জগদীশ নারায়ণ সরকার
৬০০০ ঘোড়সওয়ার, ১৫০০০ পদাতিক, ১৫০টা হাতি এবং বিশাল সাঁজোয়া বাহিনীর সম্পদ, নগদ অর্থ, সোনায় মোড়া অস্ত্রশস্ত্র, হিরে নীলকান্ত মণি, জহরত, পণ্য, আসবাব ইত্যাদি নিয়ে মীর জুমলা, আওরঙ্গজেবের শিবিরের দিকে চললেন। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন মালিনজী, নাসিরি খান, এবং তাকে আনতে পাঠানো মীর সামসুদ্দিন। হায়দ্রাবাদে শাহজাদা সকাশে তিনি আবির্ভূত হলেন অভিজাত নন, শাহজাদারূপে। ২০ মার্চের জ্যোতির্বিদের গণনা করা শুভ মুহূর্তে তিনি শাহজাদার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁর শিবিরে, যার ‘পরিচর্যা আর অবধানে’ তিনি দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি, তাকে ৩০০০ ইব্রাহিম পেশকাশ দিলেন, এবং প্রত্যুত্তরে কিছু উপহারও পেলেন। আওরঙ্গজেব তাঁকে খিলাকতখানায় নিয়ে গেলেন, এবং যেন সেখানে মীর জুমলা নতুন জীবন লাভ করলেন। গোলকুণ্ডার সঙ্গে শান্তি চুক্তির পক্ষকাল পরে, ১৪ এপ্রিল আওরঙ্গজেব মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। মীর জুমলা তাঁকে আর তাঁর পুত্রকে কয়েক লক্ষ টাকার উপঢৌকন দিলেন।
(তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত)
চতুর্থ অধ্যায়
মুঘল উজির রূপে মীর জুমলা
প্রথম ভাগ
আওরঙ্গজেবের দূত হিসেবে উজিরিকর্ম
১৬ এপ্রিল হায়দ্রাবাদ থেকে বেরিয়ে পড়ে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে ইন্দৌর গেলেন ২ মে। প্রায় একসঙ্গে একপক্ষকাল কাটিয়ে তাঁরা দুজনে আগামী ভবিষ্যতের কাজকর্ম নিয়ে বিশদে আলোচনা করলেন, বিশেষ করে রাজধানীর সিংহাসনের দিকে নজর রেখে আগামী দিনের রণসজ্জা কিভাবে সামলানো যায় সে ভাবনা ভাবতে শুরু করলেন। তাঁকে গোপনে শুভেচ্ছা এবং তাঁর বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি দিলেন মীর জুমলা। ইন্দৌর থেকে আওরঙ্গজেব তাকে আর তাঁর পুত্রকে নিয়ে কাজি আরিফের সমবিব্যহারে রাজধানী যাবার নির্দেশ দিলেন, সেটা ৩ মে। ন্যায়দণ্ডধারী মহম্মদ বেগ ১০ এপ্রিলের ফর্মান অনুযায়ী মীর জুমলাকে মুয়াজ্জম খান(মহিমান্বিত বন্ধু) উপাধি এবং রণবাদ্য সহ অনেক কিছু উপহার দিলেন।
দিল্লিতে ডেকে পাঠানোর চিঠির প্রতিক্রিয়ায় তিনি ইন্দোর ছাড়লেন ৭ মে। রাস্তাতেও তিনি আওরঙ্গজেবের সঙ্গে নিয়মিত চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে গিয়েছেন। সম্মান পাওয়ায় সংবাদে আওরঙ্গজেব তাকে অভিনন্দন জানালেন, এবং সম্রাটের ডাকের প্রতিক্রিয়ায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিল্লি পৌঁছনর বার্তা দিলেন, আর বললেন, পথে নান্দেরে তাঁর সঙ্গে খ্বজা আহমেদ আরিফ যোগ দেবেন। তিনি আরও জানতে চাইছিলেন মীর জুমলা মহম্মদ আমীনকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন, না কি তাকে ইন্দোরে রেখে গিয়েছেন। এছাড়াও কর্ণাটকের জমিদারদের মন জয় করতে পেরেছেন কিনা তাও প্রশ্ন করলেন। উত্তরে জানালেন, মীর মহম্মদ আমীন বুরহানপুর পর্যন্ত এসে প্রচণ্ড বর্ষায় আর এগোতে পারেন নি। ২৭ জুন আওরঙ্গজেব খবর পেলেন যে মীর জুমলা পাদশাহের থেকে ব্যক্তিগত চিঠি পেয়েছেন। এই খবরে আওরঙ্গজেব ভীষণ খুশি হয়ে মীর জুমলাকে লিখলেন, ‘...আমার মন ভাগ্যের ঘোমটা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি দেখতে চাই তোমার সব পরিকল্পনা সফল হচ্ছে। আমি কিন্তু তোমার বর্তমানের ছোটখাট সম্মান পাওয়ায় খুব একটা প্রীত হচ্ছি না। আমি জানি তুমি আরও ওপরের দিকে তাকয়ে রয়েছ, সেটা তোমার অধরা থাকবে না। তা খুব তাড়াতাড়ি বাস্তবে রূপ পাবেই, যদিও তাতে শত্রুদের চরম ঈর্ষা আর হাহাকার বন্ধ হবে না। (কবিতা) অপেক্ষা কর কখন তোমার ভবিষ্যতের ভোর হবে, এটাই শেষ প্রহর।’
আওরঙ্গজেব সাদুল্লা খানের মৃত্যুতে একজন সহযোদ্ধা হারিয়েছিলেন, তাই তিনি সাম্রাজ্যের বাহিনীতে মীর জুমলার মত দক্ষ মানুষ চাইছিলেন অধীর আগ্রহে। তিনি মীর জুমলাকে সরিয়ে রেখে(বাফার এজেন্ট) দারার বিরুদ্ধে ঘুটি সাজাবার পরিকল্পনা করছিলেন। আওরঙ্গজেব শাহ্নওয়াজ খানকে লিখলেন, ‘সাদুল্লা খানের মৃত্যুতে আমি এক শুভচিন্তককে হারিয়েছি। এখন মুয়াজ্জম খান আমার শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বিশ্বাসী আমার ইচ্ছেয় এগোতে শুরু করেছে, আবার ধারণা এ বিষয়ে সর্বশক্তিমান আমাদের সঙ্গে আছেন’। উল্টো দিকে দারা, মীর জুমলাকে সামরিক বাহিনীতে নেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেন। দারার শিবিরের সমস্ত বিরোধিতা সরিয়ে রেখে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের যে গোলযোগ চলছে, তা মেটাতে পাদশাহ, মীর জুমলার ওপরেই আস্থা পেশ করার সিদ্ধন্ত নিলেন; তাঁর স্থির নিশ্চয় ছিল যে পারসিকদের থেকে কান্দাহার উদ্ধার করার ক্ষমতা একমাত্র মীর জুমলারই রয়েছে।
রাজধানীর দিকে সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে গৌরবময় মীর জুমলার যাত্রা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দিল্লিতে থাকা মানুচি লিখছেন, ‘যে অঞ্চল হয়ে তিনি যাচ্ছেন, সেখানের প্রশাসক তাকে সম্মান জানাচ্ছেন উপঢৌকন পাঠিয়ে... দিল্লির কাছাকাছি আসতে সম্রাট সব সব থেকে বড় সেনানায়ক পাঠিয়ে সসম্মানে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করেন। রাজা গেলে রাস্তা এবং তাঁর পাশের দোকানগুলি যেমন সজ্জিত করা হয়, সম্রাটের নির্দেশ ছিল, মীর জুমলার যাত্রাপথেও ঠিক তেমনি সজ্জা করার।’ ২৫ রমজান ১০৬৭, ৭ জুলাই ১৬৫৬, মীর জুমলার দিল্লির কাছাকাছি আসার সংবাদ পেয়ে সম্রাট মীর আতিশ কাশিম খান এবং দানিশমন্দ খান বক্সীকে শহরের বাইরে গিয়ে তাকে অভ্যর্থনার নির্দেশ দিলেন। শুভ দিনে তিনি সম্রাটের সঙ্গে দেখা করলেন এবং সভায় সভাসদেদের মধ্যে তাঁকে সব থেকে উঁচু আসনে বসার সম্মান দিলেন পাদশাহ।
সম্রাটকে তিনি ১০০০ মোহর এবং কিছু দামি গয়নাগাঁটি নজর হিসেবে দিলেন যার মধ্যে ছিল কর্ণাটকের হিরের খনির কিছু বাছাই করা হিরে। সেদিন সম্রাট তাঁকে আরও একটি বিশেষ খিলাত দিলেন এবং তাঁর পদ মর্যাদা হাজারি হাজার সওয়ারে বৃদ্ধি করলেন, এবার থেকে তিনি ৬০০০ জাত এবং ৬০০০ সওয়ারের পদে বৃত হলেন। ৭ এপ্রিল ১৬৫৬ সালে প্রধানমন্ত্রী সাদুল্লা খানের দেহান্ত হয়। সম্রাট তাঁর মৃত প্রধানমন্ত্রীর পদ, সমগ্র সাম্রাজ্যের দিওয়ানিকুল বা দিওয়ানিআলম অর্থাৎ দিওয়ানের প্রধানমন্ত্রীর পদে বরণ করলেন মীর জুমলাকে। এছাড়াও তাঁকে একটি বহুমূল্যের রত্নে সুসজ্জিত কলমদানি, বিশেষ হাতিশাল থেকে ১০টা হাতি, ঘোড়াশাল থেকে ২০০ ঘোড়া, একটি মাদি হাতি, ৫ লাখ টাকা উপহার হিসেবে দিলেন। মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে তাঁর পাওয়া সম্মান এবং উপহার সম্বন্ধে জানালে, উচ্ছ্বসিত শাহজাদা লিখলেন, ‘আশাকরি সর্বশক্তিমান তোমায় পাদশাহকে খুসি করার মন্ত্র উপহার দিক, যার ফলে তুমি আদতে সর্বশক্তিমানকেই আরাধনা করছ।’ শাহজাহান কুতুব সাহকে লিখলেন, ‘দৈনিক উপহারে উপহারে সম্মানে সম্মানে মীর জুমলার আভিজাত্য যেন বেড়েই চলেছে।’ এছাড়া উপহার স্বরূপ পাদশাহ মীর জুমলাকে রাজস্বমুক্ত কর্ণাটক শাসনের অনুমতি দিলেন।
১৬৫৫-৫৬ বছরটি মীর জুমলার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গোলকুণ্ডার অশক্ত সুলতানের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়াই শুধু নয়, মীর জুমলা কর্ণাটক নিজের তাঁবে রাখলেন তাই নয়, সম্রাটের আন্তরিক ইচ্ছেয় তাঁর নিজের জাগির হল সেই এলাকাটি। এছাড়াও তাঁর শত্রু হয়ে ওঠা পুরোনো প্রভুর হাত থেকে সাম্রাজ্যের পক্ষ্মপুটে শেষমেশ নিরাপদ আশ্রয়ও পেলেন। তাঁর দীর্ঘ সফল রাজনৈতিক জীবনের শিক্ষা নবিশীর দিন শেষ হল এই বছরেই। ভাগ্য তাকে আগামী দিনে ঝড়ঝঞ্ঝ্বাময় ভবিষ্যৎ সামলানোর রণপরীক্ষার দিকে ঠেলে দিল এত দিনে।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment