তিনি পশ্চিমের দেখানো পথ থেকেও ক্রমশঃ সরতে যে চাইছিলেন
তার প্রমান নিজের আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলোর নাম সংস্কৃত বা মাতৃভাষায় দিয়েছিলেন।
পত্রাবলীর সম্পাদক লিখছেন ‘সম্ভবতঃ তিনি এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের সাহায্য
চেয়েছিলেন। জগদীশ চন্দ্র প্রথম দিকে তাঁর যন্ত্রের নাম করণ করেছিলেন মাতৃভাষায়।
কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ বিষয়ে
জগদীশ চন্দ্রের বর্ণনা উপভোগ্য, ‘রেস্কোগ্রাফ’ যন্ত্রের নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি
বলেছিলেন, ‘ইচ্ছা ছিল যন্ত্রের নাম রেস্কোগ্রাফ না রাখিয়া ‘বৃদ্ধিমান’ রাখি।
কিন্তু হইয়া উঠিল না। আমি প্রথম প্রথম আমার কলগুলির সংস্কৃত নাম দিয়াছিলাম। যেমন
‘কুঞ্চনমান’, ‘শোষণমান’। স্বদেশী প্রচার করিতে যাইয়া অতিশয় বিপন্ন হইতে হইয়াছে।
প্রথমতঃ এই সকল নাম কিম্ভুতকিমাকার হইয়াছে বলিয়া বিলাতি কাগজ উপহাস করিলেন। কেবল
বোস্টনের প্রধান পত্রিকা অনেকদিন আমার পক্ষ সমর্থন করিয়াছিলেন। সম্পাদক লেখেন ‘যে
আবিষ্কার করেন তাহারই নামকরণের প্রথম অধিকার। তাহার পর কলের নাম পুরাতন ভাষা
ল্যাটিন ও গ্রীক হইতেই হইয়া থাকে। তাহা যদি হয় তবে অতি পুরাতন অথচ জীবন্ত সংস্কৃত
হইতে কেন হইবে না?’ বলপূর্ব্বক যেন নাম চালাইলাম। কিন্তু ফল হইল অন্যরূপ। গতবারে
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতার সময় তথাকার বিখ্যাত অধ্যাপক আমার কল
‘কাঞ্চনম্যান’ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। প্রথমে বুঝিতে পারি
নাই। শেষে বুঝিলাম ‘কুঞ্চনমান’ কাঞ্চনম্যানে রূপান্তরিত হইয়াছে। হান্টার সাহেবের
প্রণালীমত কুঞ্চন বানান করিয়াছিলাম, ইহা হইয়া উঠিল কাঞ্চন। রোমক বর্ণমালার বিশেষ
গুণ যে ইহার কোনও একটি স্বরকে অ হইতে ঔ পর্যন্ত যথেচ্ছরূপে উচ্চারণ হইতে পারে;
কেবল হয় না ঋ আর ৯। ...সে যাই হউক বুঝিতে পারিলাম হিরণ্যকশিপুকে দিয়া বরং হরিনাম
উচ্চারণ করানো যেতে পারে, কিন্তু ইংরেজকে বাংলা কিম্বা সংস্কৃত বলানো একেবারেই
অসম্ভব। এই জন্যই আমাদের হরিকে হ্যারি হইতে হয়। এই সকল দেখিয়া কলের ‘বৃদ্ধিমান’
নামকরণের ইচ্ছা একেবারেই চলিয়া গিয়াছে।(সম্পাদকীয় টিকা – পত্রাবলী, পত্র ২৫। পাতা
৫৫। )’। সামগ্রিক বিষয়টি জগদীশ চন্দ্র হাল্কা চালে পেশ করলেও উপনিবেশের তাত্ত্বিক
এই বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, আজও। জগদীশ চন্দ্র পিছু হটেছিলেন। ততদিনে পিছু হটে
গিয়েছিল দেশীয় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা। তখনও জগদীশ চন্দ্র পশ্চিমের বিজ্ঞানচর্চায় সম্পূর্ণরূপে
আস্থাবান। জগদীশ চন্দ্র শুধু নির্বিষভাবে নাম করণ করতে চেয়েছিলেনমাত্র। পিছিয়ে
পড়া, বিজিত পূর্বের এই দাবি মেনে নেবে কেন সাম্রাজ্য জ্ঞানগর্বী পশ্চিম!
শেষ বয়সে প্রযুক্তির বিধ্বংসী অগ্রগতিতে আতঙ্কিত হয়ে
রেডিও তরঙ্গ গবেষণার ভাবনাটিই ত্যাগ করেছিলেন। একজনও ছাত্র তৈরি করেননি, যিনি রোডিও তরঙ্গের আবিষ্কারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে
পারেন। এই “অবিমৃষ্য” কাজের জন্য
রাজেশ কোছারমশাই জগদীশচন্দ্রকে যথেষ্ট অভিশাপমন্দ করেছেন। More
importantly, he would perhaps have become an Indian role-model for production
of wealth through science - J.C. BOSE: The Inventor Who Wouldn’t Patent - Prof Rajesh Kochhar (http://www.qsl.net/vu2msy/JCBOSE1.htm)। ঋষি বলে, কিহোতর বাজে নকল বলে গালি দিয়েছেন। জগদীশচন্দ্র বড়
পুঁজি নির্ভর ব্যবসা বা সেনা উদ্যমের সঙ্গে প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানচর্চা মেলাতে
পারতেন না। তিনি সচেতনভাবেই পুঁজিবাদের
রোলমডেল হতে চান নি। হয়ত বুঝেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁর উদ্ভাবনীটি সেনাবাহিনীর
খপ্পরে পড়বে, এবং শেষে বড় পুঁজি সেটিকে নিয়ে যথেচ্ছ মুনাফা কামানোর পরিকাঠামো তৈরি
করবে। রাজেশ কোছারের আফসোস, জগদীশচন্দ্র সেই গবেষণার সুযোগ নিলে ভারত তরঙ্গ
গবেষণায় আজ অনেক দূর এগিয়ে থাকতে পারত। এই আক্ষেপ ছিল দেশজ রসায়ণ
চর্চারপ্রতি নিবেদিতপ্রাণ প্রফুল্ল রায়মশাইএর। শিল্পবিপ্লবের মহত বেকনিয় মনোভাবের
স্বপ্নে গড়ে তুললেন বিশালতম বেঙ্গল কেমিক্যাল(চরখার অন্যতম সমর্থক তিনি, শেষের
দিকে তাকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়)। বহিরাঙ্গে দেশজ কিন্তু অন্তরে পশ্চিমের শিল্পবিপ্লবের
অনুকরণপ্রিয়তায় আত্মগর্বী। ১৯১৬তে জগদীশচন্দ্রের নাইটহুডের সম্বর্ধনায় রায়মশাই আচার্যকে বেশ একটু
খোঁচা দিয়েই বললেন, If he had taken out patents for the
apparatus and instruments which he had invented, he could have made millions by
their sale. (J.C. BOSE: The Inventor Who Wouldn’t Patent -Prof Rajesh Kochhar, http://www.qsl.net/vu2msy/JCBOSE1.htm)।
No comments:
Post a Comment