বাংলার পুতুল
নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। তার পরাবাস্তব বলিষ্ঠতাময় জীবনীশক্তি, আসামান্য কারুকৃতি,
তার নিজস্বতা, প্রত্যেকটির নিজস্ব আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য তার আপাত
সারল্যের মধ্যে জটিলতম গড়নশৈলী আর প্রযুক্তি আমাদের বিমুগ্ধ করে রাখে। এই বাংলা
নতুন শতেও বাংলার পুতুল নতুন করে আনুসন্ধিৎসুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার বৈচিত্রে,
গড়নের সৌকর্যে আর ঐতিহ্যের প্রবাহমানতায়।
পুতুল তৈরির প্রাথমিক উদ্দ্যেশ্য শিশুদের মনোরঞ্জন। তাদের
কাছে এটি খেলার উপকরণ অর্থাৎ খেলনা বিশেষ। এ ছাড়াও বাংলার নানান এলাকায় ব্রতের
পুতুল তৈরি হয়। গ্রাম দেবতার থানে মানত করতেও বিভিন্ন অঞ্চলে পুতুল তৈরি হয়। তবুও
সাধারণের ধারনায় প্রাথমিক ভাবে শিশুদের মন ভোলানোর জন্যই পুতুলের প্রয়োজনীয়তা।
শিশুদের হাতে খেলনা হিসেবে যে পুতুল তুলে দেওয়া হয়, তার অন্যতম উদ্দ্যেশ্য হল
সেগুলি নাড়াচাড়ার মাধ্যমে সে যেন তার পারিপার্শ্বিক নানান বস্তুকে চিনে নিতে পারে।
তারাপদ সাঁতরা মশাই বলছেন, পুতুল খেলার
মাধ্যমে কন্যাদের হাতে খড়ি হয়ে থাকতো তাদের ভবিষ্যৎ সংসার জীবনের স্নেহ-প্রীতি
বন্ধনে আবদ্ধ জীবন চর্যায়।
উপকরণের মধ্যে মাটি হল আন্যতম প্রধান। এ ছাড়াও কাঠ, শোলা,
ন্যাকড়া, তালপাতা, কাগজ, চিনি, ধাতু ইত্যাদি দিয়েও পুতুল তৈরি হয়। প্রত্যেক পুতুলে
এলাকাগত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পুতুলগুলো উৎপাদকেরা সাধারণতঃ মেলায় নিয়ে আসেন,
কখোনো আনেন বিক্রেতারা। সেখান থেকে উৎসাহীরা সেগুলি সংগ্রহ করেন। নানান গ্রামীণ
উৎপাদনের মতই খুব কম দামে বিক্রিত হত বলে, এই খেলনা বা নানান আচারের পুতুল
উপকরণগুলি কিন্তু উতপাদক বা বিক্রেতারা খুব অনাদর করতেন না। বরং এগুলি যেহেতু
বিনোদন, শিক্ষা এবং আচারের নানান কাজে অত্যন্ত্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ছিল, এগুলি তৈরিতে
বা বিতরণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব অর্জন করত এই পুতুলগুলি।
সমাজে এই পুতুলগুলির স্থান এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে গুপ্ত
যুগের সাহিত্যিক, শুদ্রক নিজের একটি নাটকের নাম শিশুদের হাতে টানা কটকট আওয়াজের
মাটির গাড়ি বা মৃচ্ছকটিক রেখেছিলেন। আজও
আমরা নানান মেলায় সেই গাড়ি বিক্রি হতে দেখি। এই ভেঙ্গে পড়া সময়েও ভারতীয় সভ্যতার
খুব ছোট ছোট রেণুর প্রবাহমানতার আশ্চর্য ঐতিহ্য বর্তমান। সে বিশ্বের অন্যান্য
সভ্যতার মত জাদুঘরে সাজিয়ে রাখার উপাদানে পরিণত হয় নি। এখনো ভারতের শিশুরা অন্তত
দেড় হাজার বছরের ঐতিহ্য খেলনার মধ্যে দিয়ে বহন করে চলেছে। এটাই আদতে ভারতীয় সভ্যতার
জোরের যায়গা। এটাকেই ভেঙে ফেলার চেষ্টা চলছে অহরহ। এখনও গ্রামবাংলা কয়েক হাজার
বছরের শিকড়ের রসে মজে আছে। শিকড়হীন আধুনিকতা তার সভ্যতার মূলোৎপাটন করতে পারে নি;
তার বড় উদাহরণ এখনও গ্রামে, শহরের নিম্নবিত্ত এলাকার শিশুরা আজও মাটির গাড়ি টেনে চিত্ত বিনোদন করে।
এই প্রবন্ধে আমরা বাংলার নানান প্রান্তের বিপুল বৈচিত্র্যময়
পুতুলগুলির কিছু প্রতিনিধিস্থানীয় নিদর্শন বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব, বিভিন্ন
উপাদানে তৈরি পুতুল নিয়ে একটু বিশদে আলোচনা করব। শুরু করব কাঠের পুতুল দিয়ে।
No comments:
Post a Comment