানে পাঠাতেন। যতক্ষণনা সর-ই-খাহিল বা উজিরের সব ক’টি জাহাজ পণ্যে পূর্ণ না হচ্ছে, ততক্ষণ কোন জাহাজেরই বন্দরে ভেড়ার নির্দেশ দেওয়া হত না। গোলকুণ্ডার মন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের জেরে তিনি বহু সময়ে ব্রিটিশ কোম্পানির বহু জাহাজ, কোন রকম কর আর শুল্ক না দিয়েই পারসিক ব্যবসার কাজে (যেমন ১৬৩৭, এবং ৪০ সালে চিনি পাঠানো) ব্যবহার করতেন। ১৬৫১-৫২ সালে একটি জাহাজ মছলিপত্তনম থেকে মারাকান উপকূলের গদর বন্দর হয়ে গম্ব্রুন পৌঁছয় এবং সেই জাহাজে কোম্পানির পণ্যের সঙে তাঁরও শুল্ক মুক্ত ২০০ টুনাম পরিমান পণ্য ছিল। ১৬৫৩ সালে গাম্ব্রুনে ব্রিটিশ ফ্যাক্টরেরা আশংকা করলেন, তাঁর শুল্ক মুক্ত দুই বেল গাঁটরির খবর যদি শাহবান্দার পায় তাহলে ঝামেলা হতে পারে – কেন না শাহবান্দারের দায়িত্ব ছিল, তাদের দেশে মুসলমানেদের পাঠানো গাঁঠরি খুলে তল্লাসি করা। মাদ্রাজের ফ্যাক্টরেরা ব্রিটিশ বণিকদের জানালেন, যদি এই দেশে যদি তাদের কাজ করতে হয়, বাণিজ্য সুবিধে পেতে হয়, তাহলে তাদের মীর জুমলার মতানুযায়ী কাজ করতে হবে। মীর জুমলা বাঙলার সুবাদার হয়েও এই ভাবেই শুল্কমুক্ত পণ্য পাঠাতেন বিদেশে।
১৬৪২, ৪৬ এবং ৪৮ সালে ব্রিটিশ নাবিকের নেতৃত্বে তাঁর জাহাজ মোকায় ব্যবসা করতে গিয়েছিল।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ব্যবসার পতনের ফলে মীর জুমলা ক্রমশ তাঁর বিদেশি ব্যবসার বহর বাড়িয়ে তাদের ছেড়ে যাওয়া বৈদেশিক ব্যবসার দেশগুলি – আরাকান, পেগু, টেনাসরিম, মালয় উপদ্বীপ, পারস্য এবং আরব বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। ষোড়শ শতে পর্তুগিজেরা আরবি বণিকদের সমুদ্র বাণিজ্য কর্ম থেকে হঠিয়ে দিতে থাকে। সপ্তদশ শতের প্রথমার্ধে পর্তুগিজ এবং বিজয়নগরের বাণিজ্যকর্মের পতন ঘটতে থাকায়, এই শূন্যস্থান পূরণ করতে উদ্যমী হয়ে ওঠেন মীর জুমলা। এর সঙে যুক্ত হয় ব্রিটিশ এবং ডাচেদের পারস্পরিক লড়াই এবং প্রত্যেকেই তাঁর আনুকূল্য চাইতে থাকায়, তাঁর ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠতে থাকে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পারসিক এবং বার্মা বাণিজ্যেরও প্রতিযোগীরূপে নিজেকে উপস্থিত করতে থাকলেন মীর জুমলা। মছলিপত্তনম থেকে মীর জুমলার পারস্য বাণিজ্যে পাঠানো শুল্কমুক্ত পণ্য থেকে ব্রিটিশেরা কিছুতেই শুল্ক নিতে পারছিল না, ফলে তারা বঙ্গোপসাগরীয় অন্যান্য বাণিজ্য কেন্দ্র থেকে যতটা পারা যায় শুল্ক আদায় করত। এছাড়াও পেগু এবং বার্মা সমুদ্রেও যতটা পারা যায় ব্যবসা মুনাফা নিংড়ে নেওয়ার চেষ্টা করত।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment