কাঠের
পুতুল
সেদিন
পর্যন্ত শহরে কাঠের তেকোনা পুতুল পাওয়া যেত। বৃটিশপূর্ব বাংলায় কিছু ছিল না, এই
মতবাদের প্রবক্তারা এই পুতুলগুলির নাম দিয়েছিলেন মমি পুতুল। তাঁদের দাবি এগুলো
প্রভাবিত হয়েছিল মিশরের মমির আদলে। এগুলো কিন্তু উৎপাদন হত সুদূর বর্ধমানের
নতুনগ্রামে। অথচ দুঃখের তথ্য হল, আজও নানান লেখা পত্রে এগুলোর নাম মমি পুতুল থেকে
গিয়েছে। অন্য দিকে কলকাতা শহরের মানুষেরা এগুলির নাম দিয়েছিলেন কালিঘাটের পুতুল।
কলকাতার কালিঘাটের মন্দিরের আশেপাশের নানান দোকানে নিত্য প্রয়োজনীয় নানান ঘর
গেরস্থালীর নানান জিনিসপত্রের সঙ্গে এই পুতুলগুলো বিক্রি হত। পূণ্যার্থীরা দেবীর
দর্শন সেরে তাদের প্রয়োজনীয় নানান উপকরণ সংগ্রহ করতেন এই সব দোকান থেকে। সেগুলির
সঙ্গে তাঁরা কিনতেন শিশু ভুলোনো নানান পুতুল। সেই ক্রয় তালিকার মধ্যে আবশ্যিক ছিল
সন্তানদের জন্য এই কাঠের পুতুল।
এদের উচ্চতা হত ১৫ থেকে ২২ সেমি। বেশ রংচঙে। মনোহারী। আগেই
বলা গিয়েছে এই পুতুলগুলো তৈরি করতেন বর্ধমানের হাওড়া কাটোয়া রেল রাস্তায় পড়া
পূর্বস্থলীর কিছু দূরে নতুনগ্রামে। ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ম অনুয়ায়ী এই
পুতুলের কাজ কোন সুদূর অতীত থেকে করে আসছেন বর্ধমানের সূত্রধরেরা সে তথ্য তাঁরা
নিজেরাও জানেন না।
অপ্রাসঙ্গিক হলেও, এই সুযোগে অত্যন্ত কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি সেই
ক্ষণজন্মা মানুষটিকে, যার উদ্যোগে গ্রাম
বাংলার ছোট উৎপাদকেদের, অভিকর শিল্পীদের কাজ ছড়িয়ে পড়েছিল, শেকড় ছেঁড়া শহুরে
মধ্যবিত্তর পাতে, বিশ্বের দরবারে। পুরোনো খেরোর খাতা খুলে দেখছি, প্রায় বিশ বছর
আগে, ১৯৯৫ সাল নাগাদ, এই লেখকের এই গ্রাম নামটির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে বাংলার
গ্রাম-সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণ পুরুষ প্রয়াত রঘুনাথ গোস্বামী মশাইএর শিষ্যত্বে। গুরুর
মমতার তিনি এই অর্বাচীনদের দলকে শিখিয়েছিলেন গ্রামের ছোট উৎপাদকেদের নানান
উৎপাদনের বিভিন্ন দিক দেখার চোখ কিভাবে তৈরি করতে হয়, কোন কোন বিষয় নজর দিতে হয়,
পাঠ্য পুস্তকের বাইরে বেরিয়ে, তৈরি করে দেওয়া ইওরোপিয় চশমার কাঁচ খুলে কি ভাবে
দেশজ দৃষ্টিভঙ্গী ধারণ করতে হয়, স্বকীয় অনুসন্ধানী বিশ্লেষণী তাত্ত্বিক ক্ষমতা
বিকাশ ঘটিয়ে নানান আলোচিত শিল্প দ্রব্যের কিছু অদেখা রেণুকে নতুনভাবে দেখার চোখ মন
আর মস্তিষ্কে জ্ঞানভাণ্ডার তৈরি করতে শিখতে চেষ্টা করতে হয় সে সবের নানান দিক।
বললাম বটে অর্বাচীনদের দলকে শিখিয়েছিলেন, আদতে তাঁর কাছে যারাই কিছু জানতে আসতেন, প্রত্যেককে
অসামান্য নাগরিক ভদ্রতায়, আসামান্য সৌজন্যে, অসামান্য আকর্ষণী মুদ্রায়, শেকড়ে
দাঁড়িয়ে থাকার জ্ঞানে, তাঁদের প্রত্যেককে প্রয়োজনীয় সম্মান দিয়ে যতদূর সম্ভব
ক্ষুৎপিপাসা মেটানোর চেষ্টা করতেন। আর প্রত্যেকেই এই লেখকের মত মনে করতেন তিনি
তাঁদের আলাদা করে নজর আর গুরুত্ব দিচ্ছেন – এমনি অসামান্য ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব।
সেই পরম আস্বাদিত তত্ত্ব, সেই গুরুর পথ আজও নিজের মত করে ধারণ করে থাকার চেষ্টা
করে চলেছি। গুরুর দেখানো পথে চেষ্টা করে চলেছি বাঙলার উৎপাদন, প্রয়ুক্তির,
ইতিহাসের ঔপনিবেশিকপূর্ব রূপকে খুঁজে বার করতে। যে দেড় বছর আমরা তাঁর সংগ করেছি,
সেই সময়টুকুর প্রায় প্রতি পল আমাদের প্রত্যেকের জীবনে যেন নতুনের আহ্বানে, নিজের
ঐতিহ্যের শেকড়ে দাঁড়িয়ে গ্রাম্য উৎপাদনকে দেখার গুরুগৃহ হিসেবে কাজ করেছে। আজ মনে
হয় প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে এই মানুষটি জীবিত থেকে এই লেখাটি দেখে, তাঁর খামতিগুলি
বুঝিয়ে হয়ত সস্নেহে মৃদু বকুনি দিয়ে বলতেন তোমার দায় রয়েছে যথা সম্ভব জরুরি আর
প্রায় আজানা উপাদানগুলি পাঠকের সামনে তুলে ধরার। চলনসই কাজ বলে যে কিছু হয়না, তা
তিনি তাঁর কাজে, আমাদের তৈরি করতে গিয়ে বারে বারে বোঝাতেন। খুব কোমল স্বরে বলতেন, পরেরবার
এই ভুলগুলো কোরোনা। গুরুর অনেক জরুরী কথা কালের হস্তাবলেপনে মন থেকে মুছে গিয়েছে –
আর্বাচীন যে আমরা – সে সময় তাঁর সেই উপদেশগুলি লিখে রাখার কথা মনে হয় নি – কাজ
করতে গিয়ে গুরুর দেখানো পথের বাইরে বেরিয়ে প্রচুর সমঝোতা করেছি। তবুও আজ তিনি
প্রায় কুড়ি বছর চলে গিয়েছেন, তাঁর কন্ঠস্বর, কিছু অননুকরণীয় কিছু মুদ্রা, তাঁর
আপার্থিব স্নেহ, এক্কেবারে গ্রামীণ উৎপাদন দিয়ে নিজের জীবনের যাপনের নানান দিক –
বাড়ি, কাজের যায়গা সাজিয়ে তোলার ভাবনা আমাদের আনেকের পথ চলার পাথেয় হয়ে রয়েছে,
জীবনের প্রতি পলে প্রাণের সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে। এই লেখাটি তৈরির মধ্য দিয়ে
গুরু প্রণাম আর তর্পণের পূণ্য আসমাপ্ত কাজটি কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে সুযোগ
দিয়েছেন সম্পাদক মশাই তার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।
No comments:
Post a Comment