আবার ফিরি নতুনগ্রামের কাঠের পুতুলের বাখানে। বাঙলার গ্রামের
মানুষেরা এই পুতুলগুলিকে কিন্তু বর-বৌ পুতুল নামে ডেকে থাকেন। এক সময়ের বাচ্চা
মেয়েরা খেলনা বাটি খেলার সময় এই পুতুলগুলি ব্যবহার করত। নতুন গ্রামের শিল্পীরা
এগুলোকে বলেন রাজা-রাণী পুতুল। এই পুতুল নিয়ে অবন ঠাকুর ১৯৩৫ সালের বিশ্বভারতী
কোয়াটার্লি পত্রিকায় একটি রূপকথার গল্প লিখেছেন। চার বন্ধু রাস্তা চলতে শুরু
করেছিল। জঙ্গলের রাস্তায় যেতে যেতে রাস্তায় সন্ধ্যে নেমে এল। প্রত্যেকের এক এক
প্রহর জাগার পালা। প্রথম প্রহরে জাগার ভার পড়ল ছুতোর বন্ধুর ওপর। জেগে থাকতে থাকতে
অভ্যেস মত গাছের ডাল কেটে কুটে একটা মেয়ে পুতুল বানিয়ে ফেললে। এবার সাজওয়ালা
বন্ধুর জাগার পালা। সে সেই পুতুলটিকে সাজিয়ে তুলল। সোনালি রঙে ভরিয়ে তুলল তার দেহ,
হাতের তালু, পায়ের পাতায় পড়ল গোলাপি রঙ, খঞ্জন পাখির চোখের মত করে তার চোখ আঁকল।
পরের প্রহরে জাগল তাঁতি বন্ধু। সে তাকে কাপড় প্রিয়ে প্রিপাটি করে সাজিয়ে তুলল। শেষ
প্রহরে রাজার ছেলে জাগবে। দেখল সাজিয়ে গুজিয়ে রাখা একটি পুতুল বৌ। সাধুর কাছে শেখা
মন্ত্র দিয়ে প্রাণ দিয়ে জাগিয়ে তুলল মেয়েটিকে। তাঁর পরে কি হল তা আমাদের এই
প্রবন্ধে বিচার্য নয়, কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার, পুতুল তৈরির কাজ শুরু করেছিল
কিন্তু ছুতোর বা সুত্রধর বন্ধু। এবং আজও নতুন গ্রামের সুত্রধরেরা এই পুতুল তৈরি
করেন। এখাড়াও তাঁরা তৈরি করেন কাঠের
প্যাঁচা, যা বাঙলার মহিলাদের লক্ষ্মী পুজর অন্যতম উপকরণ, গৌর নিতাই, রাজা রাণী,
রাধা কৃষ্ণ পুতুল। আশ্চর্্যের বিষয় প্রত্যেকটি চরিত্রের পুতুলে কি ধরণের রঙ
ব্যবহার হবে সেই নির্দেশনামা ভারতের
গ্রামীণ সভ্যতার মানুষেরা করে রেখেছেন। কিছু পুতুলের অবয়ব আর গড়ন শৈলী একই কিন্তু
তাদের রঙ পাল্টে চরিত্র ব্দলে দেওয়া হয়। এই রঙসূত্র গ্রামীন সভ্যতার ছোট্ট ছোট্ট
বচ্চারাও জানে। তাঁরা জানে একই ধরণের কাঠামোয় রঙ পালটে গেলে সে কোন চরিত্রে
রূপান্তরিত হয়। এটি খুব বড় তাত্ত্বিক এবং একই সঙ্গে প্রায়োগিক বিষয়। এই বিষয় নিয়ে
গভীর যে এটি নিয়ে খুব বিশদে গবেষণা প্রয়োজন।
নতুন গ্রাম ছাড়াও দাঁইহাট, পাটুলি, কাষ্ঠশালী ইত্যাদি গ্রামের
কারিগরেরা কাঠের পুতুল তৈরি করতেন। হাওড়ার আমতার থলে-রসপুরে সুত্রধরেরা কাঠের
পুতুল তৈরি করেন। চন্দননগর আর শ্রীরামপুরে কাঠের পুতুল তৈরি হত। মেদিনীপুরের
দাসপুর, কানাশোল, কেশপুরের আকুলষাঁড়া, বিনপুরের রামগড়-ধরমপুরে কাঠের বেশ চিত্র
বিচিত্রিত পুতুল তৈরি হত, এখন কয়েক্টি আঁচড় পড়ে মাত্র। এগুলি চেহারায় বেশ আদিম।
বিষ্ণুপুর আর বেলেতোড়ে এক সময় টানা টানা চোখের কাঠের পুতুলের কথা উল্লেখ করছেন
তারাপদ সাঁতরা মশাই। পুরুলিয়ার চোড়দা, সেনেড়া, বৃন্দাবনপুরের সূত্রধরেরা বৌ পুতুল
তৈরি করেন। কেঁদুলি বক্রেশ্বরের মেলায় বীরভূমের সূত্রধরেরা খেঁদা পুতুল আনতেন। আশুতোষ
সংগ্রহশালায় বাংলাদেশের বেশ কিছু পুতুল রয়েছে।
এই পুতুল কোথাও তিন কোণা, কোথাও অর্ধ গোলাকার। পুতুলগুলো হয়
সাধারণ গামার কাঠ থেকে। এছাড়াও আমড়া, জিওল, শ্যাওড়া, ছাতিম, শিমূল ডাল কেটে পরিমিত
ভাবে কাটাই ছাঁটাই করে পুতুলের রূপ দেওয়া হয়। পুরুষেরা ছেনি, বাটালি দিয়ে পুতুলের
অবয়ব দেন। মেয়েরা পুতুলের গায়ে রং লেপার কাজ করেন।
No comments:
Post a Comment