৭ সংখ্যার ২রা মার্চ, ১৯০০ তারিখের চিঠিতে জগদীশ চন্দ্র,
রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন, ‘আমাদের কর্ম্মফল
অনেক এবং অনেক দুরাশা আমাদিগকে পদে পদে লাঞ্ছিত করে। কতদূর মন সঙ্কীর্ণ করিতে
হইবে, কতদূর কার্য্যক্ষেত্র সঙ্কুচিত করিতে হইবে – ইহার শেষ কোথায়? আপনি এ সব
শুনিয়া কষ্ট পাইবেন জানিয়াও না লিখিয়া পারিলাম না। কোন্ দিন কোন্ অপ্রত্যাশিত
পতন আছে জানি না।’ ৬ মার্চ ১৯০০, ৮ সংখ্যার চিঠিতে লিখছেন, ‘আমি
ইতিপূর্ব্বে(বিলেত) গিয়াছিলাম এবং তখনও কলেজ এক প্রকার চলিয়াছিল এ কথা জানা
থাকাতেও যখন এ আপত্তি করিলেন তখন আর আমি কি করিব? তার পর বলিলেন যে, Send
me your letter of invitation from Paris and I will send a report. বলিতে লজ্জিত হইতেছি যে সেই
নিমন্ত্রণ পত্র অনেক দিন আমার পকেটে থাকিয়া সম্ভবত হয়ত ধোপাবাড়ী গিয়াছে – অন্ততঃ
আমি খুঁজিয়া পাইতেছি না। ...বলিলাম যদি পাঁচ সপ্তাহ অপেক্ষা করিতে পারেন তবে
একখানা নিমন্ত্রণ পত্র হাজির করিতে পারি। কিন্তু সে চিঠি না হইলে নাকি চলিবে না।
যাওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখিতেছি না।’ ২৭
সংখ্যার লন্ডন থেকে লেখা চিঠিতে বলছেন, ‘আমাকে যে আর ছুটী দিবে এ রূপ বিশ্বাস হয়
না। দেশে ফিরিলে কিরূপ কার্যের সুরাহা হইবে তাহার নমুনা স্বরূপ একখানি চিঠি পাঠাই।
উক্ত হতভাগ্য আমার রেকমেন্ডেশনে রিসার্চ স্কলারশিপ পাইয়াছিল, তাহার উপর বিশেষ
জুলুম। দেখ এ কথা আর কাহাকে বলিও না, কারণ ছেলেটির অনিষ্ট হইবে, আর যদি কোন বিষয়
রেস কশ্চেনএ দাঁড়ায় তাহা হইলে শেষে কি হয় তাহা জান।’ ৩২ সংখ্যার চিঠিতে লিখছেন,
‘আমি এক বছরের ছুটী চাহিয়াছিলাম তাহার পরিবর্ত্তে ৬ মাস পাহিয়াছি। সুতরাং সমস্ত
কার্য সমাধা করিতে পারিব না। জার্মানি ইত্যাদি স্থানে বক্তৃতা করিবার নিমন্ত্রণ
রক্ষা করিতে পারিব না।’
হয়ত ভারতে শাসক ইংরেজরা বুঝতে পারছিল জগদীশ্চন্দ্রের
গবেষণা মননটি সেনা প্রস্তুতি অথবা বিশ্বজোড়া দৈত্যসম ব্যবসার অনুকূল নয়। নানান ছোট
বড় ধাক্কায় বেসামাল হয়ে পড়ছে। শুরুর দিকে পশ্চিমি বিজ্ঞানের প্রতি মুগ্ধতা কিছুটা
ছিল। কিন্তু ১৯০০ সালে লন্ডনে যা বুঝলেন, তা হল বিজ্ঞানের ঘোমটায় কর্পোরেটিয়
প্রযুক্তির আধিপত্য। তখন থেকে সে পশ্চিমী মুগ্ধতাটির রেশ কাটতে শুরু করেছে। ৪৫ সংখ্যার চিঠিতে লিখছেন, আইডিয়াল ভাঙ্গিয়া
গেলে আর কি থাকে? এতদিন এ দেশের বিজ্ঞানসভায় অনেক বিশ্বাস করিয়াছি – তাহা দূর
করিয়া লাভ কি? অধিক দিন থাকিতে পারিলে আমি একাই এই ব্যুহ ভেদ করিতে পারিতাম –
কিন্তু আমার মন ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। ’। ৪১ সংখ্যার চিঠিতে লিখছেন, ‘বন্ধু আমি এতদিনে
আমার জাতীয় মহত্ব বুঝিতে পারিতেছি। স্বদেশীয় আত্মম্ভরী আর বিদেশীয় নিন্দুকের কথায়
চক্ষে আবরণ পড়িয়াছিল। এখন তাহা ছিন্ন হইয়াছে – এখন উন্মুক্ত চক্ষে যাহা প্রকৃত
তাহাই দেখিতেছি। অঙ্কুরিত বীজের উপর পাথর চাপা দিলে প্রস্তর চূর্ণীকৃত হয়। সত্য ও জ্ঞানকে কেহ
পরাভব করিতে পারে না। জীবনে সেই পুরাকালের লক্ষ্য অঙ্কিত করিয়া দাও। আমাকে যদি
শতবার জন্মগ্রহণ করিতে হয়, তাহা হইলে শতবারই যেন হিন্দুস্থানে জন্মগ্রহণ করিতাম।
তিনি দেশজ জ্ঞাণের সঙ্গে পশ্চিমি জ্ঞাণচর্চাকে মেলাবার ভাবনা থেকে সরতে সরতে,
দেশজ বিজ্ঞাণ ভাবনায় আশ্রয় নিতে চাইছিলেন। ১৮৯৬
সালে নিজের গবেষণা ইত্যাদি নিয়ে লন্ডনে যান। ১৯০০ থেকে নতুন করে লন্ডনে থেকে
যাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন। সারা জীবন না হলে অন্ততঃ পাঁচ বছর। কিন্তু নানান
বৌদ্ধিক অত্যাচারে তিনি ক্রমশঃ নিজের ভেতরে ডুবে দেখতে শুরু করেন। স্বদেশমুখী হতে
শুরু করেন। পত্রাবলীর ২৭
সংখ্যার চিঠিতে লিখছেন, ‘বন্ধু আমাদের যাহা অমুল্য আছে তাহা ভুলিয়া মিছামিছি না
বুঝিয়া হিন্দুয়ানি লইয়া গর্ব্ব করি। আমাদের প্রকৃত ইনহেরিটেন্স বুঝাইয়া দেও –
প্রকৃত মহত্ব বুঝাইয়া দেও।’ ৩৯ সখ্যার ২৯এ নবেম্বর ১৯০১ এর চিঠিতে লিখছেন, ‘গাছ
মাটী হইতে রস শোষণ করিয়া বাড়িতে থাকে, উত্তাপ ও আলো পাইয়া পুষ্পিত হয়। কাহার গুণে
পুষ্প প্রষ্ফুটিত হইল? – কেবল গাছের গুণে নয়। আমার মাতৃভূমির রসে আমি জীবিত, আমার
স্বজাতির প্রেমালোকে আমি প্রষ্ফুটিত। যুগ যুগ ধরিয়া হোমানলের অগ্নি অনির্ব্বাপিত
রহিয়াছে, কোটি কোটি হিন্দুসন্তান প্রাণবায়ু দিয়া সেই অগ্নি রক্ষা করিতেছেন, তাহারই
এক কণা এই দূর দেশে আসিয়া পড়িয়াছে। আমি যে তাহাদেরই প্রাণের অংশ তোমাদের দুঃখসুখের
অংশী একথা সর্ব্বদা হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দিও।’ ৪৮ সংখ্যার চিঠিতে স্পষ্টভাবে লিখছেন,
‘তোমার আহ্বান আমাকে দেশের দিকে টানিতেছে – শীঘ্রই তোমাদের সহিত দেখা করিব এই মনে
করিয়া মন উৎসাহে পরিপূর্ণ হইতেছে। তুমি যাহার সূত্রপাত করিতেছ(আশ্রম বিদ্যালয়)
তাহাই আমাদের প্রধান কল্যাণ। আমাদের সাম্রাজ্য বাহিরে নয় – অন্তরে। পুণ্যভূমি
ভারতবর্ষ – ইহার অর্থ বুঝিতে অনেক সময় লাগে। নিরাশার কথা শুনিয়া মন ভাঙ্গিয়া যায়
কিন্তু তোমার নিকট উৎসাহের কথা শুনিয়া বড়ই আশান্বিত হইয়াছি। ভারতের কল্যাণ আমাদের
হাতে, আমাদের জীবন দিয়া আমাদের আশা, আমাদের সুখ দুঃখ আমরাই বহন করিব। মিথ্যা
চাকচিক্যে আমরা যেন ভুলিয়া না যাই; যাহা প্রকৃত যাহা কল্যাণকর তাহাই যেন আমাদের
চিরসহচর হয়। বিদেশে যাহা উন্নতি বলে তাহার ভিতরে দেখিয়াছি। আমরা যেন কখনও মিথ্যা
কথায় না ভুলি। পুণ্যি আমাদের প্রধান লক্ষ্য। অন্তরে কিম্বা বাহিরে প্রতারণা দ্বারা
আমরা কখনও প্রকৃত ইষ্ট লাভ করিব না। পরের চিঠিতে তাঁর বইএর উৎসর্গ পত্রে লিখবেন
ভাবছেন, ‘To my countrymen who will yet claim the intellectual
heritage of their ancestors. কিন্তু বন্ধু এমন কথা বলিতেও
লজ্জিত হইতে হয়। তোমরা আমার কামনা বুঝিয়া লইও।’ এ ছাড়াও তাঁর রচনাগুলি এই পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে।
No comments:
Post a Comment